মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ যাচাই-বাছাই স্থগিতের সিদ্ধান্ত
মুক্তিযোদ্ধাদের আবেদন ও সনদ যাচাই-বাছাই কার্যক্রম স্থগিত করেছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)।
হাইকোর্টের দেওয়া রুলের পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা নির্ধারণে আদালতের সিদ্ধান্ত ও কপি হাতে পাওয়ার পরই এ বিষয়ে পুনরায় দিনক্ষণ ঠিক করবে জামুকা।
বিষয়টি দ্য রিপোর্টকে নিশ্চিত করেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ হান্নান। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী আগামী ২৮ মার্চ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আবেদন ও সনদ যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা ছিল।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে জামুকার নতুন অফিসে সোমবার বিকেলে জামুকার পূর্বনির্ধারিত বৈঠকে মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ যাচাই-বাছাই কার্যক্রম স্থগিতের এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
জামুকার চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সভাপতিত্বে বৈঠকে অন্যান্য সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। এতে সবাই একমত হন যে, আদালতে বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ-যাচাই বাছাই আপাতত স্থগিত থাকবে। আদালতের নির্দেশনা পাওয়ার পর এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন তারা। এরপরই যাচাই-বাছাইয়ের জন্য নতুন দিন-তারিখ পুনর্নির্ধারণ করবে জামুকা।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ হান্নান সোমবার রাতে বলেন, ২৮ মার্চ থেকে যে মুক্তিযোদ্ধার আবেদন ও সনদ যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা ছিল তা হচ্ছে না। কারণ এ ব্যাপারে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়েছে। রিটের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আদালতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে যাচাই-বাছাই কার্যক্রম স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সম্প্রতি জামুকার চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, আসন্ন এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার সময় মুক্তিযোদ্ধার সনদ যাচাই-বাছাইয়ের মতো এত বড় একটা কাজ শুরু করার বিষয়ে ডিসি-ইউএনওরা নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়েছেন। আমরা বিষয়টি আমলে নিয়ে ২৮ মার্চ যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছি। আগামী ২৩ মার্চ জামুকার বৈঠকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জামুকার সভায় সিদ্ধান্ত হয়, আগামী ২৮ মার্চ, ৪ ও ১১ এপ্রিল সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই অনুষ্ঠিত হবে। যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে প্রতিটি উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হবে। যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির জন্য আবেদন করেছেন তাদের নিজ নিজ উপজেলায় এ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হবে। কোন উপজেলায় কবে যাচাই-বাছাই হবে তা পরবর্তী সময়ে গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হবে।
তবে এরই মধ্যে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধার রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন ও প্রকাশের পূর্বে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ সংজ্ঞা নিরূপণে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। গত ১৮ মার্চ রিট আবেদনের শুনানী শেষে বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি খিজির আহমেদ চৌধুরীর ডিভিশন বেঞ্চ এই আদেশ দেন। ছয় সপ্তাহের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন সচিব ও তালিকা প্রস্তুতকরণ কমিটিকে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
আবেদনকারীদের পক্ষে হাসনাত কাউয়ুম হাইকোর্টের রুল প্রসঙ্গে ওইদিন বলেন, ‘একেক সরকার একেক সময়ে বিধিমালা, গাইডলাইন দিয়ে একেকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞায়িত করছে। কিন্তু পরবর্তীকালে অন্য সরকার এসে এ সব বাতিল করে দেয়। এ জন্য আইন দ্বারা সংজ্ঞা নির্ধারণ প্রয়োজন। কিন্তু সেটা না করে গত ১৫ জানুয়ারি এ বিষয়ে একটি গাইড লাইন দেয়। সেখানেও একটি সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এর ভিত্তিতে ২৮ মার্চ থেকে যাচাই-বাছাইও শুরু হবে। আমরা এই প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে রিট করেছি। আদালত রুল জারি করেছে।’
এদিকে এরই মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নতুন করে তালিকাভুক্তির জন্য জমা পড়া প্রায় এক লাখ ৪৩ হাজার আবেদন সংশ্লিষ্ট উপজেলাগুলোতে পাঠানো হয়। এর মধ্যে প্রায় ১০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগপত্রও রয়েছে। এ সব নতুন আবেদন ও গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাওয়া নানা অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সারা দেশে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
শিগগিরই উপজেলা ও মহানগর পর্যায়ে আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ৪৮৭টি উপজেলা ও ৮টি মহানগর কমিটি গঠন করা হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে পাওয়া সব আবেদন প্যাকেট আকারে সংশ্লিষ্ট জেলার ডিসির কাছে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে প্রতিটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মধ্যে তা বণ্টন করে দেওয়ার কথা রয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদাধিকার বলে উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যসচিব হবেন।
জামুকা সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জামুকার বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রস্তাবিত এ কমিটির প্রধান হবেন সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য। তাকে অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধা হতে হবে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা না হলে সে ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে এর আগের যেকোনো মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সদস্য সভাপতি হবেন। তা না পাওয়া গেলে যুদ্ধকালীন কমান্ডার কমিটির সভাপতি হবেন। কিন্তু স্থানীয় সংসদ সদস্যদের বিরোধিতার মুখে সেখান থেকে সরে আসে জামুকা। পরে সিদ্ধান্ত হয়, সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা না হলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় মনোনীত প্রতিনিধি কমিটির প্রধান হবেন। কমিটির অন্য সদস্য হবেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের একজন প্রতিনিধি, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ইউনিটের জেলা কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ উপজেলা ইউনিটের উপজেলা কমান্ডার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মনোনীত একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি, বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত জামুকার সদস্য মনোনীত একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি এবং সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)।