ভারতের মতো রাষ্ট্রপতির নির্বাহী ক্ষমতা দরকার- মিজানুর রহমান খান
পাঁচ বছর পর পর সংকটে যাতে না পড়তে হয়, সে জন্য রাষ্ট্রপতির হাতে ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অধ্যাপক রেহমান সোবহানসহ আরও কয়েকজন। এ রকম একটি আংশিক ভুল খবরের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। আংশিক ভুলটা হলো ‘নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউট’ (পিআরআই)–এর যে সেমিনারে ওই মত দেওয়া হয়েছিল, সেখানে রেহমান সোবহানের বক্তব্য ছিল ঠিক উল্টো। তিনি ও অধ্যাপক রওনক জাহান উভয়ে এই লেখককে বলেন, তাঁরা বরং রাষ্ট্রপতির হাতে ক্ষমতা বাড়ানোর বিরোধিতা করে বাহাত্তরের সংবিধানকেই সমর্থন করেন। রওনক মনে করেন এতে দ্বৈত শাসন সৃষ্টি হবে। এ প্রসঙ্গে বিনয়ের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করে কিছু বলতে চাই।
গত চার দশকের অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের এ বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। অধ্যাপক রেহমান ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খানের সঙ্গে ২২ মার্চ টেলিফোন আলাপে মনে হলো তাঁরা উভয়ে মনে করেন মূল সমস্যা সংবিধানে নয়, সমস্যা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। দুজনের চিন্তায় পার্থক্য আছে। সেটা হলো অধ্যাপক রেহমান রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার ক্ষমতার বর্তমান বিন্যাসকে দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন করেন। তাঁর স্মৃতিতে এখনো রাষ্ট্রপতি গোলাম মোহাম্মদের দ্বারা প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দীনকে অপসারণের ঘটনা উজ্জ্বল। আর আকবর আলি খান মনে করেন যে, সইয়ের আগে রাষ্ট্রপতির দ্বিমত করা, সাংবিধানিক পদে নিয়োগ ও ক্ষমার অধিকারে প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্বের অবসান ও সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনপদ্ধতি চালু করা দরকার। আমরাও মনে করি, রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নতি জরুরি এবং উপযুক্ত গণতান্ত্রিক নেতার জন্য অপেক্ষা করতেও রাজি। কিন্তু সে জন্য বিদ্যমান সাংবিধানিক অবস্থাকে একেবারেই সমর্থন করা যায় না। ভারতের মতো রাষ্ট্রপতির হাতে নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত করতে হবে। কারণ, শুধু সংস্কৃতিগত নয়, বিপজ্জনক সাংবিধানিক কাঠামোও সংকটকে গভীরতর করছে।
পিআরআই সেমিনারে উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক জিল্লুর আর খান তাঁর লিখিত প্রবন্ধে ক্ষমতার ওপর প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য দ্বিকক্ষ সংসদের মতো কতিপয় উত্তম প্রস্তাব করেছেন কিন্তু রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার বিষয়ে নীরব থেকে বরং নির্বাচনপদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে সমাধান পেতে চাইছেন।
সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতির হাতে ক্ষমতা বাড়ানো হবে সংবিধান পরিপন্থী, বাংলাদেশের বাস্তবতায় তা কার্যকর কিছু হবে না।’ বর্তমান বাস্তবতায় হয়তো কার্যকর কিছু হবে না, কিন্তু নতুন প্রজন্মের লড়াইটা হবে ওই বাস্তবতাকে জনস্বার্থে বদলে দেওয়া। খায়রুল হক বিশ্বে প্রচলিত দুই ধরনের সরকারপদ্ধতির তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে সংসদীয় পদ্ধতি চালু রাখার পক্ষে মত দিয়ে বলেন, ‘এই প্রক্রিয়ার কোনো দুর্বলতা এখন মনে হলেও চর্চার মাধ্যমে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।’ এটা ঠিক। কিন্তু বুঝতে হবে, সংসদীয় পদ্ধতি যেটা ১৯৭২ সালে চালু করা হয়েছিল, তাতে ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের কঙ্কালটা ছিল, প্রাণ ছিল না। এখনো নেই। কারণ, সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীকে আলাদাভাবে অন্য মন্ত্রীদের ওপরে তোলা হয় না। ৭০ অনুচ্ছেদের মতো বিধান রাখা যায় না।
