উত্তাল ১৭ মার্চ, ১৯৭১: জেনারেলদের সঙ্গে ইয়াহিয়ার বৈঠকে বাঙালি হত্যার নীলনকশা
নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পরও আওয়ামী লীগের হাতে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা হস্তান্তর না করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আলোচনার নামে টালবাহানা করতে থাকেন। একই সাথে সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে বাঙালি হত্যার ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকেন।
১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ আবারও বৈঠকে বসেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান। আলোচনায় আওয়ামী লীগ প্রধান জনসাধারণের গণতান্ত্রিক রায়ের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলেন এবং ছয় দফার ভিত্তিতে প্রস্তাবিত সংবিধান প্রণয়নের যৌক্তিকতার কথা বলেন।
স্বাধীনতার প্রশ্নে বীর বাঙালীর অকুতোভয় সংগ্রাম আর রণপ্রস্তুতিতে পাক প্রেসিডেন্টের বুঝতে বাকি থাকে না পাকিস্তানের অখণ্ডতা আর রক্ষা করা সম্ভব নয়। পূর্ব পাকিস্তানে আর তার (ইয়াহিয়া খান) নিয়ন্ত্রণ নেই।
এদিন রাতে প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়ার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর টিক্কা খানের স্বল্পকালীন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। রাত ১০টায় টিক্কা খানের জিওসি মেজর জেনারেল খাদেম হোসেন রাজাকে চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। ঢাকায় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেনারেলদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রণীত হয় বাঙালি হত্যার নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’।
১৬ মার্চ শুরু হওয়া ইয়াহিয়ার ও শেখ মুজিবের আলোচনা শেষ হয় এ দিন। আলোচনার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে কোনো তথ্য জানানো হয়নি। দৈনিক পূর্বদেশে ১৭ মার্চের আলোচনা নিয়ে ১৮ মার্চ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ প্রধান (শেখ মুজিবুর রহমান) তার ধানমন্ডি বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনার এক পর্যায়ে জনৈক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে এবং লক্ষ্যে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে।’
প্রতিবেদনে জানানো হয়, নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল (১৭ মার্চ) কালো পতাকা সজ্জিত একটি সাদা টয়োটা গাড়িতে করে প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রবেশ করেন এবং এক ঘণ্টা পর বেরিয়ে আসেন। প্রেসিডেন্ট ভবন ফটকে বিপুল সংখ্যক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক তাকে ঘিরে ধরে আলোচনার অগ্রগতি এবং বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রশ্নবাণ ছুড়তে থাকেন। উত্তরে শেখ সাহেব বিমর্ষ চিত্তে বলেন, আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যে, আমার কিছু বলার নেই।
‘প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে নিজের বাসভবনে ফিরে শেখ মুজিব তার দলীয় নেতৃবৃন্দের সাথে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। এরপর তিনি দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের ঘরোয়াভাবে সাক্ষাৎদান করেন।’
এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। বিদেশি সাংবাদিকরা এ পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে ৫২তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালে তিনি বলেন, ‘১৯২০ সালের ১৭ মার্চ আমার জন্মদিন। আমি জীবনে কখনো আমার জন্মদিন পালন করিনি। আপনারা আমাদের দেশের মানুষের অবস্থা জানেন, তাদের জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই। যখন কেউ ভাবতেও পারে না মরার কথা তখনও তারা মরে। যখন কেউ ইচ্ছে করে তখনও তাদের মরতে হয়।’
‘গভীর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে শেখ মুজিব আরও বলেন, আমার জন্মদিন কি, মৃত্যুদিবসই বা কি? আমার জীবনই বা কি? মৃত্যুদিন আর জন্মদিবস অতি গৌণভাবে এখানে অতিবাহিত হয়। আমার জনগণই আমার জীবন।’
দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত অপর এক প্রতিবেদনে অসহযোগ আন্দোলনের ১৬তম দিনের (১৭ মার্চ) চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ‘এই আন্দোলনের ঢেউ শহর থেকে শহরে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। সভা সমিতি আর শ্লোগানে গ্রাম বাংলা আজ মুখরিত।’
ওই প্রতিবেদনে ‘কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সার্ভিসেস ফেডারেশন’, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’, ‘ব্রতচারী আন্দোলন’, ‘টেস্ট ব্যাংক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ’, দেশরক্ষা খাতে বেতনভুক্ত বেসামরিক কর্মচারী’, ‘ঢাকা জিলা সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড’, ‘নোয়াখালী এসোসিয়েশন’, চামড়া ব্যবসায়ী সমিতি, মগবাজার সংগ্রাম পরিষদ, দেশরক্ষা বিভাগে নিযুক্ত বেসামরিক কর্মচারী সমিতির আন্দোলনে একাত্ম হওয়া ও বিভিন্ন কর্মসূচি তুলে ধরা হয়।
পূর্বদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৭ মার্চ চট্টগ্রামে ন্যাপ প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেন, প্রেডিসেন্ট ইয়াহিয়া এবং শেখ মুজিবের মধ্যে আপোষের কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। ইয়াহিয়া এখন সম্পূর্ণ ক্ষমতাহীন। এখন সব ক্ষমতা জনসাধারণ ও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে।’