খালেদা জিয়াও ‘ক্লিপিং’ দেখালেন মিশন প্রধানদের; বিদেশী কূটনীতিকদের মাথাব্যাথা ‘সহিংসতা’
বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী কূটনীতিকদের এই মুহূর্তের মাথাব্যাথা হচ্ছে ‘সহিংসতা’। ‘সহিংসতা’ বন্ধের জন্য কূটনীতিকরা ক্ষমতাসীন সরকার ও বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিকে অব্যাহতভাবে চাপ দিয়ে যাচ্ছে। ‘সহিংসতা’ বন্ধের ক্ষেত্রে কূটনীতিকরা সবগুলো দলকে নিজেদের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে পরামর্শও দিচ্ছে। তবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই ‘সহিংসতা’র জন্য একে অপরকে দায়ী করছে।
এদিকে, গত ৫৮ দিনের অবরোধে মোট ১১৪ জন নিহত (হরতাল, অবরোধ, সহিংসতা, ক্রসফায়ার) হওয়ার তথ্য জানা গেছে। যার মধ্যে পেট্রোলবোমা ও আগুনে ৬১ জন, বন্দুকযুদ্ধ ও গণপিটুনিতে ৩৬ জন এবং সংঘর্ষ, গুলিবিদ্ধ লাশ ও সড়ক দুর্ঘটনায় ১৭ জন নিহত হন। এ ছাড়া এক হাজার ২৯০ টি যানবাহনে আগুন ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
একাধিক কূটনীতিক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় অবস্থিত ১৬টি দেশের মিশন থেকে ক্ষমতাসীন সরকার এবং বিএনপি প্রধানের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, ‘সহিংসতা’ বন্ধ হবে কবে। ১৬ টি মিশন হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ডেনমার্ক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানী, জাপান, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, কোরিয়া, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।
কূটনীতিক সূত্রগুলো বলছে, খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকে মিশন প্রধানরা জানতে চান, ‘সহিংসতা’ কবে বন্ধ হবে। কূটনীতিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপি ‘সহিংসতা’য় বিশ্বাস করে না। বেকায়দায় ফেলতে সরকার নিজেই ‘সহিংসতা’ চালিয়ে বিএনপির ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে। ওই সময়ে খালেদা জিয়া ‘সহিংসতা’র তথ্য নিয়ে প্রস্তুত করা একটি ‘ক্লিপিং ফাইল’ দেখিয়ে বলেন, সরকার যে ‘সহিংসতা’ চালাচ্ছে, এখানে তার প্রমাণ রয়েছে।
খালেদা জিয়া কূটনীতিকদের বলেন, ‘কূটনীতিক পাড়ায় বিএনপির রিয়াজ রহমানের উপর হামলা ও একটি দূতাবাসে “সহিংসতা” ঘটানোর চেষ্টা করার ঘটনাগুলোতে আপনারা (কূটনীতিকদের) কী মনে করেন। এগুলো সরকার বিশেষ বাহিনী দিয়ে ঘটিয়ে বিএনপির উপর দোষ দিচ্ছে।’
‘সহিংসতা’র তথ্য নিয়ে প্রস্তুত করা ‘ক্লিপিং ফাইল’টি তখন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লুম বার্নিকাট হাতে নিয়ে দেখেন। খালেদা জিয়া ‘সহিংসতা’র তথ্য নিয়ে প্রস্তুত করা ‘ক্লিপিং ফাইল’র একটি কপি যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রদূতকে দেন। তখন বার্নিকাট বিএনপি চেয়ারপারসনকে বলেন, এটা আমরা খতিয়ে দেখব। প্রকৃত ঘটনা বোঝার চেষ্টা করব। কিন্তু আপনাদেরকে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। আপনারা নিজেদের মধ্যে বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে তুলুন।
ওই বৈঠকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরো মায়াদু বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছে জানতে চান, আপনারা জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ছেন না কেন। জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের কোনো সম্পর্ক নেই। জামায়াত বিএনপির আন্দোলনে সহমত প্রকাশ করেছে, এতে বিএনপির কী করার আছে। খালেদা জিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতকে আরও বলেন, বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ছাড়লে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে তাদের সঙ্গে নিবে না, এর নিশ্চয়তা কী। আওয়ামী লীগতো ক্ষমতায় আছে, তারা কেন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করছে না।
বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক শেষে সবগুলো দেশের পক্ষে ঢাকায় অবস্থিত অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার গত মঙ্গলবার এক বার্তায় বলেন, ‘বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছি। আমরা চলমান সহিংসতা বন্ধ করার আহবান জানিয়েছি। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা নিরসনে সংলাপে বসার পরামর্শ দিয়েছি। বাংলাদেশের সাধারনের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মানবাধিকার রক্ষা ও গণতন্ত্রের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা অর্জনের পথ বের করতে হবে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নিরসন করতে হবে।’
অন্যদিকে, ‘সহিংসতা’ নিয়ে চাপের কারণে সরকারের পক্ষে ঢাকায় অবস্থিত সবগুলো মিশনকে একাধিকবার ‘ব্রিফ’ (বিস্তারিত ব্যাখ্যা) করা হয়। ওই ‘ব্রিফ’ সম্পর্কে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, বিদেশি কূটনীতিকরা আমাদের কাছে জানতে চেয়েছে, ‘সহিংসতা’ কবে বন্ধ হবে। ‘সহিংসতা’ সম্পর্কে বিদেশিদের কাছে তথ্য প্রমাণসহ বলেছি, এগুলো বিএনপি-জামায়াত জোটের কর্মকাণ্ড। বাংলাদেশকে তারা অস্থিতীশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। কিন্তু সরকার তা হতে দিবে না। এখনো সরকারের হাতে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। জনগণ সরকারের সঙ্গে রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কূটনীতিকদের আমরা বলেছি, গত দুই মাসের তুলনায় বর্তমানে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির অনেক উন্নতি ঘটেছে। সামনে আরও উন্নতি হবে।’
সদ্য সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির মূল বিষয় হচ্ছে, বিদেশি বন্ধু বাড়ানো। বিদেশিরা বাংলাদেশে অনেক বিনিয়োগ করছে, ব্যবসা করছে, বিভিন্নভাবে সহায়তাও করছে। তাই সহিংসতা নিয়ে তাদের মাথাব্যাথা স্বাভাবিক। সহিংসতা বন্ধ না হলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বন্ধু কমতে থাকবে।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাবেক একজন সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ক্ষমতাসীন সরকার সহিংসতা নিয়ে বিদেশিদের চাপের মুখে রয়েছে। সরকারকে এই চাপ সামলাতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ শুরু করতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সরকারের যে অনমনীয় অবস্থান তাতে যে কী হবে, সরকার এই চাপ কীভাবে সামলাবে, তা পরিস্কার না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘দেশে-বিদেশে অগ্রণযোগ্য ভোটই হচ্ছে সহিংসতার মূল কারণ। ভোট সম্পর্কে সরকারের অবস্থান পরিস্কার করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপের উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। এই বিষয়টি (ভোট) পরিস্কার হলেই চলমান অস্থিরতা থেকে উত্তরণ ঘটতে পারে।’