বাংলাদেশের মনোযোগ অন্যত্র, টেনশনে নিউজিল্যান্ড
এক ম্যাচ আগেই বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় বেশ স্বস্তিতে আছে বাংলাদেশ। যদিও গ্রুপের শেষ ম্যাচের প্রতিপক্ষ দুর্দান্ত গতিতে ছুটে চলা নিউজিল্যান্ড। এ ম্যাচ দু’দলের কারো জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়। আগেই গ্রুপের শীর্ষস্থান নিশ্চিত করেছে কিউরা। আর এ ম্যাচে জিতলে কিংবা হারলে টাইগারদের অবস্থানের খুব একটা হেরফের হবে না। গ্রুপে তৃতীয় কিংবা চতুর্থ স্থানে থাকলে প্রতিপক্ষ হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালে পাওয়া যাবে দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, পাকিস্তান কিংবা অন্য কোনো দলকে। খুব বেশী সম্ভাবনা রয়েছে ভারত অথবা দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি হওয়ার। তবে কে প্রতিপক্ষ, তাতে টাইগারদের খুব বেশী কিছু আসে-যায় না। বলা যায়, যাহা বাহান্ন তাহা তিপ্পান্ন। বরং প্রতিপক্ষ ভারত হলে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও সুবিধা পেতে পারে। কেন পাবে, তার কোনো সদুত্তর দিতে পারব না। সব কথা তো আর পরিসংখ্যান দিয়ে বুঝিয়ে বলা (লেখা) যায় না। শ্যামল মিত্র আর আরতি মুখোপাধ্যায়ের যুগল কণ্ঠের জনপ্রিয় গানের ভাষায় বলা যায়,‘কথা কিছু কিছু বুঝে নিতে হয়। সে তো মুখে বলা যায় না।’ সেক্ষেত্রে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ম্যাচে খুব বেশী সিরিয়াস হয়ে শক্তিক্ষয় করার যথার্থতা খুঁজে পাই না।
আগের ম্যাচে ইংল্যান্ডের সঙ্গে খেলায় টাইগাররা নিজেদের যেভাবে নিংড়ে দেয়, তদুপরি এক ভেন্যুতে থেকে আরেক ভেন্যুতে যাতায়াতের যে হাঙ্গামা, তার ধকল কিন্তু নেহাত কম নয়। বিশেষত, পেস বোলারদের ওপর দিয়ে যে অমানুষিক খাটুনি গেছে, সেটা পুষিয়ে নিতে তাদের বিশ্রাম দেওয়া গেলে মন্দ হয় না। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা ইনজুরি নিয়ে যেভাবে ম্যাচে নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছিলেন, যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা ছিল। অবশ্য এ ধরনের ম্যাচে নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়ে দেশের সাফল্য এলে তাতে বোধকরি মাশরাফির কোনো আফসোস থাকত না। সৌভাগ্যক্রমে তেমন কিছু হয়নি। এমনটি যাতে না হয়, সে জন্য সতর্কতা অবলম্বন করলে ভাল হয়। অবশ্য বিশ্বকাপ ক্রিকেটের মতো বড় আসরে বিশ্রামতত্ত্ব অমূলক মনে হতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ সামনে থাকলে এমন কথা লেখা সুবিবেচনাপ্রসূত হতো না। যেহেতু দলকে উজ্জীবিত করার ভাল একটা মওকা পাওয়া গেছে, সেটা কাজে লাগাতে পারলে ফায়দা পাওয়া যেতে পারে। বিশ্রাম পাওয়ার পর বাংলাদেশ দল কোয়ার্টার ফাইনালে পূর্ণ শক্তি নিয়ে খেলতে পারলে সেটা দারুণ টনিক হিসেবে কাজ করবে বলে আমার মনে হয়। কৌশলগত সুবিধার জন্য মাশরাফিসহ প্রয়োজন অনুসারে কাউকে কাউকে বিশ্রাম দিয়ে পেসার শফিউল ইসলাম, স্পিনার তাইজুল ইসলাম, অল-রাউন্ডার নাসির হোসেন, ব্যাটসম্যান মোমিনুল হককে খেলানো যেতে পারে। তাতে করে দলটা আরও বেশী চাঙ্গা হয়ে ওঠতে পারে। যেহেতু এ ম্যাচ নিয়ে বড় কোনো দুর্ভাবনা নেই, সঙ্গত কারণে এ ম্যাচে রিলাক্স মুডে খেলা যেতেই পারে। এর অর্থ এই নয় যে, বাংলাদেশ জয়ের জন্য খেলবে না। অবশ্যই জয়ের জন্য খেলতে হবে।
এটা তো ঠিক, অপরাজেয় নিউজিল্যান্ডকে হারাতে পারলে ক্রিকেট বিশ্বে বড় একটা তোলপাড় হয়ে যাবে। এমন একটা জয় পেলে টাইগারদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবল থাকবে আরও তুঙ্গে। সেটাও হবে বড় একটা অর্জন ও শক্তি। নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে জয় পেলে কোয়ার্টার ফাইনালের প্রতিপক্ষ বাংলাদেশকে নিয়ে অনেক বেশী মানসিক চাপের মধ্যে থাকবে। সেটাকে তো আর অস্বীকার করা যাবে না। স্বাভাবিক কারণে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের জন্য বাংলাদেশ অবশ্যই সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। কিন্তু বলার (লেখার) বিষয় হল, বাংলাদেশ দলে