কয়েক শ কোটি টাকা লোকসান: কার স্বার্থে বিটিআরসির এই ছাড়?
বাইরে থেকে আসা কল চার্জ কমানো ও রাজস্ব ভাগাভাগি পদ্ধতি পুনর্নির্ধারণের কারণে সরকারের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হলেও এর মেয়াদ আবার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। গত ১৬ মার্চ বিটিআরসির সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার আলী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত এ পদ্ধতি চালু থাকবে বলা হয়। চিঠিতে বলা হয়, ‘পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে প্রবর্তিত আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশন রেট (আইসিআরটি) এবং এ সংক্রান্ত স্টেকহোল্ডারদের রেভিনিউ শেয়ারিং মডেল বলবৎ থাকবে।’ কয়েক শ কোটি টাকা লোকসানের পরও পরীক্ষামূলক এ পদ্ধতি পর্যালোচনার বদলে আবার নতুন করে অনির্দিষ্টকালের জন্য বর্ধিত করায় বিটিআরসির সমালোচনা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁদের প্রশ্ন, বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে জেনেও কার স্বার্থে বিটিআরসি এ পদ্ধতি অব্যাহত রাখছে? দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিক মোর্শেদ নোমান এক প্রতিবেদনে এমনটাই জানিয়েছেন।
পত্রিকাটির প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল রেট প্রতি মিনিটে তিন সেন্ট থেকে কমিয়ে দেড় সেন্টে আনার নির্দেশনা জারি হয়। এর পাশাপাশি গেটওয়েগুলোর সঙ্গে রাজস্ব ভাগাভাগির কাঠামোও পুনর্নির্ধারণ করে বিটিআরসি। বিটিআরসির ওই নির্দেশনায় বলা হয়, এই মডেল অস্থায়ী ও পরীক্ষামূলকভাবে ছয় মাসের জন্য কার্যকর করা হয়েছে। মডেল অনুযায়ী, কল থেকে আসা রাজস্ব আয়ের ৪০ শতাংশ বিটিআরসি, ২০ শতাংশ ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান (আইজিডব্লিউ), ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান (আইসিএক্স) এবং ২২ দশমিক ৫ শতাংশ সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের অপারেটর বা এক্সেস নেটওয়ার্ক সার্ভিস (এএনএস) পাবে বলে নির্ধারণ করা হয়। আগে এ হার ছিল—বিটিআরসি ৫১ দশমিক ৭৫ শতাংশ, আইজিডব্লিউ ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ, আইসিএক্স ১৫ শতাংশ এবং এএনএসের ২০ শতাংশ। বিদেশ থেকে আসা প্রতিটি কল দেশে ঢোকে আইজিডব্লিউ মাধ্যমে। তারপর আইসিএক্স-এর মাধ্যমে তা সংশ্লিষ্ট অপারেটর বা এএনএসে পৌঁছায়। অপারেটর গ্রাহকের ফোনে কলটির সংযোগ দেয়।
কলরেট কমানোয় সরকারের ক্ষতি ৪১২ কোটি টাকা
পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা এ পদ্ধতির কারণে গত পাঁচ মাসে এ খাতে মোট রাজস্ব আয় কমেছে ৪২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিটিআরসি ৪১২ কোটি টাকা লোকসান দিলেও আইজিডব্লিউগুলো ৫৩ কোটি টাকারও বেশি লাভ করেছে। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের মার্চ মাস থেকে ওই বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কল এসেছে ৮৫৭ কোটি ৬০ লাখ মিনিট। কল রেট কমানোর পর সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাসে কল এসেছে এক হাজার ৩৬১ কোটি ৬০ লাখ। অর্থাৎ, কল বেড়েছে ৫০৪ কোটি মিনিট। রাজস্ব ভাগাভাগির মডেলে পরিবর্তন এনে বিটিআরসির রাজস্বের অংশ কমিয়ে আনার কারণে বড় অঙ্কের রাজস্ব হারিয়েছে সংস্থাটি। আগের মডেল অনুসারে প্রথম পাঁচ মাসে বিটিআরসির রাজস্ব আয় ছিল এক হাজার ৬৬ কোটি টাকা। অথচ পরের পাঁচ মাসে বিটিআরসির রাজস্ব আয় হয়েছে ৬৫৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। অবশ্য এ মডেলের কারণে আয় কমেছে আইএনএস এবং আইসিএক্সগুলোর। আইসিএক্সের রাজস্ব কমেছে ২৩ কোটি এবং আইএনএসের রাজস্ব কমেছে ৪৪ কোটি টাকারও বেশি।
বিতর্কিত মন্তব্য করে মন্ত্রিত্ব হারানো সাবেক ডাক-টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রী থাকাকালে কলরেট কমানো এবং রাজস্ব ভাগাভাগির মডেল চালু করা হয়। ওই সময় এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বারবার অভিযোগ করেছিলেন, আইজিডব্লিউগুলোর স্বার্থেই এ পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এর পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন নিয়ে পদ্ধতিটি চালু করা হয়। দেশের বাইরে থেকে আসা আন্তর্জাতিক কলের চার্জ কমানোর ক্ষেত্রে প্রধান যুক্তি দেখানো হয়েছিল অবৈধ ভিওআইপি কল বন্ধ করা। ইনকামিং কল দ্বিগুণ হলেও অবৈধ ভিওআইপি এখনো বন্ধ হয়নি। অবৈধ ভিওআইপি বন্ধে বিটিআরসির সেন্ট্রালাইজড মনিটরিং সিস্টেম (সিএমএস) স্থাপনের সিদ্ধান্তও ঝুলে আছে।
গত ১০ মাসের কলের পরিমাণ, রাজস্ব আয়, বিটিআরসির আয়সহ সবকিছু পর্যালোচনা করে একটি চিত্রই পরিষ্কার হয়ে যায়। কলের পরিমাণ বাড়লেও আইজিডব্লিউ বাদে সবাই লোকসানের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে বড় লোকসানের শিকার খোদ সরকারই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিটিআরসির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, জনগণের বিপুল পরিমাণ টাকা লোকসানের পরও এটাকে পর্যালোচনা করেনি বিটিআরসি। তার মানে, কোটি কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে জেনেও তারা কারও স্বার্থে এ পদ্ধতি অব্যাহত রাখছে। এ পদ্ধতির পক্ষে অবস্থান নেওয়া বিটিআরসির শীর্ষ দুজন কর্মকর্তা বলেন, প্রতিদিনই আন্তর্জাতিক কলের পরিমাণ বাড়ছে। আরও কিছুদিন পদ্ধতিটি চালু রাখলে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে এবং লোকসানের বিষয়টি পুষিয়ে নেওয়া যাবে। এই যুক্তিতেই আবার এ পদ্ধতির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে বিটিআরসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
দৈনিক প্রথম আলোর সৌজন্যে।