নিজ অফিসেই দুই মাস গ্রেফতারের ‘সন্ধিক্ষণে’ খালেদা
গুলশানে রাজনৈতিক কার্যালয়ে দীর্ঘ দুই মাস পার করলেন ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। কার্যালয়ে থেকেই সরকার পতন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। কর্মসূচি বাস্তবায়নে দলের তৃণমূল নেতাদের নির্দেশনা দিচ্ছেন। এর মধ্যে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও কার্যালয় তল্লাশীর আদেশ আসে আদালত থেকে। এমন অবস্থায় গ্রেফতারের ‘সন্ধিক্ষণে’ খালেদা জিয়া।
পুলিশের পিপার স্প্রে, ছেলের মৃত্যু, বিদ্যুৎ সংযোগ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন, দফায় দফায় সরকার সমর্থক সংগঠনগুলোর ঘেরাও কর্মসূচিসহ সরকারের মন্ত্রী ও এমপিদের হুমকি-ধমকি টলাতে পারেনি তাকে।
কার্যালয়ে ফিরতে না দেওয়ার আশঙ্কায় রাজনৈতিক জীবনে এই প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসেও শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে যাননি খালেদা জিয়া।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার লুৎফুল কবীর বলেন, ‘গুলশান কার্যালয়ে তল্লাশী চালাতে আদালতের আদেশের কপি গুলশান থানায় পৌঁছেছে। গত রবিবার সন্ধ্যার আগেই এ আদেশ থানায় পৌঁছায়।’
গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা রবিবার সন্ধ্যার আগেই তল্লাশী আদেশের কপি পেয়েছি। তবে কখন কীভাবে তল্লাশী হবে এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’
তবে পুলিশের পক্ষ থেকে কার্যালয়ে তল্লাশী বা খালেদা জিয়া গ্রেফতারে প্রসঙ্গে কোনো তৎপরতা মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত দেখা যায়নি।
মঙ্গলবার দুপুরে সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ভবনে নিজ চেম্বারে খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও আদালতে জামিন পাওয়া সাপেক্ষে কার্যালয়ে ফিরে আসার আশ্বাস পেলে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আত্মসমর্পণ করবেন।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের এ উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমরা ওয়ারেন্টের কপি এখনো পাইনি। তার পরও যদি আদালতে যেতে এবং আত্মসমর্পণ করতে হয়, তাহলে তিনি (খালেদা জিয়া) আদালতে যেতে ইচ্ছুক। তবে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও কার্যালয়ে ফিরে আসার আশ্বাস দিতে হবে।’
খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও দলের গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক এ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, ‘বুধবার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আদালতে যাওয়া অনিশ্চিত। কারণ আমারা উনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারিনি। সাক্ষাৎ করারও কোনো পরিবেশ নেই।’
গত ৩ জানুয়ারি (শনিবার) রাত সাড়ে ৮টার দিকে গুলশানের নিজ কার্যালয়ে আসেন খালেদা জিয়া। সেখানে দলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। পরে দলের যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর অসুস্থ হওয়ার খবর জানতে পারেন। তাকে দেখার জন্য নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যেতে চান খালেদা জিয়া। ওই রাতেই সাড়ে ১১টার দিকে খালেদা জিয়া নয়াপল্টনে যেতে চাইলে পুলিশ তার পথ আটকায়। পরে কিছুক্ষণ গাড়িতে অপেক্ষা করে ফের কার্যালয়ের দোতলায় যান তিনি।
এর পর সেখানেই তিনি রাত কাটান। এর পরদিনই কার্যালয়ের মেইন গেটে ঝোলানো হয় তালা, মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ। গুলশানের ৮৬ নম্বর সড়কে বিএনপি নেত্রীর কার্যালয় ঘিরে পুলিশি নিরাপত্তা আরও বাড়ানো হয়। সড়কের দুই মাথায় বসানো হয় দুটি তল্লাশী চৌকি। ওই সড়কে পুলিশ সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। কার্যালয়ের পাশেই বড় আকারের দুটি গাড়ি আড়াআড়িভাবে রেখে বেরোনোর পথও আটকে দেওয়া হয়। র্যাব, পুলিশের সাঁজোয়া যানও প্রস্তুত ছিল। শুরু থেকে কার্যালয়ের বাইরে রাস্তায় মোট ১৩টি বালু ও ইটের ট্রাক দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া হয়।
অফিসে অবস্থানকালে ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ উপলক্ষে গুলশান কার্যালয় থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেন খালেদা জিয়া। মহিলা দলের নেতাকর্মীরা গেট খুলে দেওয়ার দাবিতে স্লোগান দিলে দুই দফা পিপার স্প্রে করে পুলিশ।
পরে খালেদা জিয়া প্রায় ৪৫ মিনিট পর গাড়ি থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন এবং অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক দেন।
১৯ জানুয়ারি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ৭৯তম জন্মবাষির্কীতেও কার্যালয়েই ছিলেন খালেদা জিয়া। জিয়াউর রহমানের সমাধিতে ফুল দিতে গেলে বিএনপির প্রতিনিধি দলকে পুলিশ বাধা দেয়।
২৪ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা যান। শোক জানাতে গুলশান কার্যালয়ে এসে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে ওই দিন সকালে ৩৬ ঘণ্টার হরতার আহ্বান করে ২০ দল।
২৫, ২৬, ২৭, ২৮ জানুয়ারি কোকোর মৃত্যুতে শোক জানাতে আসেন সমাজের বিশিষ্টজন, ব্যবসায়ী নেতাসহ কূটনীতিকরা। ২৯ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন দলের সিনিয়র নেতারা।
