মিরপুরে কথিত ‘গণধোলাই’য়ে নিহত তিন ‘যুবলীগ নেতার অফিসে নির্যাতনের পর গুলি’
রবিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকের ঘটনা। একটি পিকআপ ভ্যানে করে মিরপুর কাজীপাড়ায় এক যুবলীগ নেতার অফিসে তিন যুবককে নিয়ে আসা হয়। সেখানে তাদের মারধর করা হয়। এর কিছুক্ষণ পর একটি সাদা মাইক্রোবাস আসে। ওই গাড়িতে করে তিন যুবককে হাত-পা বেঁধে কৃষিবিদ মার্কেটের পশ্চিম দিকের বাঁশবাড়ী গলিতে নিয়ে আসা হয়। এরপর কয়েকজন গুলি করে তাদের হত্যা করে।
মিরপুরে কথিত ‘গণধোলাই’য়ে তিন যুবক নিহত হওয়ার ঘটনার এ রকমই বর্ণনা দেন স্থানীয়রা। মঙ্গলবার দুপুরে ঘটনাস্থলে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় অধিবাসী জানান, ঘটনার দিন রাতে ওই গলিতে কোনো গণধোলাইয়ের ঘটনা ঘটেনি। ওই তিনজনকে একের পর এক গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
কথিত গণধোলাইয়ে নিহত তিন যুবকের মধ্যে সুমন দাস ও রবিনের পরিচয় পাওয়া গেলেও অপরজনের পরিচয় এখনো মেলেনি। সুমন ও রবিন দুজনেই বাসের হেলপার বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তারা কোনো ধরনের নাশকতার সঙ্গে জড়িত নয় বলেও দাবি পরিবারের। পরিচয় পাওয়া দুইজনের বয়স ১৩ বছর থেকে ১৫ বছর হবে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
সুমন দাসের বাবা জনী দাস দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমরা হিন্দু মানুষ। আমার ছেলের বয়স ১৩/১৪ হবে। সে কোনো রাজনীতি করত না। বাসের হেলপারি করত। কোনো ধরনের অপরাধের সঙ্গে সে যুক্ত ছিল না। এমনকি তার নামে থানায় কোনো মামলা বা জিডি নেই। তাকে অন্যায়ভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।’
রবিনের দাদা (পিতামহ) মো. বিপ্লব আলম বলেন, ‘রবিন প্রজাপতি পরিবহনের হেলপার। ঘটনার দিন রাতে বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকেই তার কোনো খোঁজ পাচ্ছিলাম না। এরপর জানতে পারলাম তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, সে বোমাবাজ। কিন্তু সে এই ধরনের কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল না।’
পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের নিরপরাধ দাবি করা হলেও পুলিশ বলছে, নিহত তিন যুবক বোমাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা গলধোলাইয়েই নিহত হয়েছে। গণধোলাইয়ের সময় তিন যুবককে কারা গুলি করেছে এ বিষয়ে পুলিশ কোনো তথ্য দিতে পারেনি। মিরপুর থানায় এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, থানায় দু’টি মামলা হয়েছে।
ঘটনাস্থলে কথা হয় জাকির হোসেন নামে একজন স্থানীয় অধিবাসীর সঙ্গে। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘রাতে কিছু মানুষের বাঁচার আকুতি শুনেছি। এরপর একের পর এক গুলির শব্দও শুনেছি। ওই সময় ভয়ে আমরা কেউ আর বাইরে যাইনি।’
তিনি বলেন, ‘রাত সাড়ে ১১টার ঘটনা। ভাত খেয়ে বসেছি। টিভি চলছিল। এমন সময় গুলির শব্দ। অন্তত ৫০টি গুলির শব্দ শুনেছি। চিৎকার ও আহাজারিও শুনেছি। এরপরই পুরো এলাকায় নিস্তব্ধতা নেমে আসে।’
স্থানীয় অধিবাসী প্রত্যক্ষদর্শী সালমা বেগম বলেন, ‘তিনজনকে হাত ও চোখ বেঁধে গলি দিয়ে নিয়ে আসা হয়। এরপর একটি গাড়িতে পুলিশের একটি দল এসে দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর ৫/৬ যুবক একটি সাদা মাইক্রোবাস থেকে নেমে গালি দিয়ে গুলি শুরু করে।’
স্থানীয় এক ওষুধ ব্যবসায়ী বলেন, ‘অসংখ্য গুলির শব্দ শুনেছি। তবে কি হয়েছে জানার চেষ্টা না করে ভয়ে দোকান বন্ধ করে বাসায় চলে গেছি।’
তিনি বলেন, ‘কোন ধরনের গণধোলাইয়ের ঘটনা ঘটেনি। যুবলীগ অফিসে নির্যাতনের পর তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।’
তবে মিরপুর থানা পুলিশ ও যুবলীগ এই ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিন বলেন, ‘কারা গুলি করেছে এ বিষয়ে এখনো আমরা কিছু জানতে পারিনি। মামলা হয়েছে, বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি।’
