দাম্ভিক দাদারা প্রতিপক্ষ, চাই আগুন ঝরা বোলিং
সিরাম বিরার কথা শুনেই হোক কিংবা নিজেদের সহজাত বুদ্ধি দিয়েই হোক, বিরেন্দর সেওয়াগ বা অনিল কুম্বলের পথে হাঁটেননি রবি শাস্ত্রী-ধোনি-রায়নারা। বৃহস্পতিবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি ভারত ও বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ম্যাচ শুরু হবে সকাল সাড়ে ৯টায়। মাঠে লড়াই শুরুর আগে বাংলাদেশকে সমীহ করেই কথা বলছেন শাস্ত্রী-ধোনি-রায়নারা। বলেছেন, ‘না, না বাংলাদেশকে হালকা ভাবে নেব কেন? ওরা অনেক ভাল দল, লড়াকু দল। আর এটা তো কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ। বাংলাদেশকে হালকা করে দেখার সুযোগ কোথায়?’
এই তো বছর পাঁচেক আগের কথা। বাংলাদেশ সফরে ২০১০ সালে দ্বিতীয় সারির একটা দল পাঠিয়ে দিয়েছিল ভারত। বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে ভারতীয়দের তুচ্ছতাচ্ছিল্য নতুন কিছু নয়; নিজেদের ক্রিকেট নিয়ে ভারতীয়দের এতোটাই গর্ব-অহঙ্কার যে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে তাদের দেশে আমন্ত্রণ জানালে তাদের নাক কাটা যায়। তাই তো এতো বছরেও ভারতের মাটিতে কোনো সিরিজ খেলার আমন্ত্রণ জুটেনি বাংলাদেশের। প্রতিবেশী বড় ভাইদের এমন আচরণে বাংলাদেশের কষ্ট রয়েছে, অভিমান রয়েছে, রয়েছে ক্ষোভও। সেই ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ সফরে ওইবার দ্বিতীয় সারির দলটা পাঠিয়ে দিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (বিসিসিআই)। মনে অপমান বিধলেও তা হজম করে নিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু দলের নেতৃত্বে থাকা বিরেন্দর সেওয়াগ ঢাকায় নেমে যা করলেন তাতে ক্ষোভে ফুঁসে উঠতে বাধ্য হলো গোটা বাংলাদেশ। দাম্ভিক সেওয়াগ সংবাদ সম্মেলনে বলে বসলেন, ‘বাংলাদেশ কখনোই ভারতকে হারাতে পারবে না। কারণ, ওরা দুর্বল দল। একটি টেস্ট ম্যাচে ২০ উইকেট কিভাবে নিতে হয় তা জানা আছে নাকি বাংলাদেশের?’
সেওয়াগের এমন মন্তব্য যারপরনাই ক্ষীপ্ত করেছিল বাংলাদেশকে। এমন কি বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ান কোচ জিমি সিডন্সও সেওয়াগের এমন মন্তব্যে অপমানিত বোধ করেছিলেন। তাই তো প্রত্যুত্তরে তিনিও বলেছিলেন, ‘সেওয়াগ এই কথার জবাব একদিন পেয়ে যাবে। কয়েক বছরের মধ্যে, এমনকি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেও সেওয়াগের নিজের কথাই তাকে দাঁতভাঙা জবাব দিয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশ মোটেও দুর্বল দল নয়।’
সেওয়াগের দাম্ভিকতা বাংলাদেশে কেমন প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিল, ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার সাংবাদিক সিরাম বিরার তা মনে রয়েছে। তার এটাও মনে রয়েছে যে ভারতের সাবেক অধিনায়ক অনিল কুম্বলের দাম্ভিক কিছু কথা কিভাবে তরুণ মাশরাফি বিন মর্তুজাকে আহত করেছিল। এবং সেই দাম্ভিকতার জবাব দিতে গিয়ে ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে পোর্ট অব স্পেনে কিভাবে মাশরাফি জ্বলে উঠেছিলেন ভারত বধের মহাকাব্য লেখার ক্ষেত্রে।
ভারত কেন বাংলাদেশের সঙ্গে বেশি সিরিজ খেলে না কিংবা কেন তাদের দেশে আমন্ত্রণ জানায় না, বন্ধু সুলভ আলোচনায় হয়তো কুম্বলের কাছে তেমন কিছুই জানতে চেয়েছিলেন মাশরাফি। উত্তরে ভদ্র ভাষায় কুম্বলে যা বলেছিলেন তা অনেকটা এরকম-‘আসলে আমরা (ভারতীয় ক্রিকেট দল) অনেক বেশি ব্যস্ত। বাংলাদেশকে সময় দেওয়ার মতো সময় কোথায় আমাদের!’ কুম্বলের কথায় আহত হয়েছিলেন মাশরাফি। পোর্ট অব স্পেনের সে কুম্বলেদের নাক উঁচু ভাবটার জবাব দিতেই পোর্ট অব স্পেনে জ্বলে উঠেছিলেন মাশরাফিরা। ফল হয়েছিল বাংলাদেশের কাছে হেরে সেবারের বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকেই ভারতের বিদায় নিতে হয়েছিল।
সেই তরুণ মাশরাফিই এখন বাংলাদেশের পরিণত অধিনায়ক। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এবারের আসরে ভাল খেলছে। আর তাই হয়তো সিরাম বিরার মতো অনেক ভারতীয় তাদের ক্রিকেটার বা সংশ্লিষ্টদের কাছে অনুরোধ রেখেছিলেন, ‘সাবধান! বাংলাদেশকে অপমান নয়, নয় কোনো অপমানকর শব্দও।’ সেই অনুরোধেই হোক কিংবা নিজেদের বুদ্ধি-বিবেচনায় হোক, বুধবার বাংলাদেশকে সমীহ করেই কথা বলেছেন রবি শাস্ত্রী, মহেন্দ্র সিং ধোনি, সুরেশ রায়নারা। ভারতীয় মিডিয়াগুলোও বাংলাদেশের পারফরম্যান্সের প্রশংসা করছে, মাশরাফিদের লড়াকু মনোভাবের প্রশংসা করেছে।
কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়। উপরের অংশটুকু পড়ে যারা মনে করছেন যে বড় ভাইরা এখন আর দাম্ভিক নন, ভারতীয়দের মনে বাংলাদেশ সম্মানের পাত্র হয়ে উঠেছে ইত্যাদি ইত্যাদি…তাদের জন্য বলা- প্রতিবেশী বড় ভাইরা মোটেও তাদের দাম্ভিকতা থেকে বাইরে যেতে পারেনি। তারা যা বলছে তা টেকনিক্যাল কথাবর্তা। আদতে তারা বাংলাদেশকে সেই তুচ্ছতাচ্ছিল্যের চোখেই রেখেছে। তাই তো সাবেক ভারতীয় ওপেনার নভোজিত সিঁধু ‘ভুখা-কাঙ্গাল’ উপাধি ব্যবহার করে বাংলাদেশকে নিয়ে অপমানকর কথা বলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। আবার কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ মাঠে গড়ানোর আগেই সেমিফাইনালে ভারত কোন দলের বিপক্ষে খেলবে সেই হিসেবও কষতে বসে গেছে ভারতীয়রা।
এদিকে কেবল ভারতীয়রাই নয়, স্যার রিচার্ড হ্যাডলির মতো তারকারাও মনে করছেন ভারতের সঙ্গে কোয়ার্টার ফাইনালের লড়াইটায় বাংলাদেশ পেরে উঠবে না; ভারত সেমিফাইনালে চলে যাবে! যদিও হ্যাডলিরা বাংলাদেশের বিশ্বকাপ পারফরম্যান্সের প্রশংসাও করেছেন। কিন্তু নাক উঁচু ভারতীয়দের মতো বিশ্বের তাবৎ ক্রিকেট তারকা কিংবা ক্রিকেট বোদ্ধারা মেলবোর্নের মাঠে ভারতকেই সম্ভাব্য জয়ী দল হিসেবে শতকরা হিসেবে ৭০/৮০ ভাগ এগিয়ে রেখেছেন। বাংলাদেশ কী এতই দুর্বল। ভারতের দাম্ভিক বড় ভাই আর স্যার রিচার্ড হ্যাডলিদের জবাব দেওয়ার মিশনে নিয়েই বৃহস্পতিবার মাঠে নামতে হচ্ছে মাশরাফিদের। লক্ষ্য একটাই-নিজেদের সর্বোচ্চ শক্তি উজাড় করে ধোনিদের রুখে দেওয়া।
এখন অবধি ওয়ানডে ক্রিকেটে মোট ২৮ বার মুখোমুখি লড়াই হয়েছে দুই দলের। এর মধ্যে ভারত জিতেছে ২৪টি, বাংলাদেশ ৩টি। একটি ম্যাচ নিষ্পত্তি হয়নি। বিশ্বকাপের হিসেব ধরলে পরিসংখ্যানে দুই দলই সমানে সমান; ২ বার লড়াই হয়েছে এবং দুই দলই পেয়েছে ১টি করে জয়। বাংলাদেশ ২০০৭ সালে পোর্ট অব স্পেনে, ভারত ২০১১ সালে ঢাকার মাটিতে। এবারের জয়ের হাসিটা কার মুখে শোভা পাবে, মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে মিলবে তার উত্তর। এর আগে মাশরাফিদের নিতে হচ্ছে আগুন ঝরা বোলিংয়ের প্রস্তুতি।
স্যার রিচার্ড হ্যাডলি ভারতকে এগিয়ে রাখলেও একটা কথা বলেছেন, নিউজিল্যান্ডের এই কিংবদন্তি অলরাউন্ডার বলেছেন, ‘ব্যাটিং দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে ভারত-বাংলাদেশ দুই দলেরই ব্যাটিং শক্তিশালী। আমার মনে হয়, বোলিংই দুই দলের পার্থক্য গড়ে দিবে মেলবোর্নে। ভারতের বিপক্ষে ভাল করতে চাইলে মাশরাফিদের আরও বেশি আগুন ঝরাতে হবে বলে।’
মাশরাফিরা কি তা পারবেন? উত্তরে বাংলাদেশের লড়াকু দলপতি বলেছেন, ‘২০০৭ সালে জিতেছি কিংবা ২০১১ সালে হেরেছি; এসব পরিসংখ্যান আসলে কোনো কাজে আসবে না। শর্ট ভার্সনের ক্রিকেটে নির্দিষ্ট দিনে ভাল খেলাই বড় কথা। আমরা সেই ভাল খেলার জন্য প্রস্তুত।’
আর দেশ সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের ভাষায়, ‘আসলে একটাই তো ম্যাচ। সেই একটা ম্যাচে ৭টা ঘণ্টা ভাল ক্রিকেট খেললেই চলবে। আমরা প্রস্তুত।’