টানা অবরোধে মার্চের শুরুতে বেড়েছে নাশকতা; আন্দোলনে সক্রিয়তা দাবি বিএনপির, সহিংসতার দায় ‘অস্বীকার’
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের লাগাতার অবরোধে ফেব্রুয়ারি শেষে ও মার্চের শুরুতে বেড়েছে সহিংসতা। রাজধানীসহ সারা দেশে গত তিন-চার দিনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের মাধ্যমে আতংক সৃষ্টির কর্মকাণ্ড বেড়ে গেছে। চলমান আন্দোলনে ২০ দলীয় নেতাকর্মীদের সক্রিয়তা বেড়েছে দাবি করলেও সহিংসতার দায় নিতে নারাজ জোটটি। অন্যদিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক দাবি করে হঠাৎ সহিংসতা বেড়ে যাওয়াকে চোরাগুপ্তা হামলা ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করছে সরকার।
পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ২০ দলীয় জোটের চলমান অবরোধে সহিংসতার চিত্র থেকে দেখা যায়, ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অবরোধের ৪৫ দিনে পেট্রোলবোমা ও আগুনে পুড়ে নিহতের সংখ্যা ৫৫ জন, সংঘর্ষে ১৫ জন ও অন্যান্য ২৮ জন এবং ক্রসফায়ারে নিহত ২৩ জনসহ মোট প্রাণ হারিয়েছে ৯৮ জন। একই সময়ে সারা দেশে গাড়ি ভাংচুর ১১৬১টি, ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটে ভর্তি ১৩০ জন। ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে পেট্রোলবোমা ও আগুনে পুড়ে নিহতের সংখ্যা ৫৬ জন ও ক্রসফায়ারে ২৩জনসহ মোট নিহত ৯৯ জন। যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর ১১৬৬টি, বার্ন ইউনিটে ভর্তি ১৩০ জন, রেলে হামলা ১৪ দফা। ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ক্রসফায়ারে নিহত ৩০ জনসহ প্রাণ হারিয়েছে ১০১জন, গাড়ি অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর ১১৭৭টি, রেলে হামলা ১৪ বার, বার্ন ইউনিটে ভর্তি রোগীর মোট সংখ্যা ১৩০ জন। ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেখা যায় পেট্রোল বোমা ও আগুনে পুড়ে ৫৭ জনসহ মোট নিহত ১০২ জন। এর মধ্যে ক্রসফায়ারে নিহত ৩০ জন। গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ ১১৬৯টি। বার্ন ইউনিটে ভর্তি ১৩০। ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিহত ১০৮ এর মধ্যে ক্রসফায়ারে ৩১ জন নিহত হয়। রেলে হামলা ১৪ বার, গাড়ি ভাংচুর ১১৭৪টি, বার্ন ইউনিটে ভর্তি ১৩০। ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিহত ১০৯।
এর মধ্যে ক্রসফায়ারে ৩৬ জন, গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ ১১৮৬, বার্ন ইউনিটে ভর্তি ১৩০ জন। রেলে হামলা ১৪ দফা। ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিহত ১০৯ যার মধ্যে ক্রসফায়ার বা বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড ৩৬ জন, গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ ১১৮৯, বার্ন ইউনিটে ভর্তি ১৩০ জন। রেলে হামলা ১৪ দফা। ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩৬ জন ক্রসফায়ারসহ নিহত ১১০ জন, গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ ১১৯২টি, বার্ন ইউনিটে ভর্তি ১৩০, রেলে হামলা ১৪ বার।
ফেব্রুয়ারির শেষ দিন পর্যন্ত অবরোধের ৫৪তম দিনে এসে ক্রসফায়ারসহ নিহত ১১২ জন, যানবহন ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ ১২০০, বার্ন ইউনিটে ভর্তি ১৩০ ও রেলে হামলা ১৫ বার। ১ মার্চ ৫৬তম দিন পর্যন্ত নিহত ১১৩ জন, যানবাহন ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ ১২৪৩টি, বার্ন ইউনিটে ভর্তি ১৩০ জন ও রেলে হামলা ১৫ দফা। ২ মার্চ রাত (সাড়ে নয়টা পর্যন্ত) প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত রাজধানীসহ সারাদেশের প্রায় দশটি যানবাহন ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া গেছে।
