ফাগুনের আনন্দ উৎসবে আফসোসের বাতাবরণ

bangladesh_05বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান চেজ করে জয়; বাংলাদেশের চেজ করে জয়ের নতুন রেকর্ড। তারপরও মনটা উদাস-উদাস করছে। এমন বড় জয়ের দিনেও নেতিবাচক ‘আফসোস’-র কথা লিখতে মনকে উসকে দিচ্ছে ফাগুনের আবাহন। উতালা ফাগুনে একটি সেঞ্চুরির আফসোস থাকছেই; খাচ্ছে কুড়েকুড়ে। দুই জন; এক তামিম; দুই মুশফিক। বিশ্বকাপের আরাধ্য সেঞ্চুরি ঠিক নাগালে পেয়েও যেন হেলায় হারিয়েছেন। ক্রিকেটারা পারলেন না বলেই ফাগুন তার রঙ হারিয়েছে। তা না হলেও আরও রঙে রঙে সাজাতে পারত স্কটস বিজয়ের বিরল কৃতিত্ব।

স্কটল্যান্ড ৩১৮ রান চেইজ করেও জেতা সম্ভব স্যাক্সন ফিল্ডের প্লাসিড উইকেটে বটে। তবে সেই কাজটা যে কঠিন ছিল তা বোঝার জন্য ক্রিকেটবোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশ জিতেছে রানের পাহাড় পেরিয়ে। তবু কোনোভাবে বলা যাবে না, আগে ফিল্ডিং নেওয়ার সিদ্ধান্তটা সঠিক ছিল। তারপরও রক্ষা ৪ হাফ সেঞ্চুরিতে সহজ জয়েই বন্দর খুঁজে পেয়েছেন মাশরাফিবাহিনী। এই বিজয়ে স্কটিশরা হেরে গেলেও আনন্দ-ফূর্তি উদযাপনে অনেকে স্কচ হুইস্কিও পান করেছেন। সেখানে হয়তো বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে স্কটল্যান্ডই। বিজয় উদযাপনে বাঙালি যারা সুরাপানে আনন্দফূর্তিতে মেতে ওঠার বিপরীতে স্কটিশরা কিন্তু কষ্টের সঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে গলা পর্যন্ত ডুবেও থাকতে পারেন।

বিজয়ের পথ দুর্গম নিঃসন্দেহে৷ কিন্তু কঠিন সেই গন্তব্যে অনায়াসেই পৌঁছছে যোগ্যতর দলের মর্যাদা নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। এই জয়ের আশে-পাশের মাতাল ফাগুন রঙের ফোয়ারা ছুটছে৷ লাল -সবুজের তকরারও বিকশিত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম এই আলোচিত স্যাক্সন ফিল্ড। আকার-পরিধিতে একটু ছোট হলেও স্টেডিয়ামে নৈস্বর্গিক মনোলোভা রূপ দর্শকমাত্রই উদ্বেলিত করেছে। সেখানে বাসন্তিক আবাহনে ফুরফুরে লাল-সবুজের পতাকা হাতে রঙিন মেজাজিরা বলে বলে রানে রানে প্রাণিত করেছেন ক্রিকেটারদের।

বলে নেওয়া যেতে পারে নিউজিল্যান্ডের তাসমান উপসাগরের পূর্ব উপকূলের শহর নেলসন কেন্দ্রস্থলেই এই স্টেডিয়াম। এই শহরে সূর্যের আলো-রোশনাই বেশি সময় থাকে বলে একে সানি নেলসনও বলা হয়। স্যাক্সটন ফিল্ড নামে পরিচিত এই ক্রিকেট ময়দান নেলসন ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে একেবারে প্রকৃতির ছোঁয়ায়। এই স্টেডিয়ামে মাত্র ৫ হাজার দর্শক সবুজ ঘাসের গালিচায় বসে খেলা উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছেন। বৃহস্পতিবারের ম্যাচে সেখানে বাঙালিদের আধিপত্যই চোখে পড়েছে।

বসন্ত মানেই মধুমাস। এই মাস আসলেই মনের ভেতর আউল বাউল উদাস হাওয়া বয়ে যায়। নীল দিগন্তে এই সময় কেমন এলোমেলো মূর্ছনা। শীতের রম্য উপভোগের পালাও শেষ। বসন্ত শুরুতেই পলাশ বনে রঙের দাঙ্গা। বসন্ত জাগ্রত দ্বারে মানেই আনমনা মলয় পবনের ফাজলামি শুরু। ফাগুনের এই আবিল সময়ে বাংলাদেশের রেকর্ড বিজয়ে মনটা বেজায় উতলা হয়ে গেছে। প্রাকৃতির নিরবচ্ছিন্ন আবাহয়ে গড়ে ওঠা স্টেডিয়ামে তামিম-মাহমুদউল্লাহ-মুশফিক-সাকিব-সাব্বিরের ব্যাটিং প্রজ্ঞা-মেধায় আরও বেশি সুধাময় হয়ে উঠেছে। সেখানে এক সেঞ্চুরির জন্য মনে বড্ড বাউন্ডুলেপনা সৃষ্টি করেছে। হৃদয় বসন্তোবনে জয় জয় উপলক্ষ্য থাকার পরও ‘কি’ যেন নেই এমন অবতারণায় প্রমোদ গুণেছেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। সেই কারণেই উৎসবের আতিশয্যে মাতোয়ারা বাঙালি শতভাগ বাসন্তিক রঙে নিজেকে রাঙিয়ে তুলতে পারেনি।

লক্ষস্থির ৩১৯ রানে। বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান চেজের দ্বিতীয় রেকর্ড এটি। বাংলাদেশ এর আগে ৩১২ রান চেজ করে জয় পেয়েছে। ফিল্ডিং করার সময় কাঁধে মারাত্মক চোট পেয়ে; বিশ্বকাপই খুইয়ে ফেলেছেন এনামুল। এই পরিস্থিতিতে ১০ জনের দলে পরিণত বাংলাদেশ। কোয়েটজারের দুর্ধর্ষ ব্যাটিং তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড বাংলাদেশের বোলিং লাইনআপ। মাশরাফিকেও পুরো ফিট মনে হচ্ছিল না। তামিমও ব্যাটিংয়ে নানা সময়ে পায়ের চোট চোট বোধ দেখিয়েছেন। মাহমুদউল্লাহ অসাধারণ ব্যাটিং করার পর কেমন যেন একটু উবুজুবু হয়ে ফিল্ড ছাড়ছেন। রাজ্যের শঙ্কা তখন ফাগুনের বর্ণিল আকাশকে ভারি করে ফেলছে। সেই আকাশের রঙের আবির অবশ্য মেঘকালো হয়নি।

রেকর্ড সামনে। দারুণ সুযোগ রান করার। ঠিক এমন ম্যাচে রানের আগেই সৌম্য নেই। সেখান থেকেই তামিম-মাহমদউল্লাহ বাংলাদেশ জয়ের অভিযাত্রার সূচনা দেখেছে। বিরল জয়ের পর আবারো উদাসীনতার ঝাঁপি সামনে হাজির। এই হিসেব-সেই হিসেব সামনে চলে আসছে। আসছে না পাওয়া সেঞ্চুরির কথা। আবার তামিম ইকবালের সেঞ্চুরির কথাও বলা যাবে। তবে তা বলের। পাক্কা ১শ’ বলে ঝক্কি-ঝামেলার পাহাড় সামলে; হামলে পড়ে তামিম রান করেছেন ৯৫।bangladesh_03

এলবিডাব্লিউ ফাঁদে পড়ে তিনি ফিরেছেন ৩১.৩তম ওভারে। হয়তো টিকে থাকলে তিনি স্কটিশ কোয়েটজারের ১৫৬ রানও ছাড়িয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু হয়নি তা। তামিম শুরুর ধাক্কা সামলে, রানের খরা কাটিয়ে বৃহস্পতিবার দৃর্দান্ত ব্যাটিং করেছেন। দুর্ভাগ্য যে, সেঞ্চুরিটা পাননি। সেঞ্চুরি পূর্ণ করতে না পারলেও বিশ্বকাপে মোহাম্মদ আশরাফুলের করা সর্বোচ্চ ৮৭ রানের রেকর্ডটি ভেঙেছেন। ৪ হাজারী রানের মাইলফলকও স্পর্শ করেছেন। তার সেঞ্চুরি মিস সম্পর্কে জাভেদ ওমর বেলিম বলেছেন, ‘তার সেঞ্চুরি মিস করাটা ছিল দুর্ভাগ্যজনক।’ তামিম ফিরে যাওয়ার পর সবাই তাকিয়ে ছিলেন মুশফিকের ওপর। দারুণ ব্যাটিংয়ে সম্ভাবনা জাগিয়ে ছিলেন সেঞ্চুরিরও। কিন্তু কোথায় যেন তালগোল পাকিয়ে গেছে। সব সম্ভাবনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে মুশফিক একটি অনভিপ্রেত শট খেলে ফিরে গেছেন। তামিমে যখন বিশ্বকাপের প্রথম সেঞ্চুরি দেখা হয়নি বাংলাদেশের। ঠিক তখন যে আশাজাগানিয়া মুশফিক বাতিঘরের আলো নিজ দায়িত্বেই নিভিয়ে ফেলেছেন। তার আউটে বিস্মিত হয়েছেন সাবেক ওপেনার জাভেদ ওমর। বলেছেন, ‘মুশফিক বাংলাদেশ দলের সেরা ব্যাটসম্যান। খুব ভালো খেলেছেন। তারপরও বলব মুশফিকের এভাবে আউট হওয়াটা উচিৎ হয়নি। তার সেঞ্চুরি করার মতো যথেষ্ট সুযোগ ছিল। সে মিস করেছে। বিশ্বকাপে এর চেয়ে বড় সুযোগ পাওয়া কঠিন।’ ৩৮তম ওভারের শেষ বলে ব্যক্তিগত ৬০ রানে আউট হয়েছেন মুশফিক। তখন বাংলাদেশের ২৪৭ রান। তখন কাগজ-কলমের হিসেব জয়ের জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন বলপ্রতি এক রান; ৭২ বলে ৭২।bangladesh_07

ইভান্সকে লংঅনে মারতে গিয়ে মনে হয়েছে ফিল্ডার ম্যাকলেয়ডের হাতেই জীবন সপে দিয়েছেন। না, সেখান থেকে আর নতুন কোনো বিপদ হয়নি। বাকি কাজ নির্বিঘ্নেই সেরেছেন সাকিব আল হাসান ও সাব্বির রহমান। সাকিব নিজ ছন্দে থেকে অপরাজিত ছিলেন ৫২ রানে। আর সাব্বির ছিলেন ৪২ রানে অপরাজিত সঙ্গী হিসেবে। ১১ বল বাকি থাকতে তাই স্কটিশদের দেওয়া ৩১৯ রানের চ্যালেঞ্জ গুঁড়িয়ে-মুড়িয়ে বাংলাদেশ জিতে নিয়েছে ৬ উইকেট বড় জয়। এটাই বাংলাদেশের রান চেজ করে বড় জয়। এর আগে ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আগে ৩১৩ রান চেজ করে জয়ের রেকর্ড ছিল বাংলাদেশের। ওই ম্যাচে কভেন্ট্রি ১৯৪ রান করেছেন। অন্যদিকে বিশ্বকাপের একটি রেকর্ড এখন বাংলাদেশের দখলে। ২০১১ সালের বিশ্বকাপে আইরিশ রূপকথা হয়েছে। ৩২৭ রান করেও হেরেছিল ইংলিশরা।

ফাগুনের সব রঙে হোলির আবির ছুঁয়ে যাওয়া একটি ম্যাচ হতে হতেও শেষ পর্যন্ত হয়নি। এই কষ্ট আজীবন পাশে থাকবে বাংলাদেশের। অথচ স্কটিশদের বিপক্ষে বাংলাদেশের এই জয় এখন বিশ্বকাপের রেকর্ডবুকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান চেজ করা একটি নতুন মাইলফলক।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend