‘সঙ্কটের মূল কারণ শেখ হাসিনা’
‘দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের স্রষ্টা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ’ মন্তব্য করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘সুনির্দিষ্টি করে বলতে গেলে এ সঙ্কটের মূল স্রষ্টা শেখ হাসিনা।’ তিনি এ সময় ঘোষণা করেন, ‘যৌক্তিক পরিণতি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’
খালেদা জিয়া অভিযোগ করেন, ‘মহাবিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ জাতিকে মহাদুর্যোগে ফেলে দিয়েছে। জনগণের মৌলিক অধিকার নিয়ে কথা বলার কোনো নৈতিক অধিকার তাই তাদের নেই।’
গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে শুক্রবার বিকেলে আয়োজিত এক জনাকীর্ণ সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি চলমান রাজনীতি নিয়ে ২০ দলের পক্ষ থেকে সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল একমত হয়েছিল যে, কোনো দলীয় সরকারের অধীনে এখানে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে জাতীয় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘মহাবিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনীর আওতায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নামে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এক নির্লজ্জ প্রহসনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের নাম-নিশানাও মুছে দিয়েছে। এই প্রহসনের অংশ হিসেবে অপকৌশলের মাধ্যমে তারা ভোট ছাড়াই সংসদের ১৫৩টি অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করে। এই ঘৃণ্য কারসাজির মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বহীন একটি অবৈধ ও স্বেচ্ছাচারী সরকার জগদ্দল পাথরের মতো জাতির কাঁধে চেপে বসেছে। জবাবদিহিতাহীন এ সরকারের দেশ পরিচালনার কোনো নৈতিক অধিকার, ভিত্তি ও এখতিয়ার নেই।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘মহাকারসাজির নির্বাচনী প্রহসনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে এটি একটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। শেখ হাসিনা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে একটা সমঝোতা হলে সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের অঙ্গীকারও করেছিলেন। কিন্তু যথারীতি তিনি তার সেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছেন। আসলে প্রতিশ্রুতি রক্ষার কোনো দৃষ্টান্ত তাদের নেই।’
তিনি বলেন, ‘১৯৮৬ সালে প্রতিশ্রুতি লংঘন করে স্বৈরাচারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তারা আত্মস্বীকৃত জাতীয় বেঈমানে পরিণত হয়েছিলেন। ৫৭ বছর বয়সে রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার অঙ্গীকারও অবলীলায় ভঙ্গ করতে দেশবাসী দেখেছে। এ রকম আরও বহু উদাহরণ রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তাদের প্রতিশ্রুতির কারণে ৫ জানুয়ারির পর আমরা আন্দোলনের কর্মসূচি স্থগিত করেছিলাম। কিন্তু শেখ হাসিনার কথা বিশ্বাস করে আমাদের সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যে সঠিক ছিল না তা আমরা অচিরেই বুঝতে পারি। কারণ, আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত করার পর সারা দেশে যৌথবাহিনীর অভিযানের নামে তারা এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।’
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দেশের বিরাজমান সমস্যা সমাধানে সরকারের উদ্দেশে কিছু শর্ত তুলে ধরেন সংবাদ ব্রিফিংয়ে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সারাদেশে যে সব নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। পুলিশ ও যৌথবাহিনীর হয়রানি বন্ধ করতে হবে। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়রানিমূলক সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। বিচারবহির্ভূত প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে হবে। সভা-সমাবেশ-মিছিলসহ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর আরোপিত সকল প্রকার বিধিনিষেধ অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে সকলের অংশগ্রহণে অনতিবিলম্বে জাতীয় সংসদের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে সংলাপের আয়োজন করতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের বিশ্বাস, এ প্রক্রিয়াতেই আমরা সমস্যা সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে পারব। আন্দোলনকে দ্রুত নিয়ে আসতে পারব শান্তিপূর্ণ সমঝোতার পথে।