৩০ জানুয়ারি ঘোষণা করা হয় ১ ফেব্রুয়ারি থেকে টানা ৭২ ঘণ্টার হরতাল। ওই দিন রাত ২টা ৪২ মিনিটে তার অফিসের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।
একে একে বিচ্ছিন্ন করা হয় ডিশলাইন, ইন্টারনেট ও টেলিফোন সংযোগ। তার পর কয়েকটি মোবাইল কোম্পানির সিমের নেটওয়ার্কও বন্ধ করা হয় তার অফিস ও সংলগ্ন এলাকা থেকে। ৩১ জানুয়ারি রাত ৮টা ১০ মিনিট থেকে ৯টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত মোমবাতির আলোয় নিজ অফিসে প্রথমবারের মতো বাইরের অতিথিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন খালেদা জিয়া। প্রায় ২০ ঘণ্টা পর শনিবার রাতেই বিদ্যুৎ সংযোগ পুনরায় স্থাপন করা হয়।
২ ফেব্রুয়ারি থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও অবরোধের পাশাপাশি হরতালের কারণে তা স্থগিত করে শুক্র ও শনিবার পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। পরীক্ষার সময় হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহারের দাবিতে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের সামনে ও আশপাশের সড়কে বেশ কিছুদিন ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক ও অভিভাবকদের ব্যানারে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়।
৩ ফেব্রুয়ারি খালেদার জিয়ার কার্যালয় ঘেরাওয়ের চেষ্টা করে মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ। ওই দিন মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগের কর্মী পরিচয়ে মফিদুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি একটি পিস্তল হাতে নিয়ে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে যান।
১০ ফেব্রুয়ারি দুপুরে পুলিশ ও গোয়েন্দা সদস্যদের উপস্থিতিতে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে ঢিল ছোড়েন পরান সরকার নামে এক যুবক।
১১ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার অফিস স্টাফদের খাবার ফিরিয়ে দেয় পুলিশ। ওই দিন বিকেলে খালেদা জিয়ার সঙ্গে ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন বৈঠক করেন।
২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে যাননি খালেদা জিয়া। নিজ কার্যালয়ে ভাষা শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় মিলাদ ও বিশেষ মোনাজাত আয়োজন করা হয়। এতে অংশ নেন খালেদা জিয়া।
২৫ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এর পাঁচ দিনের মাথায় তার অফিসে তল্লাশীর আদেশ জারি করে আদালত। পুলিশ যে কোনো সময় কার্যালয়ে তল্লাশী চালাতে পারবে। তবে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত গ্রেফতার ও কার্যালয়ে তল্লাশীর ব্যাপারে প্রশাসনের কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি।
সর্বশেষ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া ব্লুম বার্নিকাটসহ বেশ কয়েকটি দেশের প্রতিনিধি বৈঠক করেন।
এ ছাড়া খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে অবস্থাকালে কয়েক দিন প্রায় প্রতিদিনই অবরোধ ও হরতালে সহিংসতার প্রতিবাদ জানিয়ে শ্রমিক লীগ, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, বাংলাদেশ আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগসহ আওয়ামী লীগ সমর্থক নানা সংগঠনের ব্যানারে কার্যালয় ঘেরাও, মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে আসছে। হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহারের দাবিতে প্রকৌশলী, শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, শিল্পীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এক মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করেন।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) আসলে ভাল নেই। গুলশান কার্যালয়ে রাতে থাকার মতো ভাল সুযোগ-সুবিধা নেই। দুই মাস ধরে তিনি কষ্ট সহ্য করে আছেন। এটা দুঃখজনক।’
জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘শুরুতে সরকার অবরুদ্ধ করে রাখলেও এখন তিনি নিজ ইচ্ছাতেই কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। কষ্ট হলেও এখানে থেকেই আন্দোলন পরিচলনা করছেন তিনি।’
৩ জানুয়ারি রাত থেকে গুলশান কার্যালয়ে আছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। কার্যালয়ে আরও আছেন— দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুল কাইয়ুম, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল, বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, মাহবুব আলম ডিউ, একান্ত সচিব আব্দুস সাত্তার, নিরাপত্তা সমন্বয়ক কর্নেল (অব.) আব্দুল মজিদ, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, প্রেস উইংয়ের সদস্য শামসুদ্দিন দিদার, শায়রুল কবির খানসহ প্রায় অর্ধশতাধিক নেতা ও কর্মকর্তা-কর্মচারী।
খালেদা জিয়ার আত্মীয়স্বজন ছাড়া কাউকে কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। গ্রেফতার আতঙ্কে কার্যালয়ে দলের নেতারা কেউ আসেন না। তা ছাড়া ভেতরে থাকা বেশ কয়েকজনের নামে মামলা আছে। তাই তারাও বাইরে বের হচ্ছেন না।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি কার্যালয়ে আসেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনিও ওখানেই অবস্থান করছেন।