কথাসাহিত্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
সাহিত্যের আরশিতে প্রতিবিম্বিত হয় একটি জাতি তথা একটি রাষ্ট্রের জীবন প্রণালী। প্রতিফলিত হয় সেই দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি। জীবন মানেই তো সাহিত্য, আবার সাহিত্য মানেই তো জীবন। সাহিত্যের একনিষ্ঠ সংজ্ঞা প্রায় অপ্রতুল। দেশ-কাল ভেদে এর সংজ্ঞা পাল্টায়। তবে সাহিত্য শব্দটি ‘সহিত’ শব্দ থেকে উদ্ভূত। সহিত অর্থ সংযুক্ত, সমন্বিত, হিতকর, সঙ্গে, সাথে। জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠ শিল্প সমন্বিত বাক্যবিন্যাসই সাহিত্য। সাহিত্য শব্দটি ‘সম্মিলন’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। সম্মিলন হল মনে-মনে, আত্মায়-আত্মায়, হৃদয়ে-হৃদয়ে মিলন। সাহিত্য শব্দটির সাথে হিত, কল্যাণ, মঙ্গলও সম্পর্কযুক্ত। সাহিত্য মানবজীবনের দর্পণ স্বরূপ। মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আস্থা-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য সাহিত্যে প্রতিফলিত হয় শৈল্পিক সৌন্দর্যে। সাহিত্যের আর এক নাম জীবন সমালোচনা (Criticism of life)। জীবন সত্যের বিশ্লেষণই এতে অঙ্গীকৃত। মানুষের আবেগ ও মননের (Emotion and Intellect) মাধ্যমে জীবনের সত্য, জীবনাতীতের সত্য ভাষার সৌন্দর্যে মণ্ডিত হয়ে সাহিত্যে উদ্ভাসিত হয়। সত্য যখন শব্দ শিল্পের পরশে সুন্দর হয়ে প্রকাশিত হয়, তখন তা যুগ যুগ ধরে সংবেদনশীল (Sensitive) হয়ে মানুষের মনে রসাবেদন সৃষ্টি করে।
মানব মনের এ ধরনের পবিত্র আনন্দ সৃষ্টি করা সাহিত্যের কাজ। এ জন্য মানব মনে সাহিত্যের প্রভাব খুব প্রবল, তার শক্তি বিপুল।
অন্য অর্থে, জীবন ও জগতের অন্তর্গত উপলব্ধিকে ভাবের ব্যাকুলতায় চিত্রময় চিত্রণ ও শিল্পসম্মত প্রকাশের নামই সাহিত্য। আসলে হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতির সহৃদয় প্রকাশই সাহিত্য।
অতএব সাহিত্যকে অবশ্যই শিল্প সুষমামণ্ডিত এবং রসোত্তীর্ণ হতে হবে। অলংকারের রূপসজ্জায় সুসজ্জিত এবং রুচিবোধ ও নৈতিকতাবোধে উত্তীর্ণ হতে হবে। কারণ, মানুষের মধ্যে দুটি সত্তা বর্তমান। একটি জৈবিক সত্তা, অন্যটি নৈতিক সত্তা। এই নৈতিক সত্তাই মানুষকে পশু থেকে পৃথক করেছে, দিয়েছে মানবিক মর্যাদা। ‘যে শিল্প সাহিত্যে নীতি-নৈতিকতাকে অস্বীকার করা হয়, সেটা মূলত মানবতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছাড়া আর কিছু নয়।
Mathew Arnold এ প্রসঙ্গে বলেন : A poetry of revolt against moral ideas is a poetry of revolt against life; A poetry of indifference to moral ideas is a poetry of indifference towards life.