জনগণের চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বিপথে নিতে আওয়ামী লীগ অন্তর্ঘাত ও নাশকতার পথ বেছে নিয়েছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তিনি বলেন, পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা আইনশৃংখলা বাহিনীর প্রহরায় কিছু যানবাহন রাস্তায় নামায়। সে সব যানবাহনে পেট্রোলবোমা মেরে নারী-শিশুসহ নিরপরাধ মানুষকে দগ্ধ করে শোচনীয় মৃত্যুর পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা এ সব পৈশাচিক বর্বরতার তীব্র নিন্দা জানিয়ে আসছি। হীন সন্ত্রাসে জড়িতদের সঠিক ভাবে চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তিরও দাবি করে চলেছি। কিন্তু আমাদের আহ্বানে তারা কর্ণপাত করেনি। তারা তাদের ষড়যন্ত্রের নীল নকশা বাস্তবায়নে এগিয়ে গেছে এবং নিরপরাধ মানুষের শোচনীয় মৃত্যুকে তারা তাদের ঘৃণ্য রাজনীতির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে।
দেশবাসী প্রতিনিয়ত দেখছেন, ছাত্রলীগ-যুবলীগ সন্ত্রাসীরা দখল ও টেন্ডারবাজিতে জড়িয়ে গোলাগুলি করছে, সশস্ত্র সংঘাতে জড়াচ্ছে। আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য ও সাংবাদিকদের ওপরেও সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে। বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ, মিছিলে হামলা করছে। তাদের নিজেদের মধ্যেও সশস্ত্র সংঘাত হচ্ছে। কিন্তু কাউকেই ধরা হচ্ছে না।
বিএনপি প্রধান বলেন, আমাদের অফিসগুলো তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছে। শান্তিপূর্ণ মিছিল-সমাবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ আমাদের বিরুদ্ধে একতরফা অপপ্রচারের উদ্দেশ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় শাসক দলের মুষ্টিমেয় সংখ্যক লোক দিয়ে বিভিন্ন স্থানে মহড়া করানো হচ্ছে।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য আমরা যখনই আন্দোলন করেছি, তখনই বিভ্রান্তি ছড়াবার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ অপপ্রচারণার নোংরা পথ বেছে নিয়েছে। কখনো তারা বলেছে মুজিব হত্যার বিচার ঠেকাতে এবং কখনো বলেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার রোধে নাকি আমরা আন্দোলনে নেমেছি। তাদের এ সব অপপ্রচার জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি।
খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে গুলি চালানো হয়। গুলিতে রিয়াজ রহমানের মতো সজ্জন ব্যক্তি গুরুতর আহত হন। প্রবীণ রাজনীতিক তরিকুল ইসলামসহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতাদের বাড়ি-ঘর, অফিস ও যানবাহনে গুলি, বোমা হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ সারা দেশে প্রায় দশ হাজার নেতাকর্মীকে গত দুই মাসে তারা কারারুদ্ধ করেছে। লাখ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে।
বিরোধী দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে নজীরবিহীনভাবে দীর্ঘদিন ধরে রিমান্ডে রেখে নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদকে একের পর এক মিথ্যা মামলায় এক মাস ধরে দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়ে নানাভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে। জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত বিরোধী দল সমর্থক মেয়রদের মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে দলীয় লোক বসানের জন্য তাদের বরখাস্ত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, বিএনপির অন্যতম যুগ্ম-মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে গ্রেফতার করেও গত তিন দিনেও সরকার স্বীকার করেনি। এখন পর্যন্ত তার কোনো হদিস নেই। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার ব্যাপারেও সরকার প্রথম অস্বীকার করে পরে নাটক সাজিয়ে ২১ ঘণ্টা পর তাকে গ্রেফতার দেখায়।
আমি আবারও অবিলম্বে সালাহউদ্দিন আহমেদকে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। অন্যথায় এর পরিণতি শুভ হবে না।
বিএনপি চেয়ারপারসন তার বক্তব্যের শুরুতে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গকারী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
তিনি সংবাদ ব্রিফিংয়ের শেষে বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র ও নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক মানুষ জীবন দিয়েছে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। উন্নত কিংবা অনুন্নত কোনো দেশেই গণতন্ত্র ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই এবং সংগ্রামী মানুষের আত্মত্যাগ কখনো বৃথা যায়নি। বাংলাদেশেও তা বৃথা যাবে না। ইনশাআল্লাহ্।
সংবাদ সম্মেলন শেষে উপস্থিত সাংবাদিকরা তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। এ সময় তিনি ‘শুনতে পাচ্ছি না’ উল্লেখ করে দাবি করেন, ‘এ আন্দোলনে জনগণ শহীদ হয়েছে, জনগণের সমর্থন পেয়েছি।’