সরকারি দল ও বিএনপি এখন কী করতে পারে? – আলী রীয়াজ
গত কয়েক সপ্তাহে, বিশেষত এক সপ্তাহে, দেশে সহিংসতার মাত্রা কমে এসেছে। বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্নভাবে পেট্রলবোমা বা ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলেও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের ডাকা অবরোধ ও হরতালের এখন আর কার্যকারিতা নেই; যদিও জোটের পক্ষ থেকে এখনো হরতাল বা অবরোধ কোনোটাই তুলে নেওয়া হয়নি এবং মানুষের মধ্যে শঙ্কা দূর হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে অনেকের আশা ছিল যে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া তাঁর ‘সংবাদ সম্মেলনে’ হয়তো এই ধরনের কর্মসূচি তুলে নেবেন কিংবা নতুন কর্মসূচি দেবেন। এর কোনোটিই ঘটেনি। তবে তাঁর বক্তব্যে যে পরিবর্তন ঘটেছে, সেটা ভালো করে তাকালেই বোঝা যায়।
তাঁর দাবিনামায় এখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা নেই, সরকার পতনের ডাক নেই। যা আছে তা হলো, ‘আন্দোলনের যৌক্তিক পরিণতি’, আছে ‘সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে সকলের অংশগ্রহণে অনতিবিলম্বে জাতীয় সংসদের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে সংলাপের আয়োজন’ করার দাবি। এগুলো নিঃসন্দেহে বিএনপির পিছিয়ে আসার লক্ষণ। একে বিএনপির নমনীয় অবস্থান বলেও কেউ কেউ চিহ্নিত করেছেন। খালেদা জিয়া যে শক্তিশালী অবস্থানে দাঁড়িয়ে, পরিস্থিতি তাঁর অনুকূলে জেনে এসব কথা বলছেন, আমি তা মনে করি না। মাস খানেক আগে হলে আমরা হয়তো সেভাবেই বিবেচনা করতে পারতাম। বিএনপির পক্ষে থেকে আন্দোলন অব্যাহত রাখার কথা বলা হলেও কৌশলের দিক থেকে এমন কিছু বলা হয়নি, যা বিএনপির আন্দোলনের এত দিনকার ঘাটতি মোচন করে নতুনভাবে তাকে এগিয়ে নেবে। ফলে দাবি বিষয়ে অবস্থান বদলালেও কৌশলের দিক থেকে, ‘আন্দোলনের’ গতি-প্রকৃতি পরিচালনার দিক থেকে বিএনপি যে জায়গায় ছিল এখনো সেখানেই আছে। ফলে প্রশ্ন হচ্ছে বিএনপি এখন কী করতে পারে? সরকারি দলের করণীয় কী? কী ঘটতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে পরিস্থিতির দিকে তাকানো দরকার, কী কী বিবেচনা মাথায় রেখে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজব সেটা নির্ধারণ করা।
গত জানুয়ারি মাস থেকেই সরকারি দল বলে আসছে যে তার অবস্থান অপরিবর্তনীয়। বিএনপির আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতার সূচনা হয়েছে, তা তারা রাষ্ট্রীয় শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করতে চায়। সরকারি দল মনে করেছে, সব সহিংসতার দায় বিএনপির—এই মনোভাব সমাজে যত বেশি প্রতিষ্ঠিত হবে, তত বেশি অবস্থা সরকারের অনুকূলে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত সাধারণ নাগরিকেরা জীবন-জীবিকার তাগিদেই বিএনপির কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করবে। সহিংসতায় যে ১২১ জন মারা গেছেন, তার অধিকাংশ যেহেতু মারা গেছেন পেট্রলবোমা হামলায়, ফলে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের ওপরে। সরকারের এই কৌশল কার্যত সফল হয়েছে যে একসময় সাধারণ মানুষের কাছেই আর এই পরিস্থিতি সহনীয় মনে হবে না। সহিংসতার জন্য তারা দায়ী নয় বলে দাবি করলেও বিএনপি এটা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি যে এর সব দায় তাদের নয়। এর অন্যতম কারণ হলো সহিংসতা ছাড়া আর কোনো ধরনের কার্যক্রম বিএনপি দেখাতে পারেনি। বিএনপির দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকার কারণে নাগরিকদের সম্পৃক্ততার অভাব ঘটেছে, এমন প্রমাণ করা যাবে না, কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে জনসম্পৃক্ততার সুযোগ তৈরি না করতে পারা যে তার কারণ, সেটা মানতেই হবে।
তদুপরি, রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর আচরণ সমাজে ভীতির সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছে। সংবাদপত্রের হিসাব অনুযায়ী, জানুয়ারি মাস থেকে ১৪ মার্চ পর্যন্ত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারে’ মারা গেছে কমপক্ষে ৩১ জন; মানবাধিকার সংস্থার হিসাবে শুধু গত ফেব্রুয়ারি মাসেই বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় মারা গেছে ৩৭ জন, জানুয়ারি মাসে ১৭ জন। আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীর হাতে আটক অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার তালিকা মোটেই ছোট নয়—আটকের পর হাঁটু লক্ষ৵ করে গুলি করার ঘটনার খবর সবার জানা। জানুয়ারি মাসে ১৪ জন নিখোঁজ হয়ে যায়, যাদের মধ্যে নয়জনকে পরে থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে, দুজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে; ফেব্রুয়ারি মাসে গুম হয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল সাত, তাদের মধ্যে একজনকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে, তিনজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। মার্চ মাসের হিসাব না থাকলেও বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমদের ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়ার ঘটনা জানেন সবাই; ফেব্রুয়ারি মাসে মাহমুদুর রহমান মান্নার আটকের সময়েও ২১ ঘণ্টার জন্য তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই সময়ে আটকের সংখ্যা কম করে হলেও ১৮ হাজার। ফলে জানুয়ারির শুরু থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকারের অনমনীয় অবস্থান এবং রাষ্ট্রশক্তির লাগামহীন ব্যবহার।