১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চের চিত্র থেকে দেখা যায় ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সহিংসতা কমে এলেও ফেব্রুয়ারির শেষ ও মার্চের শুরুতে সহিংসতার পরিমাণ আবারও বেড়ে গেছে।
এদিকে ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, চলমান আন্দোলনে সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা মাঠে সক্রিয় অবস্থান বজায় রেখেছে। তবে চলমান সহিংসতার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেয়।
এ ব্যাপারে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম বলেন, ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলনে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা সক্রিয়ভাবে মাঠে অবস্থান করছে। চলমান আন্দোলনে জন সম্পৃক্ততা নেয় বা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে এমন দাবি করলেও অবরোধের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র সরকারের পক্ষ থেকেই তুলে ধরা হচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয় আন্দোলন সফল হচ্ছে।’
সহিংসতার মাধ্যমে অবরোধের ক্ষয়ক্ষতি কি আন্দোলনের সফলতার মাপকাঠি এমন প্রশ্নের উত্তরে রুহুল আলম বলেন, ‘সহিংসতা কখনো আন্দোলনের সফলতার মাপকাঠি হতে পারে না। বিএনপি এখনও পর্যন্ত দাবি করছে তারা সহিংসতার সঙ্গে জড়িত নয়। এটা হতে পারে তৃতীয় কোনো পক্ষ অথবা আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দিতে সরকারের কোনো ষড়যন্ত্র। প্রকৃতপক্ষে সরকার সহিংসতা দমনে ব্যর্থ বলেই তাদের ব্যর্থতা বিএনপির সফলতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিএনপি কোনো প্রকার সহিংসতার সঙ্গে জড়িত না।’
সহিংসতা আন্দোলনের সফলতা না হলে কোন মাপকাঠিতে বলা যাবে ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন সফল এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আসলে বিএনপিসহ ২০ দলীয় নেতাকর্মীরা মাঠে না থাকলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যেত। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়াতেই বোঝা যায় আন্দোলন এখনও সচল রয়েছে। আন্দোলনে বিএনপির নেতাকর্মীরা মাঠে রয়েছে।’
সহিংসতার দায় বিএনপির না এমন দাবি করে দলের চেয়ারপারসনের আরেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আহম্মেদ আজম বলেন, ‘২০ দলীয় জোটের টানা ৫৬ দিনের অবরোধে নেতাকর্মীরা ক্লান্ত হয়নি। তারা এখনও মাঠে সক্রিয় অবস্থান করছে। তবে দেশে যে সহিংসতা চলছে তার দায়-দায়িত্ব বিএনপির না।’
আন্দোলনের সফলতার মাঠকাঠি কি এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘অবরোধ চলাকালে বিএনপির ঘোষিত বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের কর্মসূচি ছিল। এমন কর্মসূচিতে সারা দেশের বিএনপি ও জোটের নেতা-কর্মীরা মিছিল এবং সমাবেশ করার চেষ্টা করেছে। ৬৪ জেলার অনেক জায়গাতে তারা মিছিলও করেছে তার চিত্র বিভিন্ন টেলিভিশনে দেখা গেছে। এগুলো নেতা-কর্মীদের সক্রিয় থাকার প্রমাণ। এছাড়া ঢাকা বারসহ দেশের বিভিন্ন আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে বিএনপির প্যানেল বিপুল ব্যবধানে জয়লাভ করছে। এতে বোঝা যায় সর্বস্তরের জনগণ বিএনপির সঙ্গে আছে। তারা সরকারকে প্রত্যাখান করেছে।’
নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, হঠাৎ করে সহিংসতা বেড়ে যাওয়া একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা না করতে পেরে বিএনপি মরণ কামড় দিচ্ছে। আশা করি এটাও আমরা শিগগিরই দমন করতে পারব।