তিন সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে দোটানায় ২০ দল
ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে দোটানায় পড়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। ২০ দলের মধ্যে এ ব্যাপারে একাধিকবার আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
এ নির্বাচনে অংশ নিলে চলমান আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, নাকি অংশ না নিলে সরকার সুবিধা পাবে, এ নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণে রয়েছে বিএনপি জোট। তবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি অচিরেই খোলাসা হবে বলে জানিয়েছেন ২০ দলীয় জোটের নেতারা।
আগামী ২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। কমিশনের বৈঠক শেষে বুধবার সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ তিন সিটি করপোরেশনের তফসিল ঘোষণা করেন। তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় ২৯ মার্চ। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই হবে ১ থেকে ২ এপ্রিল। আর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ৯ এপ্রিল। এই তিনটি সিটি করপোরেশনে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ করা হবে ১০ এপ্রিল।
২০ দলীয় জোট মনে করে, চলমান আন্দোলন কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত বা বানচাল করার কৌশল হিসেবেই সরকার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সামনে এনেছে। এ অবস্থায় বুঝেশুনে কৌশলী সিদ্ধান্ত নিতে চায় তারা।
জোটের একটি অংশ মনে করে, চলমান আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতেই সরকার নতুন চাল হিসেবে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে এনেছে। এতে তারা বিএনপি বা ২০ দলীয় জোটকে ফাঁদে ফেলতে চায়। কিন্তু সরকারের এ ফাঁদে পা দেওয়া কোনো মতেই ঠিক হবে না।
২০ দলের বড় একটি অংশ মনে করে, সরকার ২০ দলের আন্দোলনকে বানচাল করতেই সিটি নির্বাচন সামনে এনেছে। কিন্তু তাদেরকে খালি মাঠে গোল দিতে দেওয়া ঠিক হবে না। ২০ দলকেও কৌশলী ভূমিকায় আসতে হবে।
এ অংশের মত হল, বিএনপি নির্বাচনে না এলেও সিটি নির্বাচন করে ফেলবে সরকার। চলমান আন্দোলন অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত। কারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত থাকবে। স্থানীয়ভাবে ২০ দল চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
এ ব্যাপারে ২০ দলের শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদত হোসেন সেলিম বলেন, তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে জোটকে নীতিগত সিদ্ধান্তে আসা উচিত বলে মনে করি। কারণ এ নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্থানীয় নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে। তৃণমূলে সংগঠন শক্তিশালী হয়ে উঠবে। অতীতেও ২০ দলীয় জোট স্থানীয় সরকার (উপজেলা) নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। সেখানে একটা ভাল অবস্থান ছিল আমাদের। এ ছাড়া আগেও চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহী, গাজীপুর, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি তথা ২০ দলের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে।
তিনি এ ক্ষেত্রে সরকারকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সমান সুযোগ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়ে বলেন, সরকারের উচিত নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা। বিশেষ করে বিএনপির মত বড় রাজনৈতিক দলের অফিস দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। অফিস খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা এবং ২০ দলের নেতাকর্মীদের মাঠে কাজ করার সুযোগ দেওয়া উচিত।
২০ দলের শরিক বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এমএম আমিনুর রহমান বলেন, ২০ দলের চলমান আন্দোলনকে ভিন্নখাতে নিতে বা জনগণের দৃষ্টি অন্যখানে নিতেই সরকার তড়িঘড়ি এই তিন সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থানীয় সরকারের অধীনে, তাই এই নির্বাচনে দলীয়ভাবে প্রার্থী দেওয়ার সুযোগ নেই। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যই ২০ দলের বর্তমান মনোনিবেশ।
জোটের শরিক বাংলাদেশ ন্যাপ মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া বলেন, আমরা এখন মধ্যবর্তী জাতীয় নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছি। সুতরাং এখন ঢাকা বা অন্যকোনো সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। সরকার এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে মূলত চলমান আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য। তারপরেও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সময়োপযোগী যেকোনো সিদ্ধান্ত নেবেন বলে আশা করছি।
জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাপপার সভাপতি ও ২০ দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা শফিউল আলম প্রধান বলেন, কখনো আন্দোলনের গতি বাড়ানোর জন্য নির্বাচনে যেতে হতে হয় আবার কখনো আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে নির্বাচন বর্জন করতে হয়। সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে আমাদের (জোটের) মধ্যে আলোচনা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায়নি। বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, শিডিউল অনুযায়ী আগামী ২৮ এপ্রিল নির্বাচন এবং ২৯ মার্চ মনোনয়নপত্র জমাদানের শেষ দিন। বর্তমানে দেশে প্রচণ্ড রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। এই অবস্থায় ২৯ মার্চ বা ২৮ এপ্রিল কম সময় নয়। এরই মধ্যে প্রচণ্ড ঝড় বয়ে যেতে পারে। তখন সিটি করপোরেশন নির্বাচন আপেক্ষিক হতে পারে। অনেক কিছুই এর মধ্যে দুমড়ে মুচড়ে যেতে পারে।
২০ দলের শরিক ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২০ দল অংশগ্রহণ করবে কি করবে না এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বর্তমানে আন্দোলন চলছে। এই অবস্থায় নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত কী অনুচিত বা আন্দোলন ব্যাহত থাকবে কিনা এ বিষয়গুলো রয়েছে।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন মাত্র শিডিউল ঘোষণা করল। নমিনেশন পেপার সাবমিটের তো সময় আছে। প্রয়োজনে জোটের বৈঠক ডেকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আপনার দলের এ ব্যাপারে মত কী? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তো শুধু আমার বা আমার দলের ব্যাপার না-সামষ্টিক বিষয়। তাই ২০ দলের সিদ্ধান্তের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মে. জে. (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী বলেন, ইলেকশন কমিশন শিডিউল ঘোষণা করেছে। ২৯ মার্চ নমিনেশন পেপার সাবমিটের শেষ সময়। সময় তো বেশি দিন নেই। এরই মধ্যেই আমাদের ডিসিশন নিতে হবে। আমার মনে হয় সবাই বসে বা পরামর্শ করে অচিরেই এ ব্যাপারে ডিসিশন আসবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, ‘আমি মনে করি জাতীয় ইলেকশনই এখন সবচেয়ে প্রায়োরিটির (অগ্রাধিকার) বিষয়। ইলেকশন কমিশন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা করেছে-এ ব্যাপারে হয়তো খুব তাড়াতাড়ি আমাদের সিদ্ধান্ত আসবে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। কেবল তো আজকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলো, দেখা যাক কী করা যায়।’
সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবু সাঈদ খান খোকন বলেন, ‘এখনও নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দলীয় সিদ্ধান্ত হলে তারপর কে প্রার্থী হবে সেটা চূড়ান্ত হবে। এর আগে কিছুই বলা যাচ্ছে না।’
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া সরকারের শরিক জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদ ছাড়াও অনেকেই স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। এখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট নির্বাচনে অংশ নেবে কি না তা অচিরেই স্পষ্ট হওয়া যাবে।