‘একটি কবিতা বিদ্রোহ করে নীতিকথায়, একটি কবিতা বিদ্রোহ করে জীবনের বিরুদ্ধে; একটি কবিতা অনীহা প্রকাশ করে নীতিকথায় একটি কবিতা অনীহা প্রকাশ করে জীবনের প্রতি।’
কিন্তু প্রকৃত সাহিত্য বলতে আমরা তা বুঝি না। প্রকৃত সাহিত্য বলতে বুঝি— সে বিদ্রোহ করে নীতিকথার সমর্থনে, সে বিদ্রোহ করে জীবনের পরতে পরতে, ন্যায্যতায় এবং আকাঙ্ক্ষায়। প্রকৃত সাহিত্য কখনো জীবনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে না। জীবনকে নিয়েই তার বসতি, জীবনকে নিয়েই তার চলার পাথেয় সংগ্রহ করে অনিবার্য দ্রোহ ও প্রাজ্ঞতায়। জীবনের পক্ষেই তার যুদ্ধ, জীবনকে নিয়েই তার যুদ্ধ। যে সাহিত্য জীবনের কথা, দ্রোহের কথা, অনিবার্যতার কথা, প্রতিবাদের কথা বলে না সে সাহিত্য কখনই প্রকৃত সাহিত্যের মর্যাদা পায় না। সে সাহিত্য পুরোপুরি সাহিত্যের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত থেকে কালের আবর্তনে অপাংক্তেয় হয়ে ইতিহাস বিবর্জিত হয়।
সাহিত্য যেখান থেকেই জন্মলাভ করুক না কেন, তার অবয়বে থাকে তার জন্মস্থান, যুগ এবং পারিপার্শ্বিকতার ছোঁয়া। তাই সাহিত্যে যে কোনো মুক্তিকামী জাতির কথা যেমন স্পষ্ট হয়, তেমনি স্পষ্ট হয় মুক্তিযুদ্ধের কথা। মুক্তিযুদ্ধের শৈল্পিক প্রভাব পড়ে সাহিত্যের ওপর। সাহিত্য বহতা নদীর মতো অস্থিতিশীল। নদীর মতো সাহিত্যেরও রয়েছে অসংখ্য শাখা-প্রশাখা। যদিও রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সৃষ্টির ন্যায় সাহিত্যই সাহিত্যের উদ্দেশ্য।’ রবীন্দ্রনাথের এই উক্তিকে অস্বীকার করা যায় না। তবুও আমরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও লক্ষ্য করি। একটু লক্ষ্য করলেই আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয় উদ্দেশ্যও অনেক সময় মহৎ সাহিত্যের সৃষ্টি করে। তাই আমরা সাহিত্যের গবেষণায় দেখতে পাই, সাহিত্যের অনেকটা অবয়ব জুড়ে আছে নদী, নারী, প্রকৃতি, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম এবং এর বড় একটা অংশ জুড়ে আছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। যদিও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যের যাত্রা সত্তর দশক থেকে তবুও আমাদের সাহিত্যে এর গতি স্বতন্ত্র। সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধই আমাদের আলোচ্য বিষয়।
যুদ্ধ মাত্রই ধ্বংস, যুদ্ধ মানেই মৃত্যু আর যুদ্ধ মানেই ক্ষতির কারণ। তার পরও যুদ্ধ মানেই মুক্তি, যুদ্ধ মানেই শান্তি আর যুদ্ধ মানেই স্বাধীনতা।
মুক্তিযুদ্ধ এবং একুশ বাঙালী জাতির দুটি ঐতিহাসিক অধ্যায়। কিন্তু আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর যুদ্ধের প্রভাব পড়ে অনেক বেশি। জাতীয় অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়। আমরা যখন হাঁটি হাঁটি পা পা করে উন্নতির পথে এগোচ্ছি, দরিদ্র নামক বিশেষণ থেকে মুক্ত হবার জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষা করছি, সেই সময় যদি যুদ্ধ দেখা যায় তাহলে ভীতিজনক পরিস্থিতি এবং ধ্বংস কোনোটা থেকেই আমরা রক্ষা পাই না। যুদ্ধে আমাদের ক্ষতি হয়েছে অনেক, হারিয়েছি ত্রিশ লক্ষ তাজা গোলাপ। তবে এ কথাও সত্য যে, যুদ্ধের অনেক ক্ষতির সঙ্গে আমাদের চেতনাও হয়েছে ক্ষুরধার। আমাদের সাহিত্যের গতি হয়েছে পরিবর্তিত। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের লক্ষ্য নিরূপণে সহায়তা করেছে। দিয়েছে সঠিক উদ্দেশ্যের সন্ধান। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে আমাদের সাহিত্যে ছিল আঁধারের ঘনঘটা, পরাধীনতার নিগড়ে বাঁধা। সাহিত্যের সত্তা ছিল ধ্বংসের বিপণ্ন তিমিরে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মতো সাহিত্যের গণ্ডি ছিল পশ্চিমাদের নজরবন্দী। তবে সেই সব বাঁধার প্রাচীর ডিঙিয়ে অনেক লেখক কবি, সাহিত্যিক বেরিয়ে আসেনি এমন নয়। তবে তার জন্য অনেক মূল্যও দিতে হয়েছে। স্বাধীনতার পূর্বে পাকিস্তানের সাহিত্য বিকাশের সব ক’টি জানালা ছিল পশ্চিমাঙ্গনে। কিন্তু কবি সাহিত্যিকরা সেই পক্ষপাতিত্ব মেনে নেয়নি, নীরব থাকেনি। এই পক্ষপাতিত্বের অন্ধকারকে তারা সজোরে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে আলোড়িত হয়ে উঠেছেন। তারা তাদের লেখনির মাধ্যমে এ দেশের মাটিতে নতুন সূর্য উদয়ে উদ্যত হয়েছেন। তারা নতুন আলোকের সত্তায় জেগে উঠেছেন নতুন ভোরে।
কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের যে শক্তি ও সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছিল নানা দিক দিয়ে তার অকাল অবসান আমাদের হতাশার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। শিল্প সাহিত্যের দু-একটি মাধ্যম ছাড়া একাত্তরের সেই প্রচণ্ড অসাড়তা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও আমাদেরকে ব্যথিত করে। একুশের প্রেরণা বাংলাদেশের সাহিত্যকে দিয়েছে রাজনীতি মনস্কতা ও প্রতিবাদী চেতনা। একুশের পরবর্তী প্রজন্মের বাংলাদেশী সাহিত্যে রাজনীতি যেমন ব্যাপকভাবে উপজীব্য হয়ে উঠল, তেমনি দৃপ্ত করে তুলল তার প্রতিবাদী চরিত্রকেও। যার ফলশ্রুতিতে আমাদের সাহিত্য পাকিস্তানী মুসলিম তমদ্দুন ও শৌর্য-বীর্যের ধ্বজাধারী বীরগাথা থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে অসাম্প্রদায়িক সংবেদনশীল ‘আরেক ফাল্গুন’ ‘বরফ গলা নদী’, ‘সংসপ্তক’, ‘ক্রীতদাসের হাসি’, ‘জিব্রাইলের ডানা’-তে চলে আসে। এ সব উপন্যাস প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষভাবে লেখকেরা মহান একুশ এবং একুশের চেতনাকে চিত্রায়িত করেছেন হৃদয়ের উৎসারিত আনন্দ বেদনা ও স্মৃতির ভেতর দিয়ে। তারা তাদের লেখনী স্টাইলের নতুনত্ব দিয়ে ঐতিহ্যগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাঙ্ময় করে তুলেছেন ভাষা আন্দোলনের দীপ্ত সৈনিকদের শৌর্য-বীর্য। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ যে প্রবল পরাক্রমশালী সম্ভাবনার উপাদান মিশে ছিল তা কিন্তু সাহিত্যের সব শাখাতে সমান দাপটে বিচরণ করতে পারেনি।
একাত্তরের পূর্বে আমাদের সাহিত্যে কোনো যুদ্ধ ছিল না, যুদ্ধের কোনো ময়দান ছিল না। তবে সৈনিক ছিল, যেমন— কাজী নজরুল ইসলাম। তবে ইংরেজি, ফরাসি, রুশ সাহিত্যে যুদ্ধ আছে, ছিল। তাদের চলচ্চিত্রে ভুরি ভুরি যুদ্ধের ছবি আছে। তাদের প্রত্যক্ষ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে তারা সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। একাত্তরের আগ পর্যন্ত আমরা তা পারিনি। আবার একাত্তরের পরবর্তী সময়ের সৃষ্ট সাহিত্যও খুব একটা জোরালো নয়। একাত্তরের আগে আমাদের সাহিত্যিকরা ঐতিহাসিক ঘটনা, পুঁথি সাহিত্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছেন। মীর মশাররফ হোসেন লিখেছেন ‘বিষাদ সিন্ধু’। যা পাঠককে বীরত্ব ও উদ্দীপনায় জাগিয়ে রাখে। অবাক হলেও সত্য এই যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এই বিষাদ সিন্ধু’র মতো কোনো সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেনি। আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু চাইলে নিরাশ হতে হয়। সজীবতার টাটকা রঙের-রক্তের বড় অভাব এখানে। মুক্তিযুদ্ধের আগে ছিল স্বাধিকার আন্দোলন আর পরের আন্দোলন হচ্ছে স্বাবলম্বী হওয়ার আন্দোলন। আমাদের সাহিত্যের চাওয়াও ঠিক সে রকম। আমরা ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মতো কবিতা কিন্তু যুদ্ধের পর আর পাইনি। এ কবিতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পথ দেখিয়েছিল। যুদ্ধের চিত্র ছিল তার সারা অবয়বে। নজরুল ইসলাম তাঁর সাহিত্যে যুদ্ধের সংগ্রামী চেতনাকে অত্যন্ত বড় করে দেখেছেন, সেখানে যুদ্ধ নেই তবে যুদ্ধ করার মতো সাহসী মন আছে। তার ‘কামাল পাশা’ কবিতