মান্নার ফোনালাপ প্রকাশে সুশীল সমাজের চাপমুক্ত সরকার
চলমান পরিস্থিতিতে নিজেদের চাপমুক্ত ভাবতে শুরু করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন, নাগরিক সমাজের সংলাপের চাপ ও আন্তর্জাতিক মহলের চাপ সব কিছুকেই এখন নিজেদের অনুকূলে মনে করছে সরকারি মহল।
বিশেষ করে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার ফোনালাপ প্রকাশের পর নাগরিক সমাজের সংলাপের চাপে ভাটা পড়বে এবং বিভিন্ন ফোরামে সরকারের সমালোচনা করার প্রবণতা কমবে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ কয়েকজন নেতা।
এ ফোনালাপ প্রকাশের পর নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে আটক করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে তার পরিবার। ডিবি পরিচয়ে মঙ্গলবার ভোরে ভাতিজি শাহনামা শারমিনের বনানীর বাসা থেকে মান্নাকে আটক করা হয়েছে বলে দাবি করেন তার স্ত্রী মেহের নিগার। এদিকে মান্নাকে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম।
অবশেষে রাত সাড়ে ১২টার দিকে র্যাবের একটি প্রতিনিধি দল মান্নাকে গুলশান থানায় হস্তান্তর করেছে। র্যাবের দাবি, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীতে অভিযান চালিয়ে মান্নাকে আটক করেছে তারা। তবে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মান্না কোথায় ছিলেন বা তাকে ডিবি পরিচয়ে কারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর দুইজন নেতা মনে করেন, মাহমুদুর রহমানের ফোনালাপ প্রকাশের পর সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বেকায়দায় পড়েছেন। এর ফলে টকশোগুলো ও টকশোর আলোচকরাও অনেকটা লাগাম টানবেন। সমালোচকদের মুখও বন্ধ হবে। সংলাপ বা সমঝোতা প্রসঙ্গে যারা আগ বাড়িয়ে কথা বলত এখন তারা আর বিষয়টি সামনে আনবেন না।
ক্ষমতাসীনদের দাবি— সংলাপ উদ্যোক্তারা নাশকতার সমর্থক- সেটিও জনগণ সত্য মনে করতে শুরু করেছে। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বার বার বলে আসছিলেন— সুশীল সমাজের লোকজন ক্ষমতালিপ্সু তাও সত্যি প্রমাণিত হল। এ ছাড়া মাহমুদুর রহমান মান্না ও বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার ফোনালাপের মধ্য দিয়ে সংলাপ ইস্যুতে সৃষ্ট জনমত সুশীল সমাজের বাইরে চলে গেছে।
তবে নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, ‘মান্নার ফোনালাপ প্রকাশের মাধ্যমে আমাদের উদ্যোগ ভেস্তে গেছে এটি ভাবার কোনো অবকাশ নেই। কারণ মান্না একটি রাজনৈতিক দলের নেতা। নাগরিক সমাজ সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত।’
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের এ উদ্যোগ আশার আলো দেখবেই।’
শামসুল হুদা জানান, নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করতে প্রশাসনিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কার প্রয়োজন। শিগগিরই সংবাদ সম্মেলন করে তারা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দাবি করবেন। তবে তার আগে তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবেন।
এ দিকে আওয়ামী লীগ বলছে, নাগরিক সমাজের উদ্যোগ একটি ষড়যন্ত্রের অংশ মান্নার ফোনালাপের মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘নাগরিক সমাজের উদ্যোগ গ্রহণের পরে আওয়ামী লীগ একটি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। মান্নার ফোনালাপের ভেতর দিয়ে সরকারের আশঙ্কার প্রতিফলন ঘটতে শুরু করেছে।’
দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, ‘সরকারের বিরুদ্ধে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র চলছে। মান্নার ফোনালাপের ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে এর সত্যতা মিলতে শুরু করেছে। তবে যতই ষড়যন্ত্র আসুক না কেন দল ও সরকার ঐক্যবদ্ধভাবে তা মোকাবিলা করে এগিয়ে যাবেই।’
আওয়ামী লীগের শীর্ষ সারি ও মধ্যম সারির চারজন নেতা মনে করেন, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধ-হরতালের পরিস্থিতিকে সরকার যেমন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে তেমনি নাগরিক সমাজের সংলাপের উদ্যোগ ও উদ্যোক্তাদের চাপে রাখতে সক্ষম হয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে সরকারের গভীর পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে।
তারা জানান, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধ-হরতাল ঢিলেঢালা হয়ে আসার পর, বিদেশী কূটনীতিকদের সমানতালে সামাল দিলেও নাগরিক সমাজের সংলাপের উদ্যোগ সরকারকে কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘খোকা-মান্নার কথোপকথনে নাশকতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র স্পষ্ট। তারা দু’জন যে এ জন্য আগে থেকেই কাজ করছেন তাও পরিষ্কার। আর মান্নার নাগরিক ঐক্য যে বিএনপির আরেকটি ফ্রন্ট হয়ে কাজ করছে তাও পরিষ্কার হয়েছে।’
আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, আওয়ামী লীগ ও সরকারের কাছে তথ্য ছিল নাগরিক সমাজের অনেকেরই বিএনপির সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ হয়েছে। সর্বশেষ মান্না-খোকার ফোনালাপে তার প্রমাণ জনসমক্ষে চলে আসায় তারা স্বস্তিবোধ করছেন।
নাগরিক সমাজের সংলাপ উদ্যোগের পরপরই আওয়ামী লীগ প্রশ্ন তোলে- নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন কীভাবে দলের প্রধান হয়ে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন? ক্ষমতাসীনদের এমন সমালোচনার মুখে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নাগরিক সমাজ থেকে ওই দুইজনকে বাদ দেওয়া হয়।
পরে নাগরিক সমাজ জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে একসঙ্গে সহিংসতা বন্ধ ও সংলাপ শুরুর আহ্বান জানান। কৌশলগত কারণেই আওয়ামী লীগ সঙ্গে সঙ্গে তা নাকচ করে, সমালোচনায় মুখর হয়।
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও বলেন, ‘যদি সরকার বা বিএনপি কোনো পরামর্শ চাইতে আসে— তা হলে সংকট নিরসনে তাদের পরামর্শ দেওয়া হবে।’
আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, মান্নার ফোনালাপের জের ধরে আওয়ামীবিরোধী সুশীল অংশটিকে চাপে রাখার সুযোগটিকে হাতছাড়া করতে মোটেও রাজি নয় শাসক জোট। তার ফোনালাপের বিস্তারিত গোয়েন্দাদের হাতে রয়েছে। বিভিন্ন টেলিভিশনে মান্নার টকশো সহযোগীসহ বিএনপির বাইরে মান্নার রাজনৈতিক মিত্রদের বিষয়েও সরকার খোঁজ নিচ্ছে। এ মুহূর্তে সরকারের কৌশল হচ্ছে যে কোনো মূল্যে পরিস্থিতি অনুকূলে নিয়ে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান জানান দেওয়া।