২০ দলীয় জোটের আন্দোলন, কেন্দ্রের নিষ্ক্রিয়তায় হতাশ তৃণমূল বিএনপি
গত ৬৬ দিন ধরে টানা অবরোধ ও দফায় দফায় হরতাল কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। রাজপথে সিনিয়র ও কেন্দ্রীয় নেতাদের দেখা না যাওয়ায় তৃণমূলের সাধারণ নেতাকর্মীরা হতাশায় ভুগছেন। এমন অবস্থায় আন্দোলনের চূড়ান্ত ফল জোটের অনুকূলে আনতে কেন্দ্রীয় নেতাদের সক্রিয় হওয়ার দাবি জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
তৃণমূল নেতাকর্মীরা জানান, অনেক বাধা-বিপত্তির পরও তারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় প্রতিদিনই শত শত নেতাকর্মী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হচ্ছেন। অনেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকারও হচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারদলীয় সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হয়ে অনেকেই ভিটেমাটি ছাড়া হচ্ছেন। এমন অবস্থায় যদি সিনিয়র ও কেন্দ্রীয় নেতারা সক্রিয় থাকেন তবে তৃণমূলের কর্মীরা উৎসাহ ও সাহস পাবে।
বিএনপির অঙ্গসংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদলের ঢাকা মহানগর উত্তরের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান বলেন, ‘চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলন সফলে দলের হাইকমান্ডের কাছে প্রথমেই শীর্ষ নেতাদের রাজপথে সক্রিয় হওয়ার দাবি করছি। সিনিয়র নেতারা রাজপথে থাকলে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সাহস ও শক্তি পাবে। দায়িত্বশীল নেতাদের নির্দেশনায় তারা আন্দোলনের প্রয়োজনে যে কোনো ভূমিকা রাখতেও পিছপা হবে না।’
তিনি বলেন, ‘যদিও গুম-খুন ও গুলির আতঙ্ক রয়েছে। তার পরও কৌশল অবলম্বন করে রাজপথে থাকার পদক্ষেপ নিতে হবে।’
হাফিজ আরও বলেন, ‘দেশনেত্রী খালেদা জিয়া যদি এত প্রতিকূলতার মধ্যেও দুই মাসের বেশি সময় নিজে অবরুদ্ধ অবস্থায় আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারেন, তাহলে আমরা যারা অবরুদ্ধ নই, তারা নিজ নিজ অবস্থানে থেকে ম্যাডামের নির্দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কর্মসূচি সফল করতে ভূমিকা রাখতে পারবেন না কেন? যারা ম্যাডামের সর্বশেষ নির্দেশেও সাড়া দেবে না, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। তৃণমূল নেতাকর্মীরা তাদের দলে দেখতে চায় না।’
টাঙ্গাইল জেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম স্বপন বলেন, ‘আমরা তৃণমূল নেতাকর্মীরা দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে মৃত্যুর আতঙ্ক নিয়েও কর্মসূচি পালন করে থাকি। পুলিশ, র্যাব ও আইনশঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সরকারি দলের সন্ত্রাসীদের হামলা সত্ত্বেও আমাদের রাজপথে থাকার চেষ্টা অব্যাহত আছে। কিন্তু দলের অনেক প্রভাবশালী নেতা আন্দোলনের এ চরম মুহূর্তেও নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। এ নেতারাই বিগত সময়ে দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।’
স্বপন বলেন, ‘ম্যাডাম শুক্রবার এ সব নেতাদের উদ্দেশেই সর্বশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। এখনো সময় আছে, তাদের সক্রিয় হওয়ার। না হলে ভবিষ্যতে তৃণমূল নেতাকর্মীরা এ সব সুবিধাবাদী নেতাদের কোনো ছাড় দেবে না।’
ফরিদপুর জেলা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘বিএনপিতে অনেক সুবিধাবাদী নেতা রয়েছেন। অতীতে দল ক্ষমতায় থাকার সময়ে অবৈধভাবে নিজেরা বিপুল পরিমাণ বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন। গড়েছেন অঢেল সম্পদ। এখন দলের ক্রান্তিকালেও তারা সে সব সম্পদকে পাহারা দিতে আন্দোলনে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘ম্যাডামের বক্তব্যে (শুক্রবারের সংবাদ সম্মেলন) তৃণমূল নেতাকর্মীরা খুশি হয়েছেন। তিনি নিষ্ক্রিয় সুবিধাবাদীদের প্রতি সর্বশেষ নির্দেশ দিয়েছেন আন্দোলনে সক্রিয় হওয়ার। এখনো যদি সে সব সুবিধাবাদী নেতা সক্রিয় না হন, তাহলে আমরা তৃণমূল নেতাকর্মীরা হাইকমান্ডের কাছে দাবি জানাচ্ছি— আর সুযোগ না দিয়ে অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হবে।’