বিচারপতি খায়রুল হকের কথায়, ‘যে পদ্ধতি আমাদের দেশে চালু রয়েছে, সেখানে যার যার সাংবিধানিক ক্ষমতা সেটা বহাল রেখেই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে।’ নীতিগতভাবে এই যুক্তি অচল। মন্ত্রিসভাকে বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হাতে যে সর্বময় ক্ষমতা, সেটা অবশ্যই বিলোপ করতে হবে। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান বলেন, ‘রুলস অব বিজনেসে (পাকিস্তান থেকে আমদানি করা) বিধান আছে, প্রধানমন্ত্রী যেকোনো বিধি আগাম স্থগিত করতে পারেন। আবার স্থগিত না করে কোনো বিধি লঙ্ঘন করলে তার ভূতাপেক্ষ বৈধতা দিতে পারেন।’ কেউ বলবেন, সেটা তো রুলস অব বিজনেস বদলে দিলেই হয়। আমার যুক্তি, প্রধানমন্ত্রী এটা পারছেন সংবিধানের ৪৮(৩) ও ৫৫(২) অনুচ্ছেদের কারণে, ক্ষমতার বিন্যাসটা ভারতের মতো থাকলে এটা করতে কিছুটা কুণ্ঠিত হতেন।
খায়রুল হক ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে ‘জনগণের কাছে যার জবাবদিহি রয়েছে, তিনি বা তাদেরই হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থাকবে। অন্য কারও হাতে নয়। পার্লামেন্ট যেহেতু জনগণের প্রতিনিধি, সেহেতু তাদের মাধ্যমেই জনগণের নিকট দায়বদ্ধতা প্রদর্শন করা হয়ে থাকে।’ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত কিন্তু তাঁকে সংসদের দ্বারা অনুমোদিত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে হয়। সুতরাং, পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত হওয়ার কারণে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগে অসুবিধা হয় না।
খায়রুল হক মনে করেন, ‘যেহেতু ক্ষমতার উৎস জনগণ, কাজেই রাষ্ট্রপতিকে কোনো প্রকার নির্বাহী ক্ষমতা দিতে হলে সংবিধান সংশোধন করে তাঁকে সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে হবে। নইলে কোনো ক্ষমতারই অধিকারী তিনি হবেন না।’ এটা গ্রহণযোগ্য নয়। ভারতীয় রাষ্ট্রপতিরা তার প্রমাণ। তাঁরা কখনো বিশেষ করে সংকটের সময়ে মন্ত্রিসভার পরামর্শ ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ে রাষ্ট্রপতির এই বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগের এখতিয়ারকে সমর্থন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতিকে রাবারস্ট্যাম্প ভাবা হয়নি।
অনলাইন সংবাদমাধ্যমটি লিখেছে, ‘সেই সংশোধনী (রাষ্ট্রপতিকে নির্বাহী ক্ষমতা দিয়ে) সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে বলে মত প্রকাশ করেন বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র ব্যাখ্যার অধিকর্তা সর্বোচ্চ আদালতের সর্বোচ্চ স্থানে দায়িত্ব পালন করে আসা এই ব্যক্তি (বিচারপতি খায়রুল হক)।’ আসলে সাংঘর্ষিক তো হবেই না, বরং সংবিধানসম্মত হবে। এটা দুই অর্থে। ধরা যাক, রাষ্ট্রপতিপদ্ধতিতে আমরা ফিরব না। কিন্তু চাইলেও পারব না, তা ঠিক নয়। আবার সংসদীয় পদ্ধতি চাইলে ভারতের রাষ্ট্রপতির মতো বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে নির্বাহী ক্ষমতা দিতে হবে। যদিও এর ফলে কার্যকরভাবে তাঁর ক্ষমতা বাড়বে না। কিন্তু তাঁর মনস্তাত্ত্বিক অর্জন ঘটবে। সংবিধানটা ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধ হবে। চতুর্থ সংশোধনী রাষ্ট্রপতিকে নির্বাহী ক্ষমতা দিয়েছিল। সেটা কি সংবিধানের মূল চেতনাকে আঘাত করেছিল?
