আড়াই মাসে আওয়ামী লীগের ২৫ নেতাকর্মী খুন
গত প্রায় আড়াই মাসে সারা দেশে আওয়ামী লীগের ২৫ নেতাকর্মী খুন হয়েছেন। এগুলো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করেছে নিহতদের পরিবার ও ক্ষমতাসীনরা। তাদের অভিযোগ দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতেই এ ধরনের হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে।
এর মাধ্যমে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বিএনপি-জামায়াত। আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিআরআইয়ের (সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন) হিসাব মতে ৩১ ডিসেম্বর থেকে ৮ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে কমপক্ষে ২৫ নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে।
এরমধ্যে ১২ জনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গুলিতে নিহত হয়েছেন ৪ জন, গলাকেটে ৪ জন, পিটিয়ে ৩ জন, আগুনে পুড়িয়ে ১ জন এবং শ্বাসরোধ করে ১ জনকে হত্যা করা হয়েছে।
তবে ৮ মার্চের পর থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৩০ ছাড়িয়ে যাবে বলে প্রাথমিভাবে খবর পেয়েছে সিআরআই।
এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন শতাধিক নেতাকর্মী। নৃশংসতা থেকে রক্ষা পায়নি স্কুলছাত্রও। যৌথ বাহিনী অভিযান চালানোর পর প্রতিশোধ নিতে আওয়ামী লীগ নেতার ছেলে ওই স্কুলছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের ঘটনা।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ মঙ্গলবার বলেন, বিএনপি-জামায়াতের লক্ষ্য ছিল সরকারকে অস্থিতিশীল করা। এ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তারা অবরোধ-হরতালের নামে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করেছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা করে জনমনে আতংক তৈরি করতে চেয়েছে। এভাবে তারা সরকারের পতন ঘটাতে চেয়েছিল। কিন্তু সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
তিনি জানান, যেসব আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন- তাদের পরিবারকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। আর খুনিদের গ্রেফতারের পাশাপাশি আইনের আওতায় এনে বিচারের ব্যবস্থা করা হবে।
সিআরআইয়ের গবেষণাপত্রে নিহত ২৫ জনের নাম, ঠিকানাসহ বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এ গবেষণাপত্র থেকে জানা গেছে, বছরের শেষদিন রাতে (৩১ ডিসেম্বর ২০১৪) কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মণপুর বাজারের বানঘর এলাকায় রাত সাড়ে ১০টার দিকে শাহ আলম নামের স্থানীয় ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সভাপতি শাহ আলমকে (৩২) কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তার পরিবারের ধারণা, এটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড।
২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় জামাল উদ্দিন (৩০) নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মীকে গুলি করে হত্যা করে ছাত্রশিবির।
৮ জানুয়ারি লক্ষ্মীপুরের যুবলীগ কর্মী ইউসুফকে ২০ দলীয় জোটের অবরোধকারীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে কানসাট বিএন বাজারে ৯ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৮টায় মোবারকপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কর্মী মুকুল বিশ্বাসকে (৩০) পিটিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় মুকুলের সঙ্গে থাকা আরও দুজন গুরুতর আহত হন। খবর পেয়ে শিবগঞ্জ থানা পুলিশ বিজিবির সহায়তায় মুকুলের লাশ একটি আমবাগান থেকে উদ্ধার করে।
অবরোধ চলাকালে ১২ জানুয়ারি রাত ৯টার দিকে ফেনীর সোনাগাজী-মুহুরী প্রজেক্ট রাস্তার অশ্বিনীয়া পোল এলাকায় পিকেটারদের সঙ্গে যুবলীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ বাধে। পিকেটাররা যুবলীগ কর্মী মোবারক হোসেন ও সোনাগাজী ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক বেলাল হোসেনকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বেলালের মৃত্যু হয়।
সিআরআইয়ের গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, যৌথ বাহিনীকে সহযোগিতা করায় প্রতিশোধ নিতে ১৭ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার ছেলে নবম শ্রেণীর ছাত্র রাজন আলী রকিকে (১৫) পিটিয়ে হত্যা করে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। নিহত রকি শিবগঞ্জ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও শেখটোলা মহল্লার রুহুল আমিনের ছেলে। সে স্থানীয় বাবুপুর-উজিরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র ছিল।
কুমিল্লার সদর উপজেলার কালিবাজার ইউনিয়নের উজিরপুর গ্রামে ১৭ জানুয়ারি যুবলীগ কর্মী কামরুজ্জামান টিটু খুন হন। তাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত কামরুজ্জামান টিটু ওই উপজেলার ধনুয়াইশ গ্রামের মৃত আবদুর রহিমের ছেলে। তিনি এলাকায় পোলট্রি ফার্মের ব্যবসায়ী।
২০ জানুয়ারি যশোরের মনিরামপুরে শাহিনুর রহমান নামে এক যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। শাহিনুর রহমান কাশিপুর গ্রামের লুৎফর রহমানের ছেলে ও উপজেলা যুবলীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য।
