হোক না তবে আরও একবার…
বলতে দ্বিধা নেই, বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১৫-র দ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতই ফেভারিট। ক্রিকেট ইতিহাস-ঐতিহ্য, রেকর্ড আর দলীয় শক্তির বিচারে তারাই এগিয়ে। আসরের বর্তমান চ্যাম্পিয়নও তারা। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে দ্বিপাক্ষিক ও ত্রিদেশীয় সিরিজে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের কাছে চরমভাবে নাস্তানাবুদ হলেও বিশ্বকাপের আসরে পাল্টে গেছে টিম ইন্ডিয়ার চেহারা। আফগানিস্তানের সঙ্গে প্রস্তুতি ম্যাচ দিয়ে সেই যে শুরু, মূল আসরে ভারতের জয়রথ ছুটছে তো ছুটছেই। ৬-এ ছয় জয় নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল। নকআউটের এই লড়াইয়ে তাদের সামনে বাংলাদেশ।
ক্রিকেটীয় বিচারে শক্তিধর দলগুলোর মধ্যে কোয়ার্টার ফাইনালে কাগজে-কলমে সবচেয়ে দুর্বল প্রতিপক্ষের মুখোমুখি ভারত। লড়াইটা কি তাহলে একতরফা হবে? বিশ্বকাপের আগে এমন প্রশ্ন করলে বিশ্লেষকরা এক কথায় বলে দিতেন, ভারত সেমিফাইনাল খেলছে নিশ্চিত। কিন্তু কী আশ্চর্য! কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের আগে ক্রিকেট বোদ্ধাদের কারো কলামেই নেই বাংলাদেশের উড়ে যাওয়ার শঙ্কা। ক্রিকইনফো স্টারস্পোর্টসের বিশ্লেষকরাও টাইগারদের আগাম বিদায় জানাচ্ছেন না। ভারতীয় গণমাধ্যমে এখনই সেমিফাইনালের প্রতিপক্ষ নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে না। অতি উৎসাহীরা ‘মওকা…মওকা’ বলে লাফালেও ভারতীয় সমর্থকরাও বাংলাদেশকে হিসাবের বাইরে রাখতে পারছেন না।
ক্রিকেটে ‘কুলীন’ আর ‘মিনোসে’র এই লড়াই নিয়ে সব মহলের সতর্কতা শুধু এ জন্য নয় যে, ক্রিকেট গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা এবং ভাল দিনে যে কোনো দল যে কারো সঙ্গে হারতে পারে। বাংলাদেশকে নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বের সমীহের কারণ এই নয় যে, ২০০৪, ২০০৭ আর ২০১২ সালে ভারতকে হারিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ। বরং ২০১৫ বিশ্বকাপের নৈপুণ্যের কারণেই সম্ভাব্য সেমিফাইনালিস্টের তালিকা থেকে বাংলাদেশের নাম এখনই ছেঁটে ফেলা যাচ্ছে না।
চলতি বিশ্বকাপ ঘিরে আশা ছিল, দুই সহযোগী দেশ আফগানিস্তান আর স্কটল্যান্ডকে হারানোর। এরপর বড় কোনো দলকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার চেষ্টা। ব্যাটে-বলে দাপটের সঙ্গে সব অঙ্ক মিলিয়ে এক ম্যাচ হাতে রেখেই নকআউট পর্বে পা রেখেছে টাইগাররা। প্রকৃতির দাক্ষিণ্যে অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে এক পয়েন্ট পেলেও তা আসলে প্রয়োজনই ছিল না। শ্রীলঙ্কা ম্যাচ বাদ দিলে প্রথম পর্বজুড়ে বাংলাদেশী ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্স কারো চেয়েই ফেলনা ছিল না। রিয়াদ ও মুশফিকের ধারাবাহিকতার পাশে ব্যাটিংয়ে সৌম্য, সাব্বির ও সাকিব রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। প্রত্যাশার বেলুন চুপসে দিলেও স্কটল্যান্ডের বিশাল রান টপকাতে তামিম ইকবালের ৯৫ রানের অনবদ্য ইনিংসটির কথা ভুলে গেলে চলবে না।