অষ্টম সংশোধনী মামলায় বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী মত দিয়েছিলেন, ‘রাষ্ট্রপতির হাতে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা-সংবলিত যে সরকারব্যবস্থা চালু রয়েছে, তা সংবিধানে অন্যতম মৌলিক কাঠামো। এটা পরিবর্তন করা যাবে না।’ তিন বছরের মধ্যে ১৯৯১ সালে এটা বদলে আমরা চতুর্থ সংশোধনীতে চালু করা রাষ্ট্রপতিপদ্ধতি রহিত করেছিলাম। যে দুজন ‘স্বৈরাচারী বন্দুকের জোরে’ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেছিলেন, তাঁর মতে সেটা রাষ্ট্রদ্রোহ ছিল। কিন্তু চতুর্থ সংশোধনীমতে, ১৯৮২ সালে যদি প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হতো, তাহলে তা নিশ্চয় রাষ্ট্রদ্রোহ হতো না।
রাষ্ট্রপতি শাসন এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে বলেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে বলেন তিনি। আমরা তাঁর সঙ্গে একমত হতে পারি। পাকিস্তান আমলে ওই এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল বলেই বঙ্গবন্ধু তাঁর ছয় দফায় সংসদীয় গণতন্ত্র চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭২ সালে সংবিধান লিখতে বসে ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ৩৯তম অনুচ্ছেদের ১ দফাটা অংশত নকল করে আমরা প্রধানমন্ত্রীর নামের আড়ালে সেই রাষ্ট্রপতিকেই আমদানি করেছিলাম। কিন্তু সাংবিধানিক ব্যাকরণ মানা হয়নি। কারণ, সেখানে রাষ্ট্রপতির হাতে প্রথামতে নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছিল। বাংলাদেশ সংবিধানে কারও হাতেই নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত (ভেস্ট) করা হয়নি।
দেশে সংসদীয় পদ্ধতির নামে দুই বিবদমান প্রতিপক্ষের সম্মতিতে কার্যত এক ব্যক্তির শাসন চলছে। তাই যখন ওই তথ্য তুলে ধরা হবে না এবং বাস্তবতা অগ্রাহ্য করে ‘রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতিতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়ার যে সুযোগ তৈরি হয়, বাংলাদেশের বর্তমান পদ্ধতিতে মন্ত্রিসভাকে যেহেতু জনগণের ভোটে নির্বাচিত পার্লামেন্টের কাছে জবাবদিহি করতে হয়, সেহেতু প্রভাবান্বিত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে’ বলা হবে, তখন তাতে সত্যের অপলাপ হবে। জনগণ ভুল বার্তা পাবে।
খায়রুল হক ভারতের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে ওয়েস্টমিনস্টার ধরনের যে গণতন্ত্র এখন প্রচলিত, ভারতে তা প্রায় ৭০ বছর ধরে ভালোভাবেই চলছে; সোয়া শ কোটি মানুষ এর সুফল পাচ্ছে। আমাদের দেশে না চলার কোনো কারণ নেই।’ আগেই বলেছি, ১৯৭২ সালে ওয়েস্টমিনস্টার তথা ভারতীয় মডেলের কঙ্কালটা এনেছিলাম, প্রাণটা আমরা আনিনি। সবিনয়ে নিবেদন করি, এটা নিছক মন্তব্য করার ব্যাপার নয়, দালিলিকভাবে প্রমাণ করে দেওয়ার ব্যাপার।
এটা না বদলে কেবল চর্চার মধ্য দিয়ে বিদ্যমান পদ্ধতির দুর্বলতা কাটবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনীর মামলায় তিনি (বিচারপতি খায়রুল হক) এ বিষয়ে যে পর্যবেক্ষণ (রায়ের ৯৭১ থেকে ৯৮৩ প্যারা দ্রষ্টব্য) দিয়েছেন, সে মতে প্রধানমন্ত্রীরা পথ চললে কোনো কথা ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। তাই ভারতীয় রাষ্ট্রপতিকে সংবিধান যেভাবে রেখেছে, সেভাবে আমাদের রাষ্ট্রপতিকেও রাখতে হবে। তিনি রায়ে লিখেন: স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে প্রকৃত সিদ্ধান্ত নেবে মন্ত্রিসভা, তৎপর প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তা প্রযুক্ত হবে।’
এ রায়ের ওই ১২টি প্যারায় যা লেখা, তার অর্থ মন্ত্রিসভাকে বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। ২০১২ সালের ১০ মে থেকে এর অন্যথা যা চলছে, আপিল বিভাগের রায়কে আইন মানলে আইনগতভাবেই তা প্রশ্নবিদ্ধ। নাগরিক সমাজের উচিত এই রায়টি পড়া এবং সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা। এ রায়ের পরে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় মন্ত্রিসভাকে বাদ দিয়ে যেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল, তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা ঘটেনি। তবে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সম্পর্কে এ অভিমতের জন্য তাঁর সাধুবাদ প্রাপ্য। ওই রায়ে তিনি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের শসমশের সিং বনাম পাঞ্জাব মামলার বরাতে বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই যে, রাষ্ট্রপতি তাঁর ব্যক্তিত্ব দিয়ে রাজনৈতিক সরকারকে সংযত ও শুধরে দেবেন।’ তবে এখানে কেবল সংস্কৃতির উন্নয়নের প্রশ্নই আসে না। আর সংস্কৃতি ও সংস্কারের মধ্যে বিরোধ নেই। আমরা দুটোরই অপেক্ষায় থাকলাম।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