বাঘ আর সিংহের লড়াই
ক্রিকেটের জনক ইংল্যান্ড। তাদের সঙ্গে কারো তুলনা হয় না। সেই দিক থেকে বলতে গেলে নবিস দল বাংলাদেশ। ব্রিটিশদের সুবাদে এ অঞ্চলে ক্রিকেটের চর্চা অনেক আগে হলেও এই দুই দেশের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। কিন্তু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কখনো-সখনো ঘুচে যায় দূরত্ব। বিশ্বকাপ কখনো চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও সব কিছু মিলিয়ে ক্রিকেটের ‘সিংহ’ হিসেবে বিবেচনা করা যায় ইংল্যান্ডকে। আর শক্তিধর দল না হয়েও ‘বাঘ’ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ। এবার প্রকৃতঅর্থে বাঘ এবং সিংহের লড়াই দেখতে পাবে ক্রিকেট বিশ্ব। এই দুই দলের এখন এমন এক অবস্থান, কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। শক্তির যতই হেরফের হোক না কেন, খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে ইংল্যান্ড আর এমন একটি সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে বাংলাদেশও নিশ্চয়ই মুঠো আলগা করবে না। একটুখানি চেপে ধরতে পারলে ছিটকে পড়বে ইংলিশরা।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটে পুল ‘এ’-এর পয়েন্ট টেবিলের যা অবস্থা, তাতে কোয়ার্টার-ফাইনাল নিশ্চিত করা নিউজিল্যান্ড, সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কার পর চতুর্থ কোনো দল কোয়ার্টার-ফাইনালে খেলবে, সেটা অনিশ্চিত হয়ে আছে। কে যাবে? বাংলাদেশ না ইংল্যান্ড? এই দুই দলই খেলেছে চারটি করে ম্যাচ। বাংলাদেশের পয়েন্ট ৫ আর ইংল্যান্ডের ২। খেলা আছে ২টি করে। এই দুই দল পরস্পরের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া ছাড়াও ইংল্যান্ডের অপর প্রতিপক্ষ আফগানিস্তান। বাংলাদেশের নিউজিল্যান্ড। সাধারণ জ্ঞানে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ইংল্যান্ড এবং বাংলাদেশের বিপক্ষে নিউজিল্যান্ড ফেভারিট। যদিও ফেভারিটের এই হিসেব যে পুরোপুরি মিলে যাবে, তেমনটি ভাবার কারণ নেই। তারপরও যদি হিসেব মিলেও যায়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পয়েন্ট থেকে যাবে আগের মতোই। আর ইংল্যান্ডের পয়েন্ট হবে ৪। তাতে মীমাংসা হবে না। সেটা বিবেচনায় রেখে তার আগেই বাংলাদেশ এবং ইংল্যান্ডকে ফয়সালায় আসতে হবে। পরের ম্যাচে আপসেট না ঘটলে এই দুই দলের ম্যাচে যে দল জিতবে, তাদের কোয়ার্টার-ফাইনাল খেলা অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যাবে। অবশ্য জিতলে বাংলাদেশকে আর পেছনে তাকাতে হবে না। আর কোনো কারণে খেলা না হলেও কোয়ার্টার-ফাইনাল খেলবে বাংলাদেশ। তেমন সম্ভাবনাকে আপাতত দূরে সরিয়ে রাখছি।
বাংলাদেশ কি পারবে ইংল্যান্ডকে ধরাশায়ী করতে? এটা অসম্ভব কিছু নয়। ১৫ বারের লড়াইয়ে টাইগাররা জিতেছে ২ বার। ২০১০ সালের ১০ জুলাই ব্রিস্টলে ন্যাটওয়েস্ট সিরিজে ইংল্যান্ডকে প্রথম হারায় বাংলাদেশ। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচে মাশরাফি বিন মর্তুজা, ইমরুল কায়েসদের নৈপুণ্যে ৫ রানে জয়ী হয়। এ ছাড়া গত বিশ্বকাপ ক্রিকেটে চট্টগ্রামে ইমরুল কায়েস, শফিউল ইসলাম, মাহমুদউল্লাহ’র কৃতিত্বে বাংলাদেশ ২ উইকেটে হারায় ইংলিশদের। এরপর আর দুই দলের দেখা হয়নি। বিস্ময়কর হলেও এটাই বাস্তবতা। টেস্ট ঘরানার দুই দেশ হয়েও একে অপরের সঙ্গে সহসা দেখা হয় না। এ থেকে অনুধাবন করা যায় ক্রিকেটের বিশ্বায়নের সামগ্রিক চালচিত্র! চার বছর পর এমন একটি ম্যাচে দেখা হচ্ছে, যা দু’ দলের জন্যই ‘ডু অর ডাই’ ম্যাচ। এবারের বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ইংল্যান্ড একদমই সুবিধা করতে পারছে না। দুই স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে শোচনীয়ভাবে হারার পর দুর্বল স্কটল্যান্ডকে অনায়াসে হারায়। কিন্তু শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বড় স্কোর গড়েও যেভাবে হার মানে, তাতে ইংলিশদের আত্মবিশ্বাসে বড় ধরনের ধাক্কা লাগাই স্বাভাবিক। প্রকৃত অর্থেই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাদের। বাংলাদেশের সঙ্গে খেলায় তাদেরই বেশি চাপে থাকার কথা। এ ম্যাচে পয়েন্ট হারালে তাদের কোয়ার্টার-ফাইনালে খেলার কোনো সুযোগ থাকবে না। আর বাংলাদেশ হারলেও শেষ ম্যাচে অপ্রতিরোধ্য নিউজিল্যান্ডকে হারাতে পারলে খেলবে শ্রেয়তর দল হিসেবে। এমন সমীকরণের সামনে ইংলিশদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবার কথা। তারপরও ইংল্যান্ডকে সহজ প্রতিপক্ষ মনে করার কারণ নেই।
সাধারণ বিবেচনায় বাংলাদেশের সঙ্গে খেলায় ফেভারিট ইংল্যান্ড। তবে বিদ্যমান অবস্থায় তাদের ফেভারিট হিসেবে মেনে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং বাংলাদেশ এ ম্যাচে নিজেদের ফেভারিট মনে করতেই পারে। কোয়ার্টার-ফাইনালে যাওয়ার জন্য এ ম্যাচটি বাংলাদেশের মোক্ষম একটি সুযোগ। মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়া ইংলিশদের যদি শুরু থেকে চেপে ধরে মনোবল নাড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তাদের পক্ষে সেই চাপ কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের তো হারানোর কিছু নেই। যার হারানোর কিছু নেই, তার চাপও থাকার কথা নয়। ফুরফুরে মেজাজে খেলতে পারলে জয় পাওয়াটা অসম্ভব নয়। তবে এ ধরনের ম্যাচে সুযোগ খুব বেশি পাওয়া যায় না। প্রাপ্ত সুযোগগুলো যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। বাংলাদেশের ফিল্ডিং দুর্বলতা এখনও রয়ে গেছে। তাছাড়া এ পর্যায়ের ম্যাচে ‘রানিং বিটুইন দ্য উইকেটস’ যদি শিশুসুলভ হয়, তাহলে সেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আর আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ‘রিভিউ সিস্টেম’ নিতে হলে ভেবে-চিন্তে নেওয়া প্রয়োজন। অকারণে এই সুযোগ নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। খেলার ভিতরের এই হিসেব যদি ঠিকমতো মেলানো যায়, তাহলে খেলার ফলও প্রতাশ্যা অনুযায়ী মিলে যেতে পারে। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা ফিফটি করার পর কেন যে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন, এটা ঠিক বোধগম্য নয়। স্কটল্যান্ডের কাইল কোয়েটজার বাংলাদেশের সঙ্গে কত সাবলীলভাবে সেঞ্চুরি করলেন। একই ম্যাচে তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ, মুশফিকুর রহিমের সেই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সেটা পারেননি। তারা যে কেবল সেঞ্চুরি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাই নয়, তাদের কারণে দলের বিপদও হতে পারত। ফিফটিকে সেঞ্চুরি করতে না পারার এই ধারা অনেক আগে থেকে চলে আসছে। বিশ্বকাপে সহযোগী দেশের ক্রিকেটাররা সেঞ্চুরি পেলেও বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান এখন অব্দি সেটা পারেননি। কে এই দুর্নাম ঘুচাবেন?
প্রাণীর রাজা সিংহ হলেও বনের রাজা কিন্তু বাঘ। ক্রিকেটের ‘সিংহ’ ইংল্যান্ড এখন এমন এক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, হেরে গেলে তারা শুধু বিশ্বকাপ ক্রিকেট থেকেই ছিটকে পড়বে না, ক্ষুণ্ন হবে তাদের গৌরব ও অহংকার। আর ক্রিকেটের ‘বাঘ’ বাংলাদেশ হারলেও সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাবে না। এ হারে অগৌরবেরও কিছু নেই। এই দুই শক্তির লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কে জিতবে, সেটা বলা না গেলেও খেলাটা যেন উপভোগ্য হয়, সেটাই ক্রিকেটানুরাগীদের প্রত্যাশা।
– See more at: http://www.thereport24.com/article/92672/index.html#sthash.jWegYgjL.dpuf