এখন সরকার ও সরকারি দলের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হবে, যেহেতু রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগ করে তারা বিএনপিকে দুর্বল এবং আন্দোলনকে অকার্যকর করে ফেলেছে, এই অবস্থা অব্যাহত রাখতে পারলে তাদের পক্ষে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করা সম্ভব হবে। এই চূড়ান্ত বিজয় বা লক্ষ্য কী? সেটা সরকারি দলের আচরণে স্পষ্ট, যদিও তারা সুস্পষ্ট করে বলে না। তবে আমরা বিএনপি–জায়ামাতবিরোধী এবং সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল বুদ্ধিজীবীদের কথায় একটা ধারণা পাই। এর সর্বসাম্প্রতিক ভাষ্যটি পাওয়া যায় এম এম আকাশের লেখা একটি নিবন্ধে। এই সময়ে, যাকে তিনি প্রগতিশীল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে মনে করেন, তাদের করণীয় নির্দেশ করে বলেছেন, ‘ঘটনা যা-ই ঘটুক, প্রগতিশীল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির এ ক্ষেত্রে যা করণীয়, সেটা হচ্ছে ১৯৭১ সালের পরাজিত প্রতিক্রিয়াশীল সন্ত্রাসী শক্তিকে যদি আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় বল প্রয়োগ করেও দুর্বল ও নিঃশেষিত করতে পারে, তাতে বাগড়া না দেওয়া।’ (ড. এম এম আকাশ, ‘এই রাউন্ডেও কি শেখ হাসিনা জয়ী হবেন?’ সমকাল, ১৬ মার্চ ২০১৫)। এম এম আকাশের বিবেচনায় যেহেতু বিএনপি ১৯৭১ সালের পরাজিত প্রতিক্রিয়াশীল সন্ত্রাসী শক্তির সঙ্গে জোট বেঁধেছে, সেহেতু তার ওপর বলপ্রয়োগ করা অন্যায় নয়।
সামগ্রিকভাবে প্রতিপক্ষকে নিঃশেষিত করাই হচ্ছে লক্ষ্য এবং তার কৌশল হচ্ছে রাষ্ট্রশক্তির নির্বিচার ব্যবহার, যার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র আমি একটু আগেই তুলে ধরেছি। কিন্তু এই লক্ষে৵ সরকার, সরকারি দল এবং তাদের সমর্থকদের কার্যক্রম পরিচালিত হলে তার পরিণতি কী হতে পারে, তার একটা ধারণা আমার ড. আকাশের লেখায়ই পাই। তিনি বলছেন, ঘটনা যা-ই ঘটুক ‘একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন আপসকামিতা, দুর্নীতি, অনাবশ্যক বাড়াবাড়ি ও ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধেও সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে’। অর্থাৎ, ক্ষমতাসীনদের মধ্যে হয় এখনই ‘অনাবশ্যক বাড়াবাড়ি ও ফ্যাসিবাদী প্রবণতা’ উপস্থিত বা রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহারের ফলে এই প্রবণতা তৈরি হবে। যে উদ্দেশ্যে বা যার বিরুদ্ধেই পরিচালিত হোক না কেন, রাষ্ট্রের জবাবদিহিহীন ‘বলপ্রয়োগ’ এবং ‘ফ্যাসিবাদী প্রবণতা’ যে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিবেশ তৈরি করতে পারে না, সেটা সহজেই বোধগম্য। আর গণতান্ত্রিক পরিবেশের অনুপস্থিতি বিশেষ করে বিএনপির জন্যই প্রযুক্ত হবে, এমন মনে করার কারণ নেই। কোনো দেশে গণতন্ত্র যেমন ‘কারও জন্য আছে কারও জন্য নেই’, এমন হতে পারে না, তেমনি গণতন্ত্রহীনতাও ‘বাছবিচার করে প্রযুক্ত’ হয় না। উদার গণতন্ত্রের একটি দিক এই যে গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে যাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ, তারাও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু ‘ফ্যাসিবাদী প্রবণতা’ যেখানে উপস্থিত, সেখানে গণতান্ত্রিক শক্তিও (কিংবা গণতান্ত্রিক শক্তিই) তার অধিকারবঞ্চিত হয়, নাগরিকদের প্রশ্ন না হয় বাদই দিলাম।
রাষ্ট্র যখন কেবল বলপ্রয়োগের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যে রাজনৈতিক শক্তি তা পরিচালনা করে, তার মধ্যে যদি ‘দুর্নীতি, অনাবশ্যক বাড়াবাড়ি ও ফ্যাসিবাদী প্রবণতা’ বহাল থাকে, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি দুর্বল অবস্থানে থাকে এবং অন্যান্য শক্তির প্রকাশ্য কার্যকলাপ সীমিত হয়ে পড়ে, তখন সমাজে উগ্রপন্থা প্রসারের পরিবেশ তৈরি হয়, চরমপন্থী শক্তির জন্য সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে অনুকূল আবহাওয়া। বাংলাদেশে সে ধরনের শক্তি অনুপস্থিত নয়। ক্রমাগতভাবে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি, যাদের সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক বলে বিবেচনা না করলেও, তাদের রাজনৈতিকভাবে পরাজিত না করে নিঃশেষ করে ফেললে এই চরমপন্থী শক্তি বিস্তারের পথই তৈরি হবে। এই বিবেচনা মাথায় রেখেই আমাদের দেখা দরকার সরকারি দল এবং বিএনপির করণীয় কী।
আগামীকাল: রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক আলোচনা শুরুর সময় হয়েছে
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।