চুলের জট ছাড়িয়ে স্বাবলম্বী ওরা
চুলে জট লাগে। সেই জট ছাড়ানোই তাদের পেশা। রীতিমতো দলবদ্ধ হয়ে এই কাজ করছেন নওগাঁর মান্দা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের নারীরা। পারিবারিক কাজের ফাঁকে এই পেশার মাধ্যমেই তারা সংসারে যোগ করছেন কিছু বাড়তি আয়।
কাজটি করে অনেকেই স্বাবলম্বী হচ্ছেন। তারা কেউ বিধবা, কেউ তালাকপ্রাপ্ত। রয়েছেন গরিব গৃহবধূ, এমনকি শিক্ষার্থীও। অভাব ছিল তাদের নিত্যসাথী। বর্তমানে চুল প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় কাজ করে বাড়তি আয় করছেন।
মান্দা উপজেলায় এ রকম কমপক্ষে ১২টি চুল প্রক্রিয়াকরণ কারখানা রয়েছে। আর এতে প্রায় ৮০০ নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। তাদের চোখেমুখে এখন স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন।
উপজেলার বনিহারী গ্রামের উজ্জ্বল নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে গড়ে তোলা চুল প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় কাজ করছেন ৫২ জন হতদরিদ্র নারী। বিউটি বিবি এ কারখানার দলনেতা। নিজের কাজের পাশাপাশি কারখানায় কর্মরত নারীদের তিনি তদারক করেন।
কারখানাটিতে কর্মরত আয়েশা বিবি জানান, পরপর তিন কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে স্বামী তাকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিন মেয়েকে নিয়ে তিনি ২০ বছর ধরে বাবার বাড়িতেই আছেন। শ্রমিকের কাজ করে অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। ইতোমধ্যে এলাকাবাসীর সহায়তায় দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এ কারখানায় মাসিক দেড় হাজার টাকা বেতনে কাজ করে আগের চেয়ে ভালো আছেন। এখন ছোট মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার অপেক্ষায় বেঁচে আছেন বলে জানান। তিনি মৃদু হেসে বলেন, ‘জীবনের জট ছাড়াতি পারি নাই। এখন চুলের জট ছাড়াই।’
এ কারখানার শ্রমিক ছায়েরা বিবি জানান, তার স্বামী মোজাফফর হোসেন অসুস্থতার কারণে কোনো কাজ করতে পারেন না। কষ্টে তাদের দিন চলত। বর্তমানে সংসারে অনেকখানি স্বস্তি এসেছে বলে তিনি জানান।
এছাড়া কারখানায় কর্মরত ময়জান বিবি, পারুল বিবি, জরিনা বিবিসহ আরও অনেকেই বলেন, স্বামীর সামান্য আয়ের ওপর নির্ভর করেই তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হত। এখন সেখানে কিছু বাড়তি আয় যোগ হওয়ায় কষ্ট কমে গেছে।
এই কারখানায় কাজ করেন শিক্ষার্থী সীমা রানী ও শাকিলা পারভীন। সীমা এইচএসসি প্রথম বর্ষের এবং শাকিলা নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। ছুটির দিন তারা এখানে কাজ করে। খাতা-কলম কেনাসহ ছোটখাটো ব্যয় মেটানোর জন্য এখন আর পরিবারের সদস্যদের কাছে হাত পাততে হয় না বলে তারা খুব খুশি।
এই কারখানার ম্যানেজার মজিবর রহমান মন্টু জানান, ফেরিওয়ালারা বাড়ি বাড়ি এবং সেলুনে সেলুনে ঘুরে চুল সংগ্রহ করেন। সেই চুলের বাজার রয়েছে উপজেলার চৌবাড়িয়া হাটে। সোম ও শুক্রবার সেখানে চুলের বিশাল হাট বসে। সেখানকার মহাজনদের কাছ থেকে চুল কিনে আনেন কারখানার মালিকেরা।
বনিহারী গ্রামের এই কারখানার মালিক আমানুর বিশ্বাস জানান, প্রতি কেজি চুল ৪০০০ থেকে ৪২০০ টাকায় কেনাবেচা হয়। কেনার সময় চুলগুলো একসাথে মেশানো এবং জটপাকানো থাকে। সেগুলোই চিরুনি বা কাঁটা দিয়ে প্রতিটা আলাদা করা হয়। তারপর সেগুলো তারা ঢাকার ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন। সেখান থেকে মেশিনে পুনঃপ্রক্রিয়া ও প্যাকেটজাত করে চীনে রফতানি করা হয়।
আমানুর বিশ্বাস আরও জানান, তার এখন তিনটি কারখানা রয়েছে। সেখানে ১৬০ জন নারীশ্রমিক কাজ করছেন।