এই আন্দোলন কার বিরুদ্ধে? আব্দুল কাইয়ুম
বিএনপির ভাষায় দোষ করেছে আওয়ামী লীগ। ওরা গত বছর বিএনপিকে বাদ দিয়ে একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতার ধারা অব্যাহত রেখেছে। তাই তাদের ‘শাস্তি’ পেতে হবে। কিন্তু কী ব্যবস্থাপত্র দিল ওরা? একটানা অবরোধ, তার সঙ্গে সপ্তাহে পাঁচ দিন হরতাল। শাস্তি পাচ্ছে কে? আওয়ামী লীগ বা সরকারকে তো কাবু করতে পারছে না। প্রায় আড়াই মাস হতে চলল। গদিচ্যুত হওয়া তো দূরের কথা, গদি নড়েও না। তাহলে এই দাওয়াইয়ে লাভ কী? মাঝখান থেকে মানুষ পেট্রলবোমায় পুড়ে মরছে। গাড়ি পুড়ছে। রেলগাড়ি লাইনচ্যুত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিহত ব্যক্তিদের পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছেন।
বিএনপি সরকার পতনের আন্দোলন করে, আর শাস্তি পায় জনগণ। পাঁচ-সাত-দশ দিন ধুমসে আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটিয়ে সব ঠিকঠাক করে ফেললেও না হয় একটা সান্ত্বনা ছিল। মানুষ বলত, যাক, নাশকতার আন্দোলন থেকে বাঁচা গেল! কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না।
এ অবস্থায় আন্দোলনের কৌশল নিয়ে বিএনপির চিন্তা–ভাবনা করা প্রয়োজন। দলের চেয়ারপারসন যদি তাঁর ভাষণে যুদ্ধবিরতির মতো একধরনের অবরোধ-বিরতির ঘোষণা দিতেন, তাহলে হয়তো পরিস্থিতি সমাধানের দিকে যেতে পারত। তিনি বলতে পারতেন, ২৬ মার্চের মধ্যে আলোচনায় বসতে হবে, সে জন্য এই সময়টুকু অবরোধ-হরতাল স্থগিত থাকবে। তার পরও যদি সরকার গা না লাগাত, ধরপাকড়, জেল-জুলুম একই কায়দায় চালিয়ে যেত, তখন বিএনপির পক্ষে জনমত আরও বেশি সোচ্চার হতো।
প্রশ্ন উঠবে, বিএনপি এত নরম হলে আওয়ামী লীগ কি ছেড়ে দিত? আরও দমন-পীড়ন চালিয়ে বিএনপিকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিত না? কিন্তু তাদের দলের অবস্থা কি এতই খারাপ? তাহলে কোন শক্তিতে ওরা টানা অবরোধ-হরতালের কর্মসূচি দিয়ে চলেছে? দেখছে লোকে মানে না, তাও যান্ত্রিকভাবে অবরোধ চালিয়ে যেতে হবে?
অবরোধ ও হরতালের মতো চূড়ান্ত ধরনের আন্দোলন একটানা বেশি দিন চালিয়ে যাওয়া যায় না। এটা আমাদের নিকট অতীতে অনেক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে। এ কারণে গণ-আন্দোলনে বিরতি দিতে হয়। এক-দেড় মাসের প্রস্তুতি নিয়ে এক দিনের হরতালেও অনেক সময় অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যায়। সাধারণ মানুষ রাজপথে নেমে আসে। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। কিন্তু হরতাল-অবরোধে যখন মানুষ রাস্তায় নামে না, বরং জনজীবন প্রায় স্বাভাবিক থাকে, তখন বুঝতে হবে কোথাও গড়বড় আছে। বুদ্ধিমান হলে আন্দোলনের কৌশল নিয়ে নতুন কিছু চিন্তাভাবনায় বসতে হবে। বিএনপির মধ্যে সেই মুনশিয়ানার খুব অভাব।
সরকার নিস্তেজ হরতাল বন্ধ করার জন্য বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের হাজার হাজার কর্মীকে পাইকারি হারে গ্রেপ্তার করছে। মামলা দিচ্ছে। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিনকে সাদাপোশাকের লোকজন ধরে নিয়ে গেল। পুলিশ বলছে, তারা জানে না। তারাও খুঁজে বের করার মহান দায়িত্ব নিয়েছে। এসব কেউ সমর্থন করে না। কিন্তু পেট্রলবোমা মেরে বিএনপিই সরকারের হাতে এ ধরনের জোর-জুলুম নির্বিবাদে চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। এখন ওদের চিন্তা করে দেখতে হবে, এই সুযোগ আর কত দিন দেবে!
তাহলে কি বিএনপি আন্দোলন-প্রতিবাদ করবে না? নিশ্চয়ই করবে। কিন্তু মানুষকে সঙ্গে নিতে না পারলে সব মাঠে মারা যাবে। এটা ভুলে গেলে চলবে না। আজ হয়তো মানুষ নানা কারণে রাস্তায় নামছে না। তার মানে এই নয় যে কাল নামবে না। উপযুক্ত রাজনৈতিক কৌশল নিলে মানুষ অবশ্যই নামবে।
এখন সবাই বলে, গত বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি ভুল করেছে। তাদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী ছিল। এ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু এটা তো ঠিক যে গত বছর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপির পক্ষে জনমত যতটা সোচ্চার ছিল, আজ ততটা নেই। কেন নেই? বিএনপির ভুল চালের জন্যই আজ এ অবস্থা।
খালেদা জিয়া তাঁর দীর্ঘ ভাষণে একবারও জামায়াতে ইসলামীর প্রসঙ্গ তুললেন না। জামায়াত তাদের জোটে আছে। ঠিক আছে। কিন্তু যখন পেট্রলবোমা মারা হয়, রেললাইনের ফিশপ্লেট তুলে নিরীহ যাত্রী হত্যা করা হয়, তখন তো এটা পরিষ্কার যে নাশকতা চলছে। খালেদা জিয়া সব দায় চাপিয়েছেন সরকারের ঘাড়ে। তিনি নিজের দলের ওপর দায় না নিয়ে অন্তত জামায়াতের ওপর কিছু দায় দিতে পারতেন। সবাই জানে, এ ধরনের নাশকতায় জামায়াত-শিবির সিদ্ধহস্ত। পেট্রলবোমার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে জোট থেকে জামায়াতকে বের করে দেওয়ার কথা বলতে পারতেন। তাহলে পরিস্থিতি আজ অন্য রকম হতে পারত।
জামায়াতে ইসলামীর কথা আসে এ জন্য যে আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময় এমন কথা বলেছে। জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করলে সংলাপের কথা চিন্তা করবে বলে তারা বক্তৃতা-বিবৃতিতে বলেছে। বিএনপি সংলাপের কথা এত বলে, অথচ এ সুযোগটা নিতে তাদের খুব অনীহা। তার মানে, বিএনপি মনে করে জামায়াত ছাড়া তাদের চলবে না।
এটা খুব ভালো কথা নয়। যে দলটি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে গণহত্যা চালিয়েছে, বুদ্ধিজীবী হত্যা করেছে, তাদের ছাড়া বিএনপির চলে না, এ রকম ভাবতে খুব অবাক লাগে। কারণ, বিএনপি নিজেরাই বলে ওরা স্বাধীনতার পক্ষের দল।
এখানে অবশ্য বিএনপি বলবে, জামায়াতের সঙ্গে মিলে আওয়ামী লীগও তো ১৯৯৬ সালে আন্দোলন করেছে। হ্যাঁ, সেটা করে খুব খারাপ করেছে। ক্ষমতার রাজনীতির সংকীর্ণ কানাগলিতে আওয়ামী লীগও একসময় আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়েছে। এর পরিণতিতে তাদের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হয়েছে। এর খেসারত তাদের দিতে হয়েছে এবং আগামী বহুদিন পর্যন্ত দিতে হবে।
কিন্তু বিএনপি কেন আওয়ামী লীগের সেই খারাপ রাজনীতিই গ্রহণ করে? প্রকৃতপক্ষে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতায় গিয়ে জিয়াউর রহমানই প্রথম জামায়াত-মুসলিম লীগকে ক্ষমতার অংশীদার করে রাজনীতিতে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সেই ধারাতেই এখনো বিএনপি চলছে।
সুতরাং, সংলাপ একতরফাভাবে আওয়ামী লীগের কাছে আশা করলে সুফল পাওয়া যাবে না। আজীবন অবরোধ-হরতাল চালানোর ভুল সিদ্ধান্ত নিলে আরও ঠকতে হবে। তাই একটা পথ বের করার জন্য মধ্যবর্তী ‘অবরোধ-বিরতি’ দরকার। তখন মানুষ দেখবে, আওয়ামী লীগ কী করে। যদি অবিবেচকের মতো দমননীতি চালিয়ে যায়, মানুষ তা ভালো চোখে দেখবে না। সেটাই হবে বিএনপির বড় মূলধন। আর যদি সরকার নরম হয়, তাহলে সংলাপের রাস্তা খুলবে।
বিএনপি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বলে খুব দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। এটা সব মানুষের মনের কথা। কিন্তু গত বছর নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি পানি এত দূর এত ঘোলা করেছে যে সেখানে এখন আওয়ামী লীগ আরামসে মাছ মারছে। তাই হয়তো বিএনপিকে এক কদম পিছিয়ে গিয়ে বলতে হবে, সংবিধান আর কাটাছেঁড়া না করে, বিগত নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন সরকারের যেসব প্রস্তাব দিয়েছিল, সেগুলো নিয়ে সংলাপ হোক। নির্বাচনকালীন সরকারে যদি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব থাকে, যদি স্বরাষ্ট্র ও আরও দু-চারটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় বিএনপিকে দেওয়া হয়, যদি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা হয়, যদি প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এর চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য সরকার আর কী হতে পারে?
এ ধরনের প্রস্তাব বিএনপির নিজস্ব কিছু নয়, খোদ আওয়ামী লীগের। ওরাই গত নির্বাচনে বিএনপিকে আনার জন্য বিভিন্ন সময় সংবিধানের মধ্যে থেকেই একটু এদিক ওদিক করে নানা বিকল্পের কথা বলেছিল।
বিএনপি আজ আওয়ামী লীগের সেই প্রস্তাবগুলোই তাদের সামনে হাজির করুক। তারপর দেখি সংলাপ হয় কি হয় না।
এর পরও যদি সংলাপে বাগড়া দেওয়া হয়, তাহলে দায়ী থাকবে আওয়ামী লীগ। এর পরিণাম তাদের জন্য শুভ হবে না।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com