উত্তাল মার্চ ২৪, ১৯৭১ ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ প্রস্তুতি নিচ্ছিল পাকিস্তানী বাহিনী
১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঠিক এক দিন আগে অপারেশন সার্চলাইটের প্রস্তুতি নিচ্ছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। আর পরের দিন ২৫ মার্চ গভীর রাতে বাঙালী জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে গণহত্যা করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী।
’৭১-এর এই দিনে পাকিস্তানের করাচী থেকে সোয়াত নামক একটি জাহাজ আসে। এতে ৫ হাজার ৬৩০টি অস্ত্র আনা হয়। অস্ত্র নামাতে গিয়ে বাঙালী শ্রমিকরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাক হানাদার সামরিক অফিসারদের মুখের ওপর শ্রমিকরা অস্ত্র নামাতে অস্বীকৃতি জানায়। অবরোধ করে রাখে জাহাজটিকে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করে বেশ কয়েকজন স্বাধীনতাকামী শ্রমিক।
এ দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ভবনে বিভিন্ন সময়ে সমাগত মিছিলকারীদের উদ্দেশে শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় বিরামহীনভাবে ভাষণ দেন।
তিনি পাকিস্তানীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই। আগামীকালের মধ্যে সমস্যার কোনো সমাধান না হলে বাঙালীরা নিজেদের পথ নিজেরা বেছে নেবে। আমরা সাড়ে ৭ কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। কোনো ষড়যন্ত্রই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না।
তৎকালীন পাকিস্তানী সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলার জনগণের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হলে তা বরদাশত করা হবে না।
একাত্তরের ২৪ মার্চে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা একে একে ঢাকা ত্যাগ করতে শুরু করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট ছোট পার্লামেন্টারি দলের সব নেতাই এ দিন কারাচীর উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। ভুট্টোর সফরসঙ্গী ১৩ জনের ৭ জনই এ দিন ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৩ মার্চ রাত হতে ২৪ মার্চ সকাল পর্যন্ত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সৈয়দপুর সেনানিবাসের পার্শ্ববর্তী বোতলগাড়ি, গোলাহাট ও কুন্দুল গ্রাম ঘেরাও করে অবাঙালীদের সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এতে এক শ’ নিহত এবং এক হাজারেরও বেশী আহত হয়।
২৩ মার্চের মতো এ দিনও সারা পূর্ব পাকিস্তানে অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল পতপত করে। ইস্ট বেঙ্গল পাকিস্তান রাইফেলসের যশোর ট্রাংক রোডের অফিসেও এ দিন উড়ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এদিকে ইয়াহিয়া খানের আমন্ত্রণে পাকিস্তান থেকে খান আবদুল কাইয়ুম খান ঢাকায় আসেন। কাইয়ুম ঢাকা আসার পরই ইয়াহিয়া এবং ভুট্টোর সঙ্গে এক বৈঠকে বসেন।
বৈঠক শেষে জুলফিকার আলী ভুট্টো সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে তিনি সর্বদা নমনীয় ও আন্তরিক মনোভাব পোষণ করেন।
তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তান বাস্তবিকই শোষণ ও বঞ্চনার শিকার। কিন্তু এমন আলোচনার আড়ালে যে বিভীষিকাময় গণহত্যার ষড়যন্ত্র সামরিক জান্তা করছিল, তা বাঙালী জাতির কাছে ছিল ধারণারও বাইরে।
২৫ মার্চের আগেই সেনাবাহিনীতে বাঙালী ইউনিটগুলোকে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করে ফেলা হয়। তাদের সেনানিবাসের বাইরে পাঠানো হয় বিভিন্ন কাজ দেখিয়ে। এক অংশ থেকে আরেক অংশকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয় এবং সবগুলো অংশকেই রেডিও এবং তারহীন যোগাযোগের গ্রিড থেকে যত সম্ভব দূরে রাখা হয়। বাঙালী কর্মকর্তাদের হয় ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নয়তো নেতৃত্বের কেন্দ্র বা সরাসরি অপারেশনে নিয়োজিত ইউনিটগুলো থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানী কর্মকর্তারা বাঙালী ইউনিট পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে নেয়।
পশ্চিম পাকিস্তানের ইপিআর বাহিনীর (সেনাবাহিনীর একটি অংশ) কোম্পানিগুলোকে শহরগুলোর যেখানেই পারা গেছে সেখানেই মোতায়েন করা হয়েছে। অপরদিকে বাঙালী ইপিআর বাহিনীকে পাঠানো হয়েছে এলাকায়। অধিকাংশ ইপিআর ইউনিট তাদের মূল এ্যাকশনের অঞ্চল থেকে অনেক দূরে ছিল এবং নিজ অবস্থান থেকে বড় শহরগুলোতে পৌঁছতে তাদের অন্তত ১ দিন লাগতো।
বাঙালী সেনাবাহিনীকে মূল শহর থেকে দূরে রেখে পাকিস্তানী হানাদাররা ইতিহাসের এক কলঙ্কযুক্ত হত্যাযজ্ঞের ছক এঁকেছিল। এরপরের দিনই বাঙালী ইতিহাসের সবচেয়ে কালোরাত আগত হয়েছিল।