২৩ জানুয়ারি যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলায় হুমায়ুন কবীর (৪০) নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মীর গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বায়শা ও আশিংড়ি গ্রামের মাঝে তালশারি নামক স্থান থেকে তার গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়।
নিখোঁজের ৬ দিন পর ২৪ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার এনায়েতনগর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের সভাপতি মোখলেছুর রহমানের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
৩১ জানুয়ারি মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও চার নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মজির উদ্দিনকে (৫০) কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
৩১ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১২টার দিকে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার হাইতকান্দি ইউনিয়নের জগদীশপুর গ্রামের এতিম আলীর বাড়িতে একাধিক ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চারদিকে আতংক সৃষ্টি করে সশস্ত্র ২৫-৩০ জন মুখোশ পরা দুর্বৃত্ত প্রবেশ করে। দুর্বৃত্তরা যুবলীগ কর্মী মহিউদ্দিনকে কোপায় এবং গায়ে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে এসে নিহত মহিউদ্দিনের ভস্মীভূত মরদেহ উদ্ধার করে। রাজনৈতিক শত্র“তায় জামায়াত ও শিবিরের লোকজন এ হামলা চালায় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।
৩ ফেব্রুয়ারি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. রুবেলকে (৩০) গলাকেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহত রুবেল দত্তপাড়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমানে যুবলীগ কর্মী।
৬ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার পাথৈর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি জয়নাল আবেদীনকে (৬৫) বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে খুন করা হয়।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামে ৭ ফেব্রুয়ারি শনিবার রাত ৮টার দিকে যুবলীগ নেতা বাবর হোসেনকে (২৩) গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তিনি পূর্ব দিঘলী গ্রামের মফিজ উল্লার ছেলে।
৮ ফেব্রুয়ারি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রনজু প্রামাণিককে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। উপজেলার ফুলতলা এলাকায় নিজ বাড়ির কাছে খুন হন তিনি। নিহত রনজু ফুলতলা বাজার এলাকার মৃত শুকুর প্রামাণিকের ছেলে।
৯ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালী সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য ও চরমটুয়া ইউনিয়ন কমিটির সহসভাপতি এবং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য বাবুল মিয়া ওরফে বাবুল মেম্বারকে (৫৫) কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
১২ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা যুবলীগ নেতা আবদুল হামিদ ওরফে হিরু মিয়াকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। সরিষার খেত থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।
১৬ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দায় যুবলীগ কর্মী জুয়েল মিয়াকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। তার লাশ বিল থেকে উদ্ধার করা হয়।
২০ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে আওয়ামী লীগ কর্মী আবুল কালাম আজাদ ওরফে আবদুর রহমান এডুকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহত আবুল কালাম আজাদ নাশকতা সৃষ্টিকারী ব্যক্তিদের তথ্য পুলিশকে জানানোর কারণে জামায়াত-বিএনপির কর্মীরা তাকে হত্যা করেছে বলে দাবি দলীয় সহকর্মীদের।
২২ ফেব্রুয়ারি মুন্সীগঞ্জে আদালতে হাজিরা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে আওয়ামী লীগ কর্মী হোসেন মৃধা (৪০) খুন হন। এলোপাতাড়ি কুপিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।
২৪ ফেব্রুয়ারি যশোরের সদর উপজেলার ইছালি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও ওই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেনকে (৬০) গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
৪ মার্চ লক্ষ্মীপুরে আরিফুর রহমান ফরহাদ (৩৫) নামে এক যুবলীগ নেতাকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ হত্যাকাণ্ডের জন্য বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করা হয়েছে।
৫ মার্চ বগুড়ায় মনিরুজ্জামান মানিক (২৮) নামের এক যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। হামলাকারীদের মধ্যে থাকা এক ছাত্রদল কর্মীও আহত হয়।
৮ মার্চ পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার নন্দনপুর ইউপির সাবেক সদস্য ও আওয়ামী লীগ কর্মী মকুল হোসেনকে (৪৫) গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তিনি দাড়ামুধা গ্রামের মৃত নওশের আলীর ছেলে।
সূত্র: যুগান্তর