যুবলীগ অফিসে নিয়ে গিয়ে মারধরের পর তাদের হত্যা করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা দাবি করেছে। এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমন কিছু আমার জানা নেই। আপনারা সবসময় দেখি অপরাধীদের পক্ষে কাজ করেন। যারা মারা গেছে তারা অপরাধী কিনা এই বিষয় নিয়ে কাজ করেন। কারা গুলি করেছে এটি বিবেচ্য বিষয় নয়।’
ঢাকা মহানগর যুবলীগ (উত্তর) সভাপতি মাঈনুল হোসেন খান নিখিল বলেন, ‘ওইখানেতো যুবলীগের কোনো অফিস নেই। কারো ব্যক্তিগত অফিস থাকতে পারে। আর যুবলীগের অফিসে নিয়ে যাওয়ারতো প্রশ্নই আসে না।’
গুলিতে ক্ষত-বিক্ষত কথিত গণধোলাইয়ে নিহত তিন যুবকের শরীর
তিন নাশকতাকারীকে স্থানীয় জনতা গণধোলাই দিয়ে হত্যা করেছে বলে পুলিশ দাবি করলেও তিন যুবকের শরীর গুলিতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে।
পুলিশের তৈরি করা সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, সুমন দাসের বাম হাতের কব্জির উপরে চারটি গুলির চিহ্ন, বুকের মধ্যে আটটি গুলির চিহ্ন, পেটে একটি গুলির চিহ্ন, পিঠে নয়টি গুলির চিহ্ন রয়েছে। অর্থাৎ সুমন দাসের শরীরে মোট ২১টি গুলি লেগেছে।
রবিনের মুখের বাম পাশে থুতনিতে একটি গুলির চিহ্ন, ডান হাতের কব্জির উপরে আটটি গুলির চিহ্ন, হাতের ডানায় একটি গুলির চিহ্ন, বাম কাঁধে দুইটি গুলির চিহ্ন ও বুকে চারটি গুলির চিহ্ন রয়েছে। অর্থাৎ রবিনের শরীরে ১৬টি গুলি লেগেছে।
অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের বাম হাতের কব্জিতে চারটি গুলির চিহ্ন, বুকে আটটি গুলির চিহ্ন, পেটে একটি গুলির চিহ্ন ও পিঠে নয়টি গুলির চিহ্ন রয়েছে। অর্থাৎ ২২টি গুলি লেগেছে ওই যুবকের শরীরে।
টেকনিক্যালে বন্দুকযুদ্ধ নিয়েও পরিবারের ভিন্ন মত
রবিবার রাতেই মিরপুরের টেকনিক্যাল ব্রিজের নিচ থেকে ওয়াদুদ নামে এক ব্যক্তি বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করেছে। এই ঘটনাটিও মিরপুর থানা এলাকায়। তবে পরিবার এই বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে ভিন্ন কথা বলছে। তাদের দাবি, ওয়াদুদকে পুলিশ পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।
পুলিশ জানায়, নিহত ওয়াদুদ মিরপুর ১০ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিকদলের সভাপতি। রবিববার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাসে ককটেল হামলার ঘটনায় তাকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ।
মিরপুর থানার ওসি সালাউদ্দিন বলেন, ‘রবিবার সকালে ওয়াদুদকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে সে স্বীকার করে মিরপুর থানা শ্রমিক দলের সভাপতি পারভেজ ও রুবেল নামে একজনের নির্দেশে বাসে ককটেল হামলা চালিয়েছে।’
পরে ওয়াদুদকে নিয়ে রাতে পারভেজ ও তার সহযোগীদের ধরতে অভিযান চালানো হয়। টেকনিক্যাল মোড় কল্যাণপুর হাউজিংয়ের কাছে গেলে ওয়াদুদের সহযোগীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। পরে তারা পালিয়ে গেলেও ঘটনাস্থল থেকে ওয়াদুদের গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
ওয়াদুদের চাচা চাঁন মিয়ার অভিযোগ, তার ভাতিজা কোনো দলের সঙ্গে জড়িত ছিল না। তাকে পুলিশ পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।
তিনি বলেন, ‘ওয়াদুদকে পুলিশ ধরে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। সে কোনো বোমবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত না।’
ওয়াদুদের শরীরে ৬ গুলি
কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত ওয়াদুদের শরীরে ৬টি গুলির চিহ্ন রয়েছে বলে পুলিশের করা সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এরমধ্যে বুকের ডান পাশে দুইটি গুলির চিহ্ন, বাম পাজরে একটি গুলির চিহ্ন, পিঠের ডান পাশে দুইটি গুলির চিহ্ন ও পিঠের পেছনে বাম পাশে একটি গুলির চিহ্ন রয়েছে।