মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা; মাঝপথে বন্ধ হল ক্রেস্টের স্বর্ণ জালিয়াতির অনুসন্ধান
মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য বিদেশী বন্ধু ও সংগঠনকে দেওয়া সম্মাননা ক্রেস্টে স্বর্ণ জালিয়াতির (পরিমাণে কম দিয়ে আত্মসাৎ) অভিযোগের অনুসন্ধান মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে বন্ধ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট নাগরিক ও সংগঠনকে সম্মাননার সময় দেওয়া ক্রেস্টে যে পরিমাণ স্বর্ণ থাকার কথা ছিল তা দেওয়া হয়নি। আর ক্রেস্টে রুপার বদলে দেওয়া হয় পিতল, তামা ও দস্তামিশ্রিত শংকর ধাতু।
সুনির্দিষ্ট এ সব অভিযোগ ২০১৪ সালের জুন মাসের শুরুতে অনুসন্ধানে নামে দুদক। ওই মাসেই দুদকের উপ-পরিচালক মির্জা জাহিদুল আলমকে প্রধান করে একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়।
একই বছরের ৩ জুন দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলামের সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখার কথা সাংবাদিকদের জানান। জুলাই মাসের শেষের দিকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় নথিপত্র তলব করে তা সংগ্রহ করে টিম।
তবে অজ্ঞাত কারণে কমিশনের চেয়ারম্যানের ঘোষণা অনুসারে কাজ হয়নি। বরং কোনো কারণ ছাড়াই মাঝপথে এ জালিয়াতির অনুসন্ধান বন্ধ করা হয়েছে। দুদক সূত্র দ্য রিপোর্টকে এ সব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, কমিশনের ইচ্ছা অনুসারে ক্রেস্টে স্বর্ণ কম দেওয়ার অনুসন্ধান কাজ আর অগ্রসর করা হয়নি। পরবর্তী সময়ে কমিশনের আদেশেই অনুসন্ধানকারী টিম তাদের কাজ থেকে হাত গুটিয়েছে।
জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বলেন, ‘আমরা এ অনুসন্ধান আর করছি না। এ অনুসন্ধান বন্ধ করা হয়েছে।’
পরবর্তী সময়ে আবারও এ অনুসন্ধান করা হবে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন শুধু অনুসন্ধান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরে অনুসন্ধান করা হবে কিনা জানি না।’
মাঝপথে অনুসন্ধান বন্ধ করার কারণ জানতে চাইলে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘বন্ধ করার কোনো কারণ নেই।’
দুদক সূত্র জানায়, জাতীয় মান সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) পরীক্ষায় ক্রেস্টে স্বর্ণ জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। সাত পর্বে দেওয়া ওই সম্মাননার তৃতীয় পর্বে ৬১ ব্যক্তি ও সংগঠনের জন্য তৈরি করা ক্রেস্ট মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিএসটিআইয়ের কাছে পরীক্ষার জন্য পাঠায়।
সম্মাননা প্রদান-সংক্রান্ত নীতিমালায় বলা আছে, প্রতিটি ক্রেস্টে এক ভরি (১৬ আনা) স্বর্ণ ও ৩০ ভরি রুপা থাকবে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে করা বিএসটিআইয়ের পরীক্ষায় দেখা গেছে, এক ভরির (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) জায়গায় ক্রেস্টে স্বর্ণ পাওয়া গেছে মাত্র দুই দশমিক ৩৬৩ গ্রাম (সোয়া তিন আনা)। এক ভরির মধ্যে প্রায় ১২ আনাই নেই। আর রুপার বদলে ৩০ ভরি বা ৩৫১ গ্রাম পিতল, তামা ও দস্তামিশ্রিত শংকর ধাতু পাওয়া গেছে।
সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে একটি ক্রেস্টের জন্য অন্যান্য খরচের সঙ্গে দুই ভরির বেশি (২৩ দশমিক ৫ গ্রাম) স্বর্ণ ও ৩০ ভরি (বিলে লেখা গ্রাম, কিন্তু দাম ভরির) রুপার দাম পরিশোধ করা হয়েছে। উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান ছাড়া এ ক্রেস্ট কেনা হয়েছিল। ৩৩৮টির মধ্যে ৬০টি ছাড়া বাকি সব ক্রেস্ট সরবরাহ করেছে এমিকন নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে সরকার স্বাধীনতার চার দশক পূর্তি উপলক্ষে সাত পর্বে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু স্বনামধন্য ৩৩৮ বিদেশী ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনকে অন্যান্য উপহার সামগ্রীর সঙ্গে একটি করে ক্রেস্ট দেয়। তিন শ্রেণীতে এ সম্মাননা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা ও মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা হিসেবে সবার হাতে একটি করে ক্রেস্ট তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এর মধ্যে স্বাধীনতা সম্মাননা পান ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী (মরণোত্তর)। ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিসহ ১৩ বিশিষ্টজনকে দেওয়া হয় বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা। বাকি সব ব্যক্তি ও সংগঠনকে দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা।
ইন্দিরা গান্ধীকে দেওয়া স্বাধীনতা সম্মাননা ক্রেস্টটি ২০০ ভরি স্বর্ণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। এটিও সরবরাহ করে এমিকন। ২৪ ক্যারেটের (বিশুদ্ধতার সূচক) স্বর্ণ দিয়ে এটি তৈরি করার কথা ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় পরমাণু শক্তি কমিশনে ওই ক্রেস্টটি পরীক্ষা করে দেখতে পায়, তাতে ১০ দশমিক ১১ ক্যারেট স্বর্ণ রয়েছে। বাকিটা খাদ।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখায়রুজ্জামান বলেন, ‘এ ধরনের কার্যক্রমের জন্যই কমিশনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। কমিশনের উচিৎ ছিল গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধান করে সত্য উদ্ঘাটন করা।’
২০১৪ সালের ৩১ মে জাপান সফর নিয়ে গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ক্রেস্টে জালিয়াতির বিষয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশী বন্ধুদের সম্মাননা দেওয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই হঠাৎ কিছু লোক এটাকে ইস্যু করেছে। হইচই করার উদ্দেশ্যটা আমরা জানি৷ জামায়াত যেমন আমাদের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে না, এটাও তেমন একটা বিষয়।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, মায়ের গয়না বানালেও স্বর্ণকার সেখান থেকে একটু সোনা চুরি করে। বিদেশী বন্ধুদের দেওয়া ক্রেস্টে সোনা কতটুকু ছিল, সেটা বড় কথা নয়। উনাদের এনেছি এবং সম্মান দিয়েছি, এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ৷ এটা নিয়ে হইচই করে নিজেদের সম্মান খোয়াবেন না৷ নিজেদের চোর হিসেবে সাব্যস্ত করবেন না।’