ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন : ক্রমশই বেড়ে চলেছে আন্তর্জাতিক চাপ
বাংলাদেশে রাজনৈতিক অচলবস্থার অবসান এবং সহিংসতা বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। এরই মধ্যে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে তাদের উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠার কথা জানিয়েছেন।
গত ৫ই জানুয়ারি বাংলাদেশে একরফা নির্বাচনের বছর পূর্তির দিন থেকে রাজনীতিতে আবারো অচলবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ৬ই জানুযারি থেকে বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে টানা অবরোধ এবং হরতাল পালন করছে। চলতি সপ্তাহের পাঁচ কর্মদিবসেই হরতাল পালন করছে তারা। গত সপ্তাহেও ছিল টানা পাঁচদিন হরতাল। বৃহস্পতিবার বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাউদ্দিন আহম্মেদ দাবি না মানলে আগামী রবিবার থেকে আরো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন।
এদিকে এই টানা অবরোধ-হরতালের মধ্যে সহিংসতায় বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৮৬ জন নিহত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে ১০ জন শিশুও আছে। এছাড়া আগুন ও পেট্রোল বোমায় আহত হয়েছেন দু’শতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশু। তাঁদের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিত্সা নিতে ভর্তি হয়েছেন ১২৩ জন। ৫৩ জন এখনো চিকিত্সা নিচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে ন’জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এ সময়ে একহাজার ১০টি যানবাহনে আগুন দেয়া হয়েছে, করা হয়েছে ভাঙচুর। রেলে নাশকতা হয়েছে ১১টি।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের চলমান সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে আয়োজিত নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুনের মুখপাত্র স্টেফান দুয়ারিচ এ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে স্টেফান দুয়ারিচ বলেন, ‘‘বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব ব্যক্তিগতভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
গত সংসদ নির্বাচনের আগের ঘটনা নিয়ে আরেক প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র বলেন, ‘‘বান কি-মুনের সাবেক রাজনৈতিক বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এবং তিনি তা করছেন।”
জাতিসংঘ কি কেবল উদ্বেগ প্রকাশকরেই দায়িত্ব শষ করবে, নাকি বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে জাতিসংঘের কোনো করণীয় আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে উল্লেখ করে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র বলেন, ‘‘বাংলাদেশে গত বছর থেকে চলে আসা সহিংসতায় জাতিসংঘ উদ্বিগ্ন এবং এ বিষয়ে জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।”
অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বুধবার সন্ধ্যায় দেখা করেছেন ঢাকায় ব্রিটিশ হাই কমিশনার রবার্ট গিবসন।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে দেখা করে বেরিয়ে রবার্ট গিবসন সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনতে সবাই যেন আস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, যা দেশের বর্তমান অস্থিরতা নিরসন করবে। দীর্ঘমেয়াদি আস্থার প্রক্রিয়া জোরদার হবে বলে আমি আশা করি, যা বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সহিংসতায় অভ্যাসগত যে চরিত্রায়ন ঘটেছে তার বিলুপ্তি ঘটাবে এবং সব বৈধ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শান্তিপূর্ণভাবে পালনকে অনুমোদন করবে।”
তিনি বলেন, ‘‘যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের সমৃদ্ধি-অগ্রযাত্রার অংশীদার। বাংলাদেশে যে সহিংসতা চলছে তা দুঃখজনক এবং নিন্দনীয়। আমি ক্রমাগতভাবে সব পক্ষকে আহ্বান জানিয়ে আসছি – যেন রাজনীতিবিদরা তাঁদের কর্মের পরিণতি সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে ভাবেন। তাঁরা যেন দেশের স্বার্থহানিকর কাজ থেকে বিরত থাকেন।”
এদিকে ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত পিয়ের মায়াউদঁ বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনতিবিলম্বে সংলাপের আহ্বান জানানোর জন্য অনুরোধ করেছেন। বুধবার দুপুরে ইইউ রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় এ অনুরোধ জানান।
ইইউ ঢাকা অফিস থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতে ইইউ রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ‘‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। চলমান সহিংসতা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনে প্রভাব ফেলছে।”
তাই ‘‘যে কোনো ধরনের সহিংসতার বিপক্ষে ইউরোপীয় ইউনিয়ন” – এ তথ্য আবারো জানিয়ে পিয়ের মায়াউদঁ প্রধানমন্ত্রীকে অনতিবিলম্বে সংলাপের আহ্বান জানানোর অনুরোধ করেন।
সাক্ষাত্ শেষে প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব সাংবাদিকদের জানান, ‘‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে আগুন দিয়ে সাধারণ নাগরিক হত্যার ঘটনাকে বর্বরোচিত ও মর্মান্তিক বলে আখ্যায়িত করেছেন।”
আন্তর্জাতিক এই প্রতিক্রিয়া নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দিন খান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এটা স্পষ্ট যে সরকার ও বিরোধী উভয় পক্ষের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। তাঁরা একদিকে যেমন সহিংসতা বন্ধ করতে বলছেন। অন্যদিকে সংকট সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের ওপরও গুরুত্ব দিচ্ছেন। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে এই চাপ আরো বাড়বে।”
তিনি বলেন, ‘‘যে কোনো সংকট থেকে উত্তরনের একমাত্র পথ আলাপ-আলোচনা বা সংলাপ। দেশের মানুষও তাই চায়।”
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান ভারতীয় একটি দৈনিককে বলেন, ‘‘চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সংলাপ আয়োজনে জাতিসংঘের যে কোনো উদ্যোগকে স্বাগত জানাবেন তারা।”