মাঝি-মাল্লারা রাজপথে
১৯৭১ সালের এ দিনে মাঝি-মাল্লারা বৈঠা হাতে রাজপথে নেমে আসে। ১৪ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের শেষ দিন।
সামরিক আইনের ১১৫ নং ধারা জারির প্রতিবাদে সেদিন বেসরকারি কর্মচারীরা বিক্ষোভ করেন। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। সশস্ত্র বাহিনী বিমানবন্দরে ভারি কামান স্থাপন করায় বিমান শ্রমিকরা ধর্মঘট করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশ থেকে সম্পদ পাচার প্রতিরোধের উদ্দেশে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট স্থাপন করে।
নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যতক্ষণ জনগণ স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাঁচতে না পারবে ও যতক্ষণ তারা মুক্তি অর্জন করবে না তত দিন আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘যদি প্রেসিডেন্টের দাবি পূরণের ইচ্ছা নিয়ে আলোচনায় বসতে চান, তা হলে আমি বসতে পারি।’ তিনি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘কোনোভাবেই তৃতীয় কোনো পর্ব সেখানে উপস্থিত থাকতে পারবে না।’
বরিশালে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাংলা জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান অস্থায়ী সরকার গঠন করার আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদ অসহযোগ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৫ মার্চ থেকে পালনের জন্য ৩৫টি নতুন নির্দেশনা দেন। ডিসি, এসডিও ও পুলিশ কর্তৃপক্ষকে অফিস না খুলে সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন।
এদিন পূর্ব পাকিস্তান সফররত ন্যাপ (ওয়ালী) নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করেন। রুদ্ধদ্বার কক্ষে প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী এ আলোচনায় জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি দলের উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম কামরুজ্জামানসহ অন্যান্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো বাণী বহন করে আনিনি। প্রেসিডেন্ট কর্তৃক দেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী বলে অভিহিত শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’ তিনি বাঙালির আন্দোলন এবং তাদের দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ করেন।
ঢাকার সকল পত্রিকা একটি যৌথ সম্পদকীয় প্রকাশ করে এ দিন। এতে বলা হয়, ‘জাতি আজ সঙ্কটে নিপতিত এবং এর জন্য দায়ী সরকার।’ সেখানে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ কাম্য নয় বলে মন্তব্য করা হয়। অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে সংবাদপত্র প্রেস কর্মচারী ফেডারেশনের উদ্যোগে সকালে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে সমাবেশ করা হয়। সমাবেশ শেষে মিছিলসহ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে তার হাতে একটি আবেদনপত্র দেওয়া হয়। এতে নেতারা যে কোনো নির্দেশ পালনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে অবিলম্বে একটি জাতীয় সরকার গঠন ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুরোধ জানান।
বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে ছাত্র ইউনিয়নের এক সমাবেশ থেকে দেশের ৭ কোটি জনতাকে সৈনিক হিসেবে সংগ্রামে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল ইসলাম নাহিদের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
বাংলাদেশের জন্য খাদ্যশস্যবাহী ‘মন্টেসেলো ভিক্টরি’ নামের আর একটি জাহাজের গতিপথ পরিবর্তন করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। ‘ওসান এন্ডুরাস’ নামের অস্ত্রবাহী আরেকটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের ১০নং জেটিতে নোঙর করে। বন্দর শ্রমিকদের অসহযোগিতার কারণে ৯ মার্চ ১৬নং জেটিতে অস্ত্রবাহী অপর জাহাজ ‘সোয়াত’-এর সমরাস্ত্র খালাসের চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়। প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি দলের নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এক বিবৃতিতে ১১ মার্চ খাদ্যবাহী জাহাজ ‘ভিটেজ হরাইজন’ এর গতিপথ চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবর্তে করাচি বন্দরে পরিবর্তনের ঘটনা সম্পর্কে অবিলম্বে তদন্তের দাবি জানান।
এ দিনে শিল্প সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা শিল্প সংগ্রাম গঠন করেন। ঢাকার কবি-সাহিত্যিকরা ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ নামে একটি কমিটি গঠন করেছেন। এর আহ্বায়ক ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন সিকান্দার আবু জাফর, আহমদ শরীফ, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, বদরুদ্দীন ওমর, রণেশ দাসগুপ্ত, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, রোকনুজ্জামান খান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, সুফিয়া কামাল, জহির রায়হান ও আবদুল গনি হাজারী প্রমুখ।
চট্টগ্রামে লালদীঘি ময়দানে আওয়ামী লীগের এক সভায় চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নান বঙ্গবন্ধুর দাবি মেনে নেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানান। সংগ্রাম পরিষদ সারা শহরে মিছিল করে। বিকেলে চকবাজারের উর্দুগলিতে মিছিলে হানা দেয় বিহারী ও তাদের বাঙালি সহযোগীরা। ৭ জন বাঙালি গুরুতর আহত হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেলে নেওয়ার পথে ২ জন মারা যান। রাতে বাঙালিরা উর্দুগলিতে আক্রমন করে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে আর্মির একটি ট্রাক এসে চকবাজারের মোড়ে প্রায় ১৫ জন বাঙালি যুবককে তুলে নিয়ে যায়। সারারাত অত্যাচার করে ভোররাতে কোতোয়ালির সামনে ফেলে রাখে।
স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশ হতে সম্পদ পাচার বন্ধের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানায়। তারা এ জন্য শহীদ তীতুমীর কলেজ, পাক মটরস, ঢাকা রেল স্টেশন ও যাত্রাবাড়ী বাস স্টেশনসহ ৫টি জায়গায় চেকপোস্ট বসায়। তারা ছুটিভোগকারী বাঙালি সৈনিকদের কাজে যোগ না দিয়ে নিজ নিজ এলাকার সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্বাধীনতার প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানান।
অন্যদিকে, করাচি নিশাত পার্কে পিপলস পার্টির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত জনসভায় জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি পাকিস্তানের দুই অংশের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব দেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তার সঙ্গে সংলাপ শুরু করার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি আহ্বান জানান।