বিশ্বকাপের এখন পর্যন্ত শীর্ষ ৫ ব্যাটসম্যানের তালিকায় মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। টানা ২ ম্যাচে সেঞ্চুরি আর একটি হাফ সেঞ্চুরি নিয়ে তিনি এখন বিশ্বকাপ তারকা। ৫ ম্যাচের তিনটিতে হাফ সেঞ্চুরি করেছেন মুশফিকুর রহিম। দুটি হাফ সেঞ্চুরি আর একটি ৪৯ রানের ইনিংস খেলে মোটামুটি ধারাবাহিক সাকিব। আর রানের চাকা সচল রাখতে তারুণ্যদীপ্ত সৌম্য ও সাব্বির রাখছেন বড় ভূমিকা।
উইকেট বিবেচনায় বিশ্বকাপের পরিসংখ্যানে মাঝারি অবস্থানে থাকলেও এক একটি জয়ে বোলাররা রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সবচেয়ে বড় কথা হল, দলের প্রয়োজনে জ্বলে উঠে ম্যাচ উইনারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন পেসাররা। বিরূপ কন্ডিশনেও প্রতিপক্ষের রানের গতি আটকাতে মোটামুটি সফল স্পিনাররা। সময়ে সময়ে ম্যাচে ব্রেক থ্রু এনে দিয়েছেন অনিয়মিত বোলাররাও। কিছু ভুল ত্রুটি থাকলেও ফিল্ডিংয়ে দেখা যাচ্ছে মরিয়া চেষ্টা। অমার্জনীয় কিছু ক্যাচ ছাড়লেও এবার আর তা খেলোয়াড়দের হতাশায় ডুবিয়ে দিচ্ছে না। প্রথম পর্বের এই পারফরম্যান্স ধরে রাখতে পারলে ভারতীয়দের বিশ্বকাপ ছাড়া করা অসম্ভব হবে না।
৬ ম্যাচে ৬০ উইকেট নিয়ে ভারতীয় বোলাররা নিজেদের অপবাদ ঘুচিয়ে ফেলেছেন। সামি, মোহিত শর্মা, উমেশ যাদব, রবিচন্দ্র অশ্বিন আর রবিন্দ্র জাদেজার সমন্বয়ে ভারতীয় বোলিং যেনো এই বিশ্বকাপের নতুন বিস্ময়। কারণ বোলিং নয়, ব্যাটিংকেই ধরা হয় তাদের মূল শক্তি। কিন্তু এই বিশ্বকাপে বোলাররা যা করছে- তাতে ব্যাটসম্যানদের খুব একটা বেগ পেতে হচ্ছে না। এরপরও যখন যার প্রয়োজন হয়েছে জ্বলে উঠেছেন শিখর ধাওয়ান, বিরাট কোহলি, সুরেশ রায়না, ধোনিরা। এরমধ্যে শেষ তিন জনের গড় রান ৭০-এর উপর আর ধাওয়ানের ৫০।
মোটের ওপর যাকে ব্যর্থ বলা হচ্ছে সেই ওপেনার রোহিত শর্মার গড়ও ৩২।
পরিসংখ্যানে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। ব্যাটসম্যানদের সবাই কম বেশি রান পেয়েছেন। বোলাররা ৫ ম্যাচে নিয়েছেন ৩২ উইকেট। এই বিশ্বকাপে টাইগাররা খেলছে দারুণ একটি দল হিসেবে; ‘টিম বাংলাদেশ’।
আগের মতো আর চাপে ভেঙে পড়ছে না। শুরুতে উইকেট পড়ে গেলে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ার পুরনো রোগটাও সারিয়ে ওঠছে বলে মনে হচ্ছে। প্রতিটি ম্যাচেই জুটি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। তাই তো প্রথম পর্বে দলের সর্বনিম্ন স্কোর ২৪০।
বোলিংও এবার একেবারে খেই হারাচ্ছে না। শুরুতে উইকেট ফেলে প্রতিপক্ষকে চেপে ধরা এবং মাঝে-মধ্যে ব্রেক থ্রু এনে দিতে অধিনায়কের হাতে অনেক অপশন দেখা যাচ্ছে। এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে ভারতকে রুখে দেওয়া অবশ্যই সম্ভব।
