অবৈধভাবে ভুটান যাওয়ার পথে ভারতে আটক ৭ বাংলাদেশী যুবক
‘সংসারের সুক ফিরাবার নাইগ্গা পুলায় আমার কতো কষ্ট, কতো চেষ্টা। মাসে ২০/২৫ হাজার ট্যাহা বেতন অইলে সংসারে সুক ফিরবো। এই আশায় ৪০ হাজার ট্যাহা সুদি কইরা ভুটান দেশও কাম করার নাইগ্গা হাশেমরে দিছে। অহন হুনতাছি পুলায় আমার ইন্ডিয়ার জেলে আটকা খাইছে। দালাল হাশেমও বাড়ীঘর ছাইরা পলাইছে। আমগরে আর ট্যাহা-পইসার সুহের দরকার নাই। আমার পুলারে আমার কাছে ফিরাই দেও। সরকারের কাছে আমি পুলারে ফিরাই পাবার সাহায্য চাই’- কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলেন দরিদ্র গৃহবধু ছোরাইয়া বেগম। শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার সীমান্তবর্তী ডেফলাই গ্রামের এই গৃহবধুর বড় ছেলে সুরুজ মিয়া (২৫) দালালের খপ্পরে পড়ে ভালো বেতনে কাজের আশায় অবৈধভাবে ভুটান যাওয়ার পথে ভারতীয় পুলিশের হাতে আটক হয়ে কোলকাতার একটি কারাগারে বন্দি রয়েছে।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ডেফলাই গ্রামের দরিদ্র মজুর হাবীবুর রহমানের ছেলে সুরুজ মিয়া গাজীপুরে একটি বিস্কুটের ফ্যাক্টরীতে ৫ হাজার টাকা বেতনে শ্রমিকের কাজ করতো। তার স্ত্রী সেখানেই একটি গার্মেন্টসে কাজ করে। তাদের আড়াই বছর বয়সী একটি সন্তানও রয়েছে। অভাব তাদের পরিবারের পিছু ছাড়ছিলো না। পরিবারের অভাব দুর করতে ভালো বেতনে চাকুরীর আশায় একই এলাকার দালাল আবুল হাশেমের মাধ্যমে সে ভুটান যাওয়ার ফাঁদে পা দেয়। গান্ধিগাঁও গ্রামের হাশেমের দুই ভাই শান্ত ও হান্নানও অবৈধভাবে ভুটানে গিয়ে কাজ করছে। প্রতি মৌসুমে হাজারে ২০ কেজি করে ধান সুদ হিসেবে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে স্থানীয় এক আত্মীয়ের নিকট থেকে ৪০ হাজার টাকা সুদের ওপর কর্জ নিয়ে হাশেমের হাতে তুলে দেয় সুরুজ মিয়া। গত ২০ জানুয়ারি সে বাড়ী থেকে বের হয়ে ২৩ জানুয়ারি সাতক্ষীরা সীমান্তের চোরাপথে অবৈধভাবে ভুটান যাওয়ার জন্য ভারতে প্রবেশ করে। তাকে সহ এভাবে তারা ৭জন সীমান্ত অতিক্রম করে। একপর্যায়ে তারা ভারতীয় পুলিশের হাতে আটক হলে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে ভারতীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
শেরপুর সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী উপজেলার পাহাড়ি জনপদ ডেফলাই, ভালুকা ও গান্ধিগাঁও। প্রত্যন্ত এসব এলাকার বেশীরভাগ মানুষ হতদ্ররিদ্র। সম্প্রতি এক আদম পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে এসব গ্রাম থেকে ৩ জন সহ ৭ বাংলাদেশী ভুটানে চাকুরির প্রলোভনে ভুটান যাওয়ার পথে ভারত সীমান্তে আটক হয়ে কারাগারে বন্দি রয়েছে। ভারতের আটক ওইসব যুবকের পরিবারের সদস্যরা তাদের স্বজনদের জন্য কান্নাকাটি করলেও অবৈধভাবে চোরাই পথে ভারত হয়ে ভুটান যাওয়ার পথে ভারতে আটক হওয়ার কারণে ভয়ে স্থানীয় পুলিশ বা প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধি কাউকেই কিছু জানায়নি।
সরেজমিনে ঝিনাইগাতীর সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর ভারতে আটকদের পরিবারের সদস্য এবং এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ডেফলাই গ্রামের আবুল হাশেম এ আদম পাচার ঘটনর সাথে জড়িত। দীর্ঘদিন সে ঢাকায় গার্মেন্টস চাকুরি করেছে। প্রায় ৬ মাস আগে সে গ্রামে ফিরে এসে স্থানীয় চৌরাস্তা মোড়ে একটি মনোহরি দোকান দেয়। এই দোকন ব্যবসার আড়ালে সে গ্রামের সহজ সরল যুবকদেরকে ভারত, ভুটান এবং নেপালে গার্মেন্টসে চাকুরি দেওয়ার কথা বলে ৪০/৫০ হাজার করে টাকা নেয়। ইতোমধ্যে ওইসব এলাকার প্রায় ১২ জনকে পাচার করেছে আবুল হাশিম। পাচারকারীদের অনেকেই দুই তিন মাস পরে ভারত এবং ভুটান গিয়ে গ্রামের বাড়ীতে টাকা পাঠানো শুরু করে। এ বিষয়টি গ্রামের অন্যান্য যুবকদের মধ্যেও আগ্রহের সৃষ্টি করে। তারাও ভারত-ভুটান যাওয়ার জন্য আবুল হাশেমের সাথে যোগাযোগ করতে থাকে। একপর্যায়ে গত ১৯ জানুয়ারী ওই আদম পাচারকারী আবুল হাশেম মাত্র ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা বিনিময়ে তার নিজের গ্রামের মৃত জবেদ আলীর ছেলে হাবিবুর রহমান, মোহাম্মদ আলীর ছেলে শাহ আলম এবং ডেফলাই গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে সুরুজ আলীসহ আশপাশ গ্রামের আরো ৪ জনকে ভারত পাচার করে। কিন্তু সেখানে তারা ভারতের পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। বিষয়টি ২৫ জানুয়ারী প্রথমে ভারতের কারাগার থেকে স্থানীয় জেল পুলিশের সহায়তায় আটককৃতদের একজনের পরিবারের মোবাইলে জানানো হয়। আটকের খবর পেয়ে স্বজনরা আবুল হাশেমের কাছে ছুটে গেলে তিনি তাদের ছাড়িয়ে আনার আশ্বাস দেন। এদিকে বিষয়টি গ্রামের বিভিন্ন জনের মাধ্যমে জানাজানি শুরু হলে গত ২৯ জানুয়ারী থেকে ওই পাচারকারী আবুল হাশেম গা-ঢাকা দেয়।
ভালুকা গ্রামের প্রতিবেশী হায়দার আলী বলেন, দালালের খপ্পরে পড়ে এই দরিদ্র পরিবারের ছেলেরা ভুটানে কামের জইন্য যাওয়ার পথে ভারতে আটকা খাইছে। সবাই সুদের ওপর ট্যাহা নিয়া দালালেরে দিছে। পরিবারগুলো খুবই হতদরিদ্র। একন ভারতের জেল থাইক্কা ওগরে ছাড়াই আনার কোনো সামর্থ নাই। সরকার যদি এই ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিতো তাইলে ছেলেগুলো ছাড়া পাইতো আর ওগরে জীবনটাও বাঁচতো। ডেলাই গ্রামের সুরুজের মা ছোরাইয়া বেগম এবং গান্ধিগাঁও গ্রামের হাবিবুরের মা হামিদা বেগম কাঁদতে কাঁদতে জানান, সরকারের নিকট সাহায্য চাই। আমরা গরীব মানুষ, ট্যাহা পইসা নাই। আমগরে পোলারে মুক্তি কইরা আমগরে বুহে যেন ফিরাই দেয়। সরকারের কাছে এই সাহায্য আমরা চাই। ওই দালালেরও বিচার চাই।
এদিকে, সোমবার দুপুরে ঝিনাইগাতীর ডেফলাই গ্রামে আবুল হাশেমের বাড়ীতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। এছাড়া তার স্ত্রীও গা-ঢাকা দিয়েছে। বাড়ীতে তার এক বোন এবং বোনজামাইকে পাওয়া গেলেও তারা এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে রাজী হননি। ডেফলাই মোড়ের হাশেমের দোকানটিও বন্ধ দেখা যায়। তবে তার মোবাইল ফোনে কথা বললে তিনি জানান, ‘আমি ঢাকায় আছি। চাকুরির নাম করে আমি কাউকে ভারত-ভুটান পাচার করিনি।’
ঝিনাইগাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফসিহুর রহমানের নিকট এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের কাছে ভুক্তভোগীরা লিখিতভাবে কোন অভিযোগ করেনি। তবুও বিষয়টি আমরা লোকমুখে শুনেই আবুল হাশেমকে ধরার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু সে আগেই গা-ঢাকা দিয়েছে। লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ঝিাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক জানান, লিখিত কোন অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।