‘বিরোধী দলকে ধ্বংস করে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়’ -অলি
২০ দলীয় জোটের শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বীর বিক্রম বলেছেন, বিরোধী দলকে ধ্বংস করে কখনো গণতন্ত্র সুসংহত কিংবা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। যে যখনই সরকারে থাকে তার উচিত হবে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বিরোধী দলকে আস্থায় নেওয়া। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সুসংহত করা এবং উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড এগিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনি বলেন, ২০ দলের পক্ষ থেকে বার বার সরকারকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রতিনিয়ত আহ্বান জানানো হচ্ছে। রাগঢাক না করে হারজিতের চিন্তা না করে দেশের কথা ভেবে সরকারের উচিত হবে অনতিবিলম্বে ২০ দলের নেত্রীর সাথে বসে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি পন্থা বের করা। যত দ্রুত সম্ভব সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্র্রহণ নিশ্চিত করে জাতীয় সংসদের নির্বাচনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
রাজধানীর মহাখালীর নিউ ডিওএইচএস-এর পার্ক রোডের ১০২ নম্বর বাসায় গত বুধবার বিকেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ সব কথা বলেন অলি আহমেদ। সাক্ষাৎকারের চৌম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল :
দেশে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে। কীভাবে এ সঙ্কটের উত্তরণ সম্ভব?
মূলত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনের ফলে দেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যা দেশের জনগণ গ্রহণ করেনি। কারণ প্রায় ৯৩-৯৫ ভাগ লোক এই নির্বাচনে ভোটদান থেকে বিরত ছিল। ভোটাররা মনে করে বর্তমান সরকার পরিচালনায় তাদের কোনো অংশগ্রহণ নেই। বর্তমান সরকারের মদতদাতা হিসেবে কাজ করছে গৃহপালিত জাতীয় পার্টি। তারা সরকারেও আছে, বিরোধী দলেও আছে। যখন যা সুবিধা তাই করে। ফলে জনগণ— সুশাসন, ন্যায় বিচার এবং সমান সুযোগ হতে বঞ্চিত। বর্তমানে ২০ দলীয় জোটের নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচির কারণে বিরোধী দলসহ সাধারণ জনগণের উপর নেমে এসেছে নির্যাতন-নিপীড়ন, গুপ্ত হত্যা, গুম এবং হাজার হাজার মিথ্যা মামলা।
গত দেড় মাসে ২০ দলের প্রায় ২০ হাজারের বেশি নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছে। সরকারের বাহিনীর হাতে দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষও হয়রানির শিকার হচ্ছে। তা ছাড়া ২০ দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অঘোষিত অবরুদ্ধ অবস্থায় আছেন। মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তার অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য পাঠানো খাবার পর্যন্ত ভেতরে নিতে দেওয়া হচ্ছে না। সরকারি দলের অনেক বড় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অশোভন ও অনাকাঙ্ক্ষিত বাক্য ব্যবহার করে রাজনীতিকে কলুষিত করছে। বাস্তবতা হল—মানুষ আগুনে পুড়ে মরছে, গুপ্ত হত্যার শিকার হচ্ছে। দেখামাত্র গুলির ভয়ে তারা আতঙ্কে আছে। সর্বোতভাবে বিরোধী দলের রাজনীতি ধ্বংসের পরিকল্পনা নিয়ে সরকার এগিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য। দেশে আজ গণতন্ত্র নেই বললেই চলে। বিরোধী দলকে ধ্বংস করে কখনও গণতন্ত্র সুসংহত বা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
সরকার বলছে ২০ দলের চলমান কর্মসূচি কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলন নয়, এটি জঙ্গীবাদ বা সন্ত্রাসী আন্দোলন। তাই বিএনপি জোটের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়। ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী।
দেশকে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা থেকে বের করে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাতে বিএনপির জম্ম হয়েছিল। আমার জানামতে বিএনপি কখনও অসাংবিধানিক-অনিয়মতান্ত্রিক বা জঙ্গীবাদের সাথে জড়িত ছিল না, বর্তমানেও নেই। সরকারবিরোধী আন্দোলন করার অর্থ জঙ্গীবাদ হতে পারে না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম কখনও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হতে পারে না। বরং যখন দু’টি বৃহৎ দল রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়িত হয়, কিছু কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসী তাদের নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে লিপ্ত হয়।
১৯৭৬ সালে আমি নিজেই সাক্ষী— ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের অনেক সদস্য ভারতে আশ্রয়গ্রহণ করেন। তারা সরাসরি অস্ত্র হাতে নিয়ে ময়মনসিংহ থেকে বি-বাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্ত পর্যন্ত এক ধরনের যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। সীমান্ত এলাকার জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিজেই বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং তৎকালীন বিজেপি (ভারত) সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়েরসাহায্যে এই ধরনের হামলাগুলো বন্ধের ব্যবস্থা নেন। ধীরে ধীরে তারা (আওয়ামী লীগ নেতারা) দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং এটা আমাদের জানা ছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমান তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা বা প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। বরং সুনাগরিক হিসেবে দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিশ্বাস করি বঙ্গবন্ধুর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতীতের সকল ভেদাভেদ ভুলে দেশের উন্নয়ন ও সঠিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আলাপ আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।
চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে জাতিসংঘ মহাসচিব দুই নেত্রীকে চিঠি দিয়েছেন। সহকারী মহাসচিব তারানকো খালেদা জিয়াকে ফোন করেছেন এবং ইইউ প্রতিনিধি দল ঢাকা সফরে করেছেন। এ সব কী আপনাদের কূটনৈতিক সফলতা বলে মনে করেন?
সফলতা বা লাভ লোকসানের চিন্তা করছি না। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি দেশকে এগিয়ে নিতে দেশের জনগণকে বর্তমান অসহনীয় পরিবেশ থেকে মুক্ত করতে হবে। প্রত্যের রাজনৈতিক দলকে খোলা মনে এগিয়ে আসতে হবে। বাক্য বিনিময়ে সীমাবদ্ধ না থেকে সমাধানের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্তমানে কী সমস্যা তা সবারই জানা। কেউ স্বীকার করছে আবার কেউ স্বীকার করছে না। এটাই জাতির দুর্ভাগ্য। মিথ্যা দিয়ে আমরা সত্যকে ঢাকতে চাই। মনে করি দেশের জনগণ বোকা। অন্যদিকে জনগণ মনে করে রাজনৈতিক নেতারা লোভী-দুর্নীতিবাজ ও বোকা। বর্তমানে পৃথিবীর কোনো দেশ স্বাধীন নেই। প্রত্যেক দেশ একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল। আমাদের সকলকে এ বাস্তবতা মেনেই পদক্ষেপ নিতে হবে।
চলমান আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়েছে কি না?
আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়েনি। যারা বলছে তারা আসলে আন্দোলনের তীব্রতা বুঝতে পারছেন না। বা বুঝতে পারলেও স্বীকার করছেন না। বাস্তবতা হল— ঢাকা শহর সমস্ত দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। সুতরাং যারা এসব বলছে তা সঠিক নয়। আন্দোলন চলছে— জনগণের ন্যায্য দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।