ট্রাইব্যুনালের পাঁচ বছরে ১৫ ফাঁসি
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আসামিদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গত পাঁচ বছরে ১৪টি মামলায় ১৫ জনের ফাঁসির রায় দিয়েছেন।
একই সময়ে দু’জনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে।
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন— মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মাওলানা আব্দুস সুবহান, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, আলী আহসান মো. মুজাহিদ, এটিএম আজহারুল ইসলাম, মীর কাশেম আলী, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, প্রবাসী মঈন উদ্দিন-আশরাফুজ্জামান, মো. মোবারক হোসেন, জাহিদ হোসেন খোকন, ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বার এবং সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার।
এদের মধ্যে দু’জনের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয়েছে। কার্যকর হয়েছে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায়। এ ছাড়া কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে করা রিভিউয়ের শুনানী অপেক্ষমাণ।
পলাতক থাকায় মঈনউদ্দিন-আশরাফুজ্জামান, জাহিদ হোসেন খোকন ও ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বারের পক্ষে কোনো আপিল করা হয়নি।
এ ছাড়া বাকিদের পক্ষে আপিল দায়ের করা হয়েছে। সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিলগুলো শুনানীর অপেক্ষায় রয়েছে।
ট্রাইব্যুনালে অধ্যাপক গোলাম আযম ও আব্দুল আলিমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এই দু’জনই ইতোমধ্যে কারাগারে থাকাকালে মৃত্যুবরণ করেছেন।
এ ছাড়া জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলে আপিল বিভাগ তা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়। পরবর্তী সময়ে এ রায় কার্যকর করা হয়।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি যুক্ত করেন। এরপর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২০০৯ সালের ৯ জুলাই মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর সংশোধন করা হয়।
এরপর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩-এর ৬ ধারার বলে তিন সদস্যবিশিষ্ট ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।
পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত সমাপ্ত করতে ২০১২ সালের ২২ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গঠন করা হয়।
ট্রাইব্যুনাল গঠন ও বিচার কাজে স্বচ্ছতা, আন্তর্জাতিকমান রক্ষা নিয়ে শুরু থেকেই দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংগঠনের সমালোচনার মুখে পড়েন এ আদালত।
ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর মামলার তদন্ত, অভিযোগপত্র দাখিল, প্রমাণপত্র যোগাড় করে শুনানী শুরু করে তিন বছর লেগে যায় প্রথম রায় ঘোষণার জন্য।
বিচারপতি নিজামুল হককে চেয়ারম্যান করে বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির ও বিচারক জহির উদ্দিন আহমদের সমন্বয়ে প্রথম ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। বিচার ত্বরান্বিত করতে ট্রাইব্যুনাল-২ গঠিত হলে বিচারপতি ফজলে কবিরকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। তখন বিচারপতি আনোয়ারুল হককে দিয়ে ট্রাইব্যুনাল-১ পুনর্গঠন করা হয়। এরপর ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে ২০১২ সালের ২৮ আগস্ট পদত্যাগ করেন বিচারক জহির উদ্দিন আহমদ। এরপর বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনকে নিয়ে আসা হয় ট্রাইব্যুনাল-১-এ। স্কাইপ কেলেঙ্কারির দায় নিয়ে ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকও পদত্যাগ করেন। এর ১৩ ডিসেম্বর বিচারপতি ফজলে কবীরকে ট্রাইব্যুনাল-২ থেকে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। স্কাইপ কেলেঙ্কারির পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম।
একই সঙ্গে কাদের মোল্লার রায়ের পর ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করে তার শাস্তি বাড়ানোর পর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে বিচারের মান ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।
আসামিপক্ষের অভিযোগ, আন্তর্জাতিকমানের আদালত হলেও মান বজায় রাখা হয়নি। দেশীয় আইনে অভ্যন্তরীণ আদালতে যুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা হচ্ছে।
এ ছাড়া ডিজিটালের ছোঁয়া থেকে অনেকাংশে বঞ্চিত এ বিশেষ আদালত। ট্রাইব্যুনালের নামে একটি ওয়েবসাইট তৈরী করা হলেও নিয়মিত আপডেট করা হয় না। দেওয়া হয় না প্রতিদিনের মামলার কজলিস্ট। মামলার কজলিস্ট প্রদর্শনের জন্য ট্রাইব্যুনাল ভবনের মেইন ফটকে একটি মনিটর থাকলেও সেটিও এখন অকেজো।
ট্রাইব্যুনালের পাঁচ বছরপূর্তি উপলক্ষে প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে কিভাবে নিজস্ব আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা সম্ভব তা আমরা দেখিয়েছি। আর এটাই আমাদের গর্বের বিষয়।’
ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে আসামিপক্ষের আইনজীবী এ্যাডভোকেট শিশির মো. মনির বলেন, ‘এ আইনের কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। যেমন ট্রাইব্যুনালের কোনো আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা যায় না।’
তিনি বলেন, ‘স্কাইপ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের যে অনিরপেক্ষতা ও সাক্ষী বিশা বালীকে অপহরণের বিষয়টি আজও সুরাহা হয়নি।’
শিশির মনির অভিযোগ করে বলেন, ‘আসামিপক্ষের আইনজীবীদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়েছে। যা ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করে।’
একই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের শিখিয়ে আনা হয় এমন প্রমাণ আসামিপক্ষ আদালতে উপস্থাপন করেছিল, কিন্তু ট্রাইব্যুনাল তার কোনো পাত্তা দেয়নি। অথচ সেই আসামিকে আবার সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী।