ভাসুবিহারে হাজার বছরের পুরনো নিদর্শন
বগুড়ার মহাস্থানগড় প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকার ভাসুবিহার খননের সময় বের হয়ে এল হাজার বছরের পুরনো নিদর্শন। ইটের তৈরি দেয়াল, মন্দিরের প্রবেশপথ, পাল আমলের শেষ দিকে নির্মিত ইটের অবকাঠামো, মৃৎপাত্রের অনেক টুকরো ও পোড়ামাটির তৈরি বিভিন্ন প্রকার তৈজসপত্রের সন্ধান মিলেছে। ছয় সদস্যের দল খনন কাজ করবে ১৫ মার্চ পর্যন্ত। খননে আরও নিদর্শন বেরিয়ে আসবে- এমন প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।উত্তরাঞ্চলের প্রবেশ দ্বার বগুড়া শহর থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তরে জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার প্রাচীন দুর্গনগরী মহাস্থানগড়। এর আদি নাম পুন্ড্রনগর বা পুন্ড্রবর্ধন নগর। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ তার ভ্রমণ বিবরণীতে এ নগরীকেই ‘পো-শি-পো’ বলে উল্লেখ করেছেন। মহাস্থানগড়ের দুর্গটি ছিল এক বর্গমাইল বিস্তৃত। ১৫ থেকে ৪৫ ফুট উঁচু পোড়ামাটির মজবুত ইটের তৈরি দেয়ালের চিহ্ন এখনও বর্তমান।
চীনের গ্রেটওয়াল সদৃশ এ দেয়াল দেখলেই অনুমান করা যায়, এর ভেতরে একটা সমৃদ্ধ, সম্পদশালী জনপদের বিকাশ ঘটেছিল। এখানে পাওয়া সবচেয়ে পুরনো প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনা থেকে প্রমাণিত হয়, এ প্রাচীন জনপদ যিশু খ্রিস্টের জন্মের আগেই গড়ে উঠেছিল। মহাস্থানগড়ের আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বেশ কিছু নিদর্শন। মহাস্থানগড় থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার উত্তরে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বিহার ইউনিয়নে অবস্থিত ভাসুবিহার। স্থানীয়রা বিহারকে নরপতির ধাপ বলে। ভাসুবিহারে প্রথম খনন করা হয় ১৯৭৩-৭৪ সালে। ওই সময়ে খননে মাঝারি সংঘরাম আকৃতির নিদর্শন ও মন্দিরে যাওয়ার রাস্তার সন্ধান পাওয়া যায়।
ধারণা করা হয়, পাওয়া নিদর্শনগুলো সম্রাট অশোকের সময়কালের। সংঘরাম বলা হয় যেখানে শান্তিপূর্ণ অবস্থানে ধর্মচর্চা ও শিক্ষাগ্রহণ করা হয়ে থাকে। ভাসুবিহারে ওই সময় বৌদ্ধভিক্ষুরা বসবাস করতেন। এখানে তারা ধর্মচর্চা করতেন। ভাসুবিহারে ২৬টি কক্ষ দেখতে পাওয়া যায়। কক্ষের সঙ্গে বেশ বড় আকৃতির বারান্দার আকৃতিও দেখা যায়। যেখানে বৌদ্ধভিক্ষুরা ধর্মশিক্ষা অর্জন করতে বসবাস করতেন। কথিত আছে ভাসুবিহারে গৌতম বুদ্ধের পদচারণা ছিল। এ পদচারণাকে স্মৃতি করে রাখতে ভাসুবিহারে একটি ইটের স্তূপ তৈরি করেছিলেন সম্রাট অশোক। চীনের পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ৬৩৯ থেকে ৬৪৫ পর্যন্ত বেঙ্গল ভ্রমণের একপর্যায়ে আসেন পোসিপো বিহারে। তখন তিনি সেখানে দেখতে পান প্রায় ৭০০ বৌদ্ধভিক্ষু। প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন পোশিপো বিহারই ভাসুবিহার। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে গৌতম বুদ্ধের সম্মানে সম্রাট অশোক স্তূপটি নির্মাণ করেছিলেন। স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম সেই স্তূপটিকে হিউয়েন সাং বর্ণিত অশোকস্তূপ হিসেবে শনাক্ত করেন। সেই ভাসুবিহারে আবারও খননে পাওয়া গেল হাজার বছর আগের ইটের তৈরি দেয়াল, মন্দিরের প্রবেশপথ, পাল আমলের শেষ দিকে নির্মিত ইটের অবকাঠামো। এ ছাড়াও পাওয়া গেছে মৃৎপাত্রের অনেক টুকরো। চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি থেক শুরু হওয়া খনন কমিটির সদস্য হিসেবে রয়েছেন মহাস্থান জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মজিবর রহমান, সহকারী কাস্টোডিয়ান এসএম হাসানাত বিন ইসলাম, সিনিয়র ড্রাফটম্যান আফজাল হোসেন, ফটোগ্রাফার আবুল কালাম আজাদ ও সার্ভেয়ার লোকমান হোসেন।
মহাস্থান জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান ও খনন কমিটির সদস্য মো. মজিবর রহমান জানান, খননে পাওয়া ইটের অবকাঠামো প্রায় এক হাজার বছরের পুরনো। খনন এলাকায় আরও পাওয়া গেছে একটি গর্ত যেখানে একসঙ্গে ছিল মৃৎপাত্রের টুকরা এবং মাটির পাতিলের ভগ্নাংশ। মন্দিরের সামনের অংশে খননে পাওয়া অবকাঠামোর কিছু অংশ সম্ভবত মন্দিরে প্রবেশের জন্য ব্যবহার করা হতো। তবে এ সব বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে আরও খননের পর। খনন কাজ চলবে আগামী ১৫ মার্চ পর্যন্ত।
প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ও খনন দলের প্রধান নাহিদ সুলতানা জানান, ইতোমধ্যেই পাওয়া গেছে পাল আমলের শেষ দিকে নির্মিত ইটের অবকাঠামো। এ ছাড়াও পাওয়া গেছে মৃৎপাত্রের অনেক টুকরা। ১৯৭৩ সালে প্রথম এ সাইটে খনন করে। তখন পাওয়া যায় ব্রঞ্জের তৈরি বেশ কয়েকটি মূর্তিসহ নানা ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। গত কয়েক বছর খননে আরও পাওয়া গেছে হরফ সংবলিত নামা ধরনের সিল, মাটির মূর্তি ও পোড়ামাটির ফলকসহ নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। চলতি খনন কাজ শেষ হতে আরও বেশ কিছু নিদর্শন বের হতে পারে বলে আশা করছি।