যারা খেলছেন, তাদের সবারই যোগ্যতা আছে মূল একাদশে খেলার। আছে বলেই তারা স্বপ্নের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে। কেউ কেউ বলতে পারেন, জয়ের ধারায় থাকা দলের ছন্দ নষ্ট করা ঠিক হবে না। এ কথাটা বাংলাদেশের জন্য পুরোপুরি প্রযোজ্য নয়। এ দলটি জয় ও পরাজয়, দুই অভিজ্ঞতা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। আর এমন তো নয় শুরু থেকেই বাংলাদেশ একই দল খেলছে। যে কারণেই হোক দলে তো রদবদল হয়েছে। সেক্ষেত্রে দলের খেলোয়াড় পরিবর্তন নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। তবে এটাও ঠিক, এমন কিছু করা উচিত হবে না, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দলের সংহতি ও শক্তি। এটিই তো এখন টাইগারদের এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম সোপান। দলের জন্য কোনটা ভাল কোনটা মন্দ সেটা সবচে ভাল বুঝবেন টিম ম্যানেজমেন্ট। তারা নিশ্চয়ই হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। কিন্তু ঘুরে-ফিরে যেটা বলতে (লিখতে) চাইছি, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলায় কেউ যদি ইনজুরির শিকার হন, সেটা বড় কোনো ক্ষতির কারণ হতে পারে।
এটা তো লেখার অপেক্ষা রাখে না, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের চেয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে জয়টাই এখন বড় স্বপ্ন। প্রায় ১৬ কোটি মানুষের বুকের মধ্যে স্পন্দিত হচ্ছে স্বপ্নের এই বীজ। সেই স্বপ্ন পূরণের পথে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ম্যাচে এমন কিছু ঘটুক, যা মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়। বাংলাদেশ দলের পুরো শক্তি কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের জন্য সঞ্চিত থাকুক, সেটাই সবার চাওয়া। কোয়ার্টার ফাইনালের স্বপ্ন যেহেতু পূরণ হয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই এখন আরও বড় স্বপ্ন দেখাই যেতে পারে। বড় সেই স্বপ্নের পথে কোনো খামতি যেন স্বপ্নভঙ্গের বেদনার কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। তেমন কিছু হলে সেটা হয়ে থাকবে অনন্ত এক হাহাকার।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ৩ বার মুখোমুখি হয়ে একবারও জিততে পারেনি বাংলাদেশ। তবে ওয়ান ডে ম্যাচে কিউরা টাইগারদের কাছে একাধিকবার নাকাল হয়েছে। দু’দলের মোট ২৪টি ওয়ান ডে ম্যাচে বাংলাদেশ জিতেছে ৮টিতে। ২০১০ সালের অক্টোবরে সাকিব আল হাসানের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে পাঁচ ম্যাচের সিরিজে ৪-০ তে কিউইদের হোয়াইটওয়াশ করে স্বাগতিকরা। বৃষ্টির কারণে দ্বিতীয় ম্যাচটি হয়নি। ২০১৩ সালে উভয় দেশের সর্বশেষ ৩ ম্যাচের ওয়ান ডে সিরিজে সফরকারী নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করে টাইগাররা। তারমানে উভয় দলের মধ্যে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সাত ম্যাচেই জয়ী দলের নাম বাংলাদেশ। টানা জয়ের এমন রেকর্ড আর কোনো দলের বিপক্ষে টাইগারদের নেই। জিম্বাবুয়ে ছাড়া টেস্ট ঘরানার আর কোনো দেশকে বাংলাদেশ দুইবার হোয়াইটওয়াশও করতে পারেনি। টাইগারদের এমন কীর্তির সামনে নিউজিল্যান্ড নিশ্চয়ই স্বস্তি বোধ করবে না। যদিও সেই নিউজিল্যান্ড আর বর্তমান নিউজিল্যান্ডের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ।
বাংলাদেশের সেই দলের মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ, মাশরাফি বিন মুর্তজা, রুবেল হোসেনদের দেখে হার্টবিট কিছুটা হলেও বেড়ে যাওয়ার কথা নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটারদের। আর ‘কিউই’দের সামনে পেলে ‘টাইগারদের তেজ কেন জানি বেড়ে যায়। আর এ ম্যাচে বাংলাদেশের হারানোর কিছু নেই; নেই কোনো টেনশন। আর অপ্রতিরোধ্য নিউজিল্যান্ডের কাছে এ ম্যাচটি গুরুত্বপূর্ণ না হলেও হেরে গেলে বিশাল এক ধাক্কা খাবে। চির খাবে ‘মাউন্ট কুক’ পাহাড়ের মতো গড়ে ওঠা সুউচ্চ আত্মবিশ্বাসে। সব দিক দিয়ে ম্যাচটা তাই তাদের জন্য অনেক বেশী টেনশনের। আর এত এত টেনশন নিয়ে কি স্বাভাবিক খেলা যায়?