দম্পতিমেলায় অভূতপূর্ব মিলনমেলা
বইমেলা, বাণিজ্যমেলা, পৌষমেলা, বৈশাখী মেলা, বৃক্ষমেলা, ঘুরির মেলাসহ কত মেলার নামেই হয়তো আপনি শুনেছেন। কিন্তু দম্পতি মেলা? হয়তো ভাবছেন-এ আবার কী? রবিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে আগত দেশের নব্বই দম্পতির উপস্থিতিতে এমনই একটি মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মিলনায়তনে।
নিজের সঙ্গীকে নতুন করে চিনে নিতে, নিজের জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিতে তথা দাম্পত্য জীবনের সুখ-দুঃখকে ভাগাভাগি করে নিতে এ যেন এক ভিন্ন আয়োজন, ভিন্ন অনুভূতি। ‘সুখী দাম্পত্য জীবন সমৃদ্ধ আগামী ভুবন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এমন দম্পতিরা এসেছেন যারা প্রায় একসঙ্গে ৫০ বছর সংসার করছেন; আবার এমনও দম্পতি আছেন যারা বিয়ে করেছেন মাত্র কয়েক মাস বা বছরখানেক আগে। পুরনো দম্পতিরা যেমন তাদের দাম্পত্য জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন তেমনি নতুন অনেক দম্পতি জানিয়েছেন তাদের জীবনের এই নতুন পথচলার কথা। অনেকে আবার অনুষ্ঠানস্থলে মালাবদল করেছেন বিয়ের দিনের মতোই। অনেকে আবার একে অপরকে পরিয়ে দিয়েছেন রাখি। দম্পতি সোসাইটি আয়োজিত এ মেলায় আগত সবার মুখেই ছিল অফুরন্ত হাসি।
ফেলে আসা দাম্পত্য জীবনের বর্ণনা শেষে যখন গলায় তুলে নেন রবীন্দ্রনাথের ‘তোমায় গান শোনাব…’ তখন মেলায় আগত সকল দম্পতি একে অন্যের দিকে তাকিয়ে ভালবাসার এক অন্য আবেগে জড়িয়ে পরেন।
আয়োজকদের ভাষ্য-‘১৫ মার্চ চৈত্রের প্রথম দিন। ফাগুন ও চৈত্রের মিলনে বসন্ত। যৌবন মানবজীবনের বসন্তকাল। তাই এই দিনটি মিলনবিন্দু। দম্পতি সোসাইটি মনে করে দাম্পত্য সাধনা মানবজীবনের চরমতম সাধনা।’ তাই এ দিনটিকে দম্পতি দিবস ঘোষণারও দাবি জানান তারা।
দাম্পত্য মেলার ভিন্ন আকর্ষণ হলো অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের অভিজ্ঞতার কথা। স্বভাবজাত প্রক্রিয়া অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘মধ্যযুগে আমাদের যত কাহিনীকাব্য আছে, সব জায়গায় আলাদা একটি জায়গা রাখা ছিল, সেটি হচ্ছে সতীগণের পতিনিন্দা। যা পড়লে মনে হয় স্ত্রীদের কাজই হচ্ছে সারাক্ষণ পতিদের নিন্দা করা। মনে হয় সব স্ত্রীরাই বলে থাকেন, আগে জানলে তোমার মতো লোককে বিয়েই করতাম না।’
বিয়ে ব্যাপারটাতেই একধরনের ডিপ্রেশন আছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘মানুষ পৃথিবীতে আসে সবার জন্য, কিন্তু বিয়ে করামাত্র একজনের হয়ে যেতে হয়। এটা তো ডিপ্রেশনই। একসময় মেয়েরা বিয়ে করত, ছেলেদের বিয়ে হত। কারণ সম্পদ ছিল মেয়েদের হাতে। কোনো সমস্যাও তখন ছিল না। কালক্রমে ছেলেরা সম্পদের মালিকানা পায়। এখন তারা করে। মেয়েদের হয়।’
ফরাসি সাহিত্যিক লা রশেফুকো’র ভাষায় তিনি বলেন, সুবিবাহের কথা অনেক শোনা যায়, সুখকর বিবাহের কথা কম শোনা যায়। আমরা সুখকর বিবাহের কথা শুনতে চাই।’
অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, ‘বিচ্ছেদ ব্যাপারটা খুব বেদনাদায়ক, আজকাল তাই হচ্ছে। ফলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে দেখা দিচ্ছে যারপরনাই অশান্তি। আমরা ব্যক্তিগত জীবনে কোনদিন বিচ্ছেদের কথাটা ভাবিনি, ভাবতেও পারবো না কোনদিন। এরপর স্ত্রী নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসানকে নিবেদন করে গেয়ে শোনান ‘তোমায় গান শোনাব…রবি ঠাকুরের গানটি।’
মেলায় ৫০ বছর পূর্ণকারী ৮ দম্পতিকে সম্মাননা দেওয়া হয়। তারা হলেন : মুস্তাফা মনোয়ার ও মেরী মনোয়ার, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ও রওশনারা সায়ীদ, হায়াত মামুদ ও ফিরোজা বেগম, সৈয়দ হাসান ইমাম ও লায়লা হাসান, মফিজুদ্দিন আহমেদ ও ফেরদৌস আকতার লিলি, এম শামসুল হুদা ও রোকসানা হুদা, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ ও জিনাত বরকতুল্লাহ এবং নাজমুল হুদা বাচ্চু ও লীনা নাজমুল।
অনুষ্ঠানের নানা পর্যায়ে দম্পতিরা তাদের যুগল জীবনের অনুভূতি ব্যক্ত করেন। এরপর শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গান পরিবেশন করেন শিল্পীরা। ব্যান্ড পালস ব্যতিক্রমী এই আয়োজনের সহযোগিতায় ছিল।
জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। ফিতা কেটে মেলা উদ্বোধন করেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ ও রওশনারা সায়ীদ দম্পতি। এরপর স্বলিখিত কবিতা পাঠ করেন কবি লিলি হক।