জাহাঙ্গীর আরও বলেন, ‘যে কোনো আদর্শিক আন্দোলন কখনো ব্যর্থ হয় না। দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যে আন্দোলন চলছে আমরা বিশ্বাস করি, তা ব্যর্থ হবে না। আমরা তৃণমূল নেতাকর্মীরা ম্যাডামের কাছে দাবি জানাচ্ছি বিজয় না হওয়া পর্যন্ত তিনি যেন এ আন্দোলন থেকে পিছু না হটেন।’
এদিকে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ২০ দলীয় জোটের অবস্থান নিয়ে শুক্রবার (১৩ মার্চ) সংবাদ সম্মেলন করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপির চলমান আন্দোলনে এখনো অনেক নেতাকর্মী যে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন এমন প্রসঙ্গও উঠে এসেছে তার সে দিনের বক্তব্যে। তিনি নিষ্ক্রিয় নেতাদের অনতিবিলম্বে আন্দোলনে শরিক হওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘আমি এ আন্দোলনে দল-মত-পেশা-শ্রেণী নির্বিশেষে সকল ব্যক্তি ও শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে শামিল হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। আমার আহ্বান, যারা এখনো নিষ্ক্রিয় আছেন, তারা সক্রিয় হোন। নিজ নিজ অবস্থান ও এলাকায় আন্দোলন গড়ে তুলুন। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে তুলুন বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘সামনে মহান স্বাধীনতা দিবস। জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। সেই স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে, জনগণের স্বাধীনতা এবং মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের তেমন জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। আজকের সংকট সমাধানের চাবিকাঠি ক্ষমতাসীনদের হাতে। সংকট নিরসনের মাধ্যমে তারা সেই কাঙ্ক্ষিত জাতীয় ঐক্যের পথ খুলে দিতে পারে। তাহলেই আমরা সংকটমুক্ত হয়ে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতির ৪৫তম স্বাধীনতা দিবস পালন করতে পারব।’
তৃণমূল নেতাকর্মীদের দাবির সঙ্গে অনেকটা একমত পোষণ করলেও আন্দোলনে সিনিয়র নেতারা সক্রিয়ই আছেন বলে দাবি করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের অন্যতম উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান।
তিনি বলেন, ‘সিনিয়র নেতাদের আন্দোলনে সক্রিয়তার দাবি তৃণমূল নেতাকর্মীরা করতেই পারেন। এ দাবিও যৌক্তিক। তবে সিনিয়র নেতারা সক্রিয়ই আছেন। এরপরেও যারা নিষ্ক্রিয় আছেন আশা করি, তাদের সক্রিয় হওয়ার বিষয়ে ম্যাডাম যে আহ্বান জানিয়েছেন তা পালন করে তারা দলীয় আনুগত্যের প্রমাণ দেবেন।’
এ্যাডভোকেট আযম আরও বলেন, ‘ইতিহাস সাক্ষী যে কোনো আন্দোলনে মূল ভূমিকা পালন করে দেশের ছাত্র ও শ্রমিক সমাজ। বিগত কয়েক বছর ধরে এদের সঙ্গে যোগ হয়েছে যুব ও স্বেচ্ছাসেবক নেতাকর্মীরা। সেই ১৯৬৭ সাল থেকে ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনকারী অনেক আন্দোলনেই আমরা এটা দেখে আসছি। সিনিয়র নেতারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন, পরামর্শ দেন। কিন্তু রাজপথে মূল দায়িত্ব কিন্তু তরুণরাই পালন করে থাকেন। কারণ যারা প্রবীণ, সিনিয়র বয়সের ভারে কাবু, তারা তো মিছিলে আছাড় খাওয়ার ভয়ে থাকবেন, পুলিশের লাঠিচার্জের ভয় পাবেন এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু তরুণরা তো এসবের ভয় পায় না। তাই দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যে আন্দোলন চলছে তাতে আগের মতোই ছাত্র, তরুণ, যুবকদেরই মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে। সিনিয়ররাও নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে, পরামর্শ দিয়ে, নেতৃত্ব দিয়ে আন্দোলনকে বেগবান করবেন।’