স্বপ্নের সীমানাকে ছাড়িয়ে যেতে হলে চাই মানসিক দৃঢ়তা। এ জন্য দল নিয়ে আর কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলবে না। গ্রুপ পর্বের শুরু থেকেই ওপেনিং জুটি নিয়ে চলছে নানা সমালোচনা। এ নিয়ে এখন তো মতের শেষ নেই। তিন পেসার, নাকি স্পেশালিস্ট স্পিনার- এ নিয়েও আছে বিস্তর আলোচনা। নাসির নাকি আরাফাত সানি- এখানেও দ্বিধা-বিভক্ত ক্রিকেট ভক্তরা। কিন্তু বিশ্বকাপের মতো আসরের কোয়ার্টার ফাইনালে বড় কোনো পরিবর্তন দলের জন্য শুভ হবে বলে মনে হয় না। দুই ম্যাচে ব্যর্থ হলেও ওপেনিংয়ে তামিম-ইমরুলই এই দলের সেরা। ইনিংসের সূচনায় ভারতীয় বোলারদের সামলাতে তামিমের চেয়ে কার্যকর কেউ নেই। তাদের কাছে বড় একটা ইনিংস পাওনা হয়ে গেছে। সেই পাওনা তামিম কিছুটা মেটাতে পারলেও ভারতের জন্য নেমে আসতে পারে হতাশা। ইমরুল হয়তো এখন অনেকটাই কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন। মরণ-বাঁচনের ম্যাচে তার কাছ থেকেও একটা বড় ইনিংস আশা করা বাড়াবাড়ি হবে না। সৌম্য ও রিয়াদ নিউজিল্যান্ডের ম্যাচের ধারাবাহিকতা ধরে রাখলে এবং মুশফিক ও সাকিব নামের প্রতি সুবিচার করলে সম্ভব হবে বড় ইনিংস গড়া।
এক ম্যাচ পর অধিনায়ক মাশরাফি ফিরছেন এবং সেটা তাইজুলের জায়গায় হওয়াই ভাল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের জয়ী দলটাই হুবহু রাখা হবে কি না- মেলবোর্নের আবহাওয়া ও পিচের কন্ডিশন দেখেই হয়তো টিম ম্যানেজমেন্ট সিদ্ধান্ত নেবেন। এক্ষেত্রে শুধু বিবেচনা হওয়া উচিত, আরাফাত সানির জায়গায় নাসিরকে নেওয়া হবে কি না? এর বেশি পরিবর্তন করে খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাসে চির ধরানো ঠিক হবে না।
প্রত্যাশার আকাশ চুম্বি হলেও, এই ম্যাচে বাংলাদেশের হারানোর কিছু নেই। এটাই সবচেয়ে শক্তির জায়গা। মেলবোর্নের ৯০ হাজার দর্শকের সিংহভাগই হবেন ভারতীয়। তাদের হুঙ্কার মাশরাফিদের চাপ বাড়ালেও ভারতীয় দলের জন্যও তা বুমেরাং হতে পারে। বাংলাদেশ শুরুর দিকে কিছুটা চেপে ধরতে পারলে গ্যালারি আর দেশের মানুষের প্রত্যাশার বড় চাপ ভর করতে পারে ধোনিদের ওপর। সেক্ষেত্রে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের শুরুতেই পরাজয়ের বাতারবরণ তৈরী করতে পারলে, সেখান থেকে বেরোনো ভারতীয়দের জন্য সহজ হবে না।
বিশ্ব ক্রিকেটের তিন মোড়লের শীর্ষনেতা ভারতের বিপক্ষে এই ম্যাচে ক্রিকেটের বাইরেও কিছু ফ্যাক্টর কাজ করবে- নিশ্চিত। বিশ্বকাপের মতো আসরের নকআউটের শুরুতেই ভারত বেরিয়ে গেলে তা ক্রিকেট বাণিজ্যের জন্য সুখকর হবে না। ফলে আইসিসি আর তার স্পন্সররা কায়মনে প্রার্থনা করবে, বাংলাদেশ হেরে যাক। মাঠে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে তা কোনো প্রভাব ফেলবে কি না- সেই সন্দেহ একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে শেষ পর্যন্ত মাঠে ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্সই আসল কথা। গ্রুপ পর্বের শেষ দুই ম্যাচের ধারা বজায় রেখে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা নিজেদের খেলাটা খেলতে পারলে ভারতকে হারিয়ে দেওয়া অসম্ভব হবে না।
এই তো সেদিন ত্রিদেশীয় সিরিজে পরপর ২ ম্যাচে ভারতকে উড়িয়ে দেওয়া ইংল্যান্ডকে মাটিয়ে নামিয়ে এনেছে টিম বাংলাদেশ। ৫ ম্যাচের ৪টিতেই প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দেওয়া নিউজিল্যান্ডকে কাঁপিয়ে দিয়েছেন মাশরাফিরা। ভারতের সঙ্গেও সম্ভব। এখন শুধু প্রয়োজন গ্রুপ পর্বের পারফরম্যান্সটা ধরে রাখা, ভুলগুলো শুধরে নেওয়া আর মনোবলটা ঠিক রাখা। তাহলেই হয়তো আবারও খুশির জোয়ারে ভাসবে বাংলাদেশ…।