ঘরে-বাইরে চাপ সামলাতে ব্যস্ত সরকার
বাংলাদেশে চলমান অস্থিরতা এবং সহিংসতা নিয়ে ঘরে-বাইরে ভীষণ চাপে সরকার। এই চাপ সামলাতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বর্তমান পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং বিএনপি ও জামায়াত জোট বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করছে— বিষয়টি এমনভাবেই বিদেশীদের বোঝাতে নিরন্তর পরিশ্রম করে যাচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
গত ২০১৪ সালের পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে বর্তমানে উদ্ভূত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ সারাবিশ্ব সরকার এবং সবগুলো রাজনৈতিক দলকে আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে বিদেশীরা সকলকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছে।
এদিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের লাগাতার অবরোধ চলছে। মাঝেমধ্যেই হরতাল দেওয়া হচ্ছে। এতে এসএসসি পরীক্ষা ধারাবাহিকভাবে পেছানো হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে ক্ষমতাসীন দলকে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের আহ্বান জানানো অব্যাহত রয়েছে। ক্ষমতাসীন জোট ও ২০ দলীয় জোটের বাইরের রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সংলাপের আহ্বান জানানো হয়েছে। এ সব চাপকেও কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
সরকারের ভাষ্য মতে, সন্ত্রাসীদের (বিএনপি-জামায়াত) সঙ্গে কোনো আলোচনা হয় না। নাশকতা ছাড়লে সংলাপের বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে। যারা সংলাপের কথা বলছেন, পক্ষান্তরে তারা সহিংসতার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন।
এ সব কথা বলে সংলাপের পক্ষাবলম্বনকারীদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে সরকার।
আন্তর্জাতিক চাপ প্রসঙ্গে সরকার অবস্থান ব্যাখ্যা করছে অন্যভাবে। সরকারের ভাষ্য মতে, আন্তর্জাতিক কোনো চাপে নেই সরকার। কেননা, জাতিসংঘসহ সারাবিশ্ব বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের পক্ষে থেকে সহিংসতা দমনে এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করার আহ্বান জানিয়েছে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘আমরা কোনো প্রকার আন্তর্জাতিক চাপে নেই। সারাবিশ্ব বর্তমান সরকারের পক্ষে মত দিয়েছে।’
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক চাপ কীভাবে সামলাচ্ছে— পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, বাংলাদেশ কোনো প্রকার আন্তর্জাতিক চাপবোধ করছে না।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে গত সপ্তাহে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির বৈঠকের কথা উল্লেখ করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, সরকারের দায়িত্ব সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার।’ জাতিসংঘের মহাসচিব আরও বলেছেন, ‘প্রয়োজনে তারা সরকারকে সহায়তা করবে।’
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘গত চার দিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। জন কেরি বাংলাদেশ সফর করবেন বলেও জানান। এ ছাড়া জন কেরি রাজনৈতিক চর্চার নামে সহিংস কর্মকাণ্ডের প্রতি নিন্দা জানান।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য বিএনপি-জামায়াত জোট দায়ী এবং পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, এই বার্তাটি বিশ্বকে বোঝাতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে চলমান সহিংসতা নিয়ে সরকারের পক্ষে একাধিক তথ্যচিত্র (ভিডিও ডকুমেন্টারি) নির্মাণ এবং প্রকাশনা বের করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ওই তথ্যচিত্র এবং প্রকাশনা বিভিন্ন মিশন, দূতাবাস, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হচ্ছে।
এই বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
‘রক্তাক্ত বাংলাদেশ (Blood Stained Bangladesh.)’ শীর্ষক তথ্যচিত্র ও প্রকাশনাগুলোতে বলা হচ্ছে, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে বিএনপি-জামায়াত জোট বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করছে। খালেদা জিয়ার নির্দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, মসজিদ-মন্দিরে হামলা, জাতীয় পতাকা ও কোরআন শরীফে আগুন, পুলিশ পিটিয়ে হত্যা, হরতালের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিনা কারণে কোপানো, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলা, গাড়িতে আগুন ও নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে।
ওই ভিডিওচিত্র ও প্রকাশনায় আরও বলা হয়েছে, বিএনপি-জামায়াত জোট আন্দোলন ও হরতালের নামে সারাদেশে সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে। বিএনপির তথাকথিত তত্ত্বাবধায়কের আন্দোলন রূপ নিয়েছে বোমা মারার উৎসবে।
এই ভিডিওচিত্র ও প্রকাশনাগুলো সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশীদের কাছে প্রচার করা হচ্ছে। প্রচারের এই কাজ করতে ব্যস্ত সময় যাচ্ছে কর্মকর্তাদের। সর্বশেষ বাংলাদেশ সফরে আসা ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদেরও এই ভিডিওচিত্র এবং প্রকাশনা দেখানো হয়।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে স্বপ্রণোদিত হয়ে বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতার ভিডিও ও তথ্যচিত্র সফররত ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদের দেখানো হয়েছে।’
এদিকে, সহিংসতা বন্ধ, স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এবং মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গত সপ্তাহে চিঠি দেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বান কি মুনের চিঠির জবাব প্রস্তুত করতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে কর্মকর্তারা। বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু পুরো পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, জাতিসংঘ মহাসচিবকে এই বার্তা দিয়ে আশ্বস্ত করতে চায় সরকার।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘বিস্তারিতভাবে চিঠির জবাব দেওয়া হবে। সেই প্রস্তুতি চলছে।’
সর্বশেষ ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বাংলাদেশ সফর শেষে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে গণমাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে জানায়, ‘বাংলাদেশে আমরা মানবাধিকার পরিস্থিতি দেখতে এসেছি। বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে হবে। রাজনৈতিক সঙ্কট দূর করতে হবে। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে কখনই শান্তি এবং স্থিতিশীলতা আসবে না। বহুদলীয় এবং গতিশীল গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হচ্ছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সকলেই বলছে, রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান করতে হবে।’
এর আগে রাজনৈতিক সঙ্কট মেটাতে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ সারাবিশ্ব বাংলাদেশের সবগুলো রাজনৈতিক দলকে সংলাপে বসার আহ্বান জানায়। তবে প্রতিবারই সরকারের পক্ষ থেকে সংলাপ প্রত্যাখ্যানের কথা বলা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমদ বলেন, ‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ছাড়া আর কোনো বৈশ্বিক বড় নেতা বাংলাদেশ সফরে আসেননি। এখন পর্যন্ত উল্লেখ করার মতো বড় কোনো বিদেশী বিনিয়োগ হয়নি। এ থেকেই বোঝা যায়, সরকার আন্তর্জাতিকভাবে কী রকম চাপে রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এই চাপ আরও বাড়বে।’
তিনি আরও বলেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে সরকারকে একটি অবস্থানে আসতে হবে। কেননা, দেশে এবং দেশের বাইরে সর্বত্র এই নির্বাচন সমালোচিত হয়েছে। বিদেশীরা সকলেই বলেছে, সংবিধান অনুযায়ী ওই নির্বাচন হলেও তা ক্রুটিপূর্ণ। তাই সরকারকেই পথ বের করতে হবে। যখনই নির্বাচন হোক না কেন, তা কীভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে, তা সরকারকে পরিষ্কারভাবে জানাতে হবে।’
সূত্র: দ্যা রিপোর্ট