অভিজিৎ হত্যার ২৪ ঘণ্টা পরও তদন্তে অগ্রগতি নেই নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেই হত্যা করে পালায় খুনীরা

Avijit-Royপুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেই ‘মুক্তমনা’ ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কে হত্যা করে পালিয়ে যায় দুই খুনী। হত্যার দুই ঘণ্টা পর দায় স্বীকার করে আনসার বাংলা সেভেন নামে একটি টুইটার এ্যাকাউন্ট থেকে পোস্টও দেওয়া হয়েছে। অথচ হত্যার ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও তদন্তে কার্যত কোনো অগ্রগতি হয়নি।‘একুশে গ্রন্থমেলা’ উপলক্ষে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশ ও র‌্যাবের পক্ষ থেকে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শুধু পোশাকধারী সদস্যরাই নন, সাদা পোশাকধারীরাও দায়িত্বে ছিলেন। এমনকি বইমেলা উপলক্ষে ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই টিএসসি মোড়ে ব্যারিকেড দিয়ে নিরাপত্তা দিচ্ছে পুলিশ।
টিএসসি মোড়ে পুলিশি ব্যারিকেডের কয়েক গজ দূরেই বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ৯টার দিকে মোটরসাইকেলে চড়ে দুই আরোহী প্রকাশ্যে অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে। আহত করে তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটির সুযোগ নিয়েছে খুনীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এম আমজাদ আলী বলেন, ‘খুনীরা অভিজিৎকে টার্গেটে পরিণত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি থাকে না এমন স্থানকে বেছে নিয়েছে।’
ঘটনাস্থল টিএসসি মোড় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনবহুল স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। শাহবাগ থানা থেকেও টিএসসি মোড়ের দূরত্ব ২৫-৩০ গজ। এর পরও খুনীরা প্রকাশ্যে খুন করল কীভাবে, আর খুন করে পালিয়েই গেল কীভাবে- এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে প্রকাশ্যে খুনের ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও এখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে কোনো তথ্য নেই কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। যদিও তারা প্রথম থেকেই বলে আসছে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে তাদের ধারণা। কিন্তু নিশ্চিত করে এখনো কিছুই বলতে পারছে না তারা।
এর আগে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদকে বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর একই ভাবে আঘাত করা হয়েছিল। এর পর তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। একই ভাবে ব্লগার রাজীবকে ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজধানীর পল্লবীতে নিজ বাসার সামনে হত্যা করা হয়েছিল। দুটি ঘটনায়ই জঙ্গিরা জড়িত বলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে এসে শুক্রবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় বলেন, ‘গোয়েন্দা পুলিশ এ মামলার (অভিজিৎ হত্যা) তদন্ত করবে। ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকা পুলিশ সদস্যদের গাফিলতি ছিল কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ হত্যার পেছনে কারা আছে তাও তদন্ত করে বের করা হবে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা জোনের সহকারী কমিশনার শিবলী নোমান বলেন, ‘আনসার বাংলা সেভেন নামে একটি গ্রুপ এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে। এটিকে তারা নিজেদের বিজয় উল্লেখ করে পোস্ট দিয়েছে। আমরা বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছি।’
তিনি বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে, প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী অভিজিতের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ এই হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন ও খুনীদের ধরতে মাঠে নেমেছে। র‌্যাবও কাজ করছে।’
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার উপ-পরিচালক রুম্মান মাহমুদ বলেন, ‘ব্লগার অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা কাজ করে যাচ্ছে। আশা করছি, খুব শিগগিরই এ হত্যার রহস্য উন্মোচিত হবে।’
আনসার বাংলা সেভেনের দায় স্বীকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সব ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই করে র‌্যাব তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।’ovijit-inner
এদিকে ব্লগার এবং অভিজিতের পরিবারের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে, কুপিয়ে হত্যার ঘটনা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীরই কাজ। প্রগতিশীল লেখালেখির কারণে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তার ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। এর জের ধরেই তাকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে তাদের দাবি।
ঘটনাস্থলের কাছে থাকা একটি ভ্রাম্যমাণ দোকানের মালিক ও হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী দ্য রিপোর্টকে বলেন, অল্প বয়সী দুই ব্যক্তি এসে পেছন থেকে অভিজিৎ ও তার স্ত্রীকে আক্রমণ করে। চাপাতি দিয়ে তাদের মাথায় আঘাত করা হয়। হত্যাকারীদের কাধে একটি স্কুলব্যাগ ছিল।
অভিজিতের পরিবারের বরাত দিয়ে কয়েকজন ব্লগার জানিয়েছে, এর আগে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী একাধিকবার তাকে হুমকি দিয়েছিল।
অভিজিৎ মূলত বিবর্তন নিয়ে কাজ করতেন। তিনি ভয় পেতেন না ও একাকী চলাচল করতেন বলেও জানিয়েছেন তারা।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের দফতর সম্পাদক নাসির উদ্দিন প্রিন্স বলেন, ‘অভিজিৎ প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনা করতেন। মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লেখালেখি করতেন। হুমায়ুন আজাদ স্যারের মতোই একই ভাবে মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীই তাকে হত্যা করেছে।’
অভিজিতের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অভিজিৎ ও তার স্ত্রী রাফিদা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। ‘একুশে গ্রন্থমেলায়’ অভিজিৎ-এর তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইয়ের প্রকাশনা উপলক্ষে তারা দু’জনই ১৬ ফেব্রুয়ারি দেশে আসেন। ৪ মার্চ তাদের যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার কথা ছিল।
অভিজিতের বাবা অধ্যাপক ড. অজয় রায় জানান, দুই সন্তানের মধ্যে অভিজিৎ বড়। সে বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার পর সিঙ্গাপুরে পড়তে যায়। এর পর যুক্তরাষ্ট্রে যায়। প্রগতিশীল লেখালেখির কারণে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী অভিজিৎকে হত্যা করেছে বলে দাবি করেন তিনি।
অভিজিতের লাশের ময়নাতদন্ত শেষে চিকিৎসক সোহেল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিশেষ করে তার (অভিজিৎ) মাথায় যে তিনটি আঘাত করা হয়েছে, তাতে চামড়া ও হাড় ভেদ করে মগজ পর্যন্ত কেটে গেছে। এ ছাড়া শরীরে জখমের আরও কয়েকটি চিহ্ন আছে। ঘটনার পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।’
সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, অভিজিৎ রায়ের মাথায় (ঘাড়ের উপরে) তিনটি গুরুতর জখম, অন্যপাশে আরও দুটি এবং পিঠে একটি জখমের চিহ্ন রয়েছে।
অভিজিৎ হত্যার ঘটনায় শুক্রবার সকালে শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন তার বাবা ড. অজয় রায়। এতে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামী করা হয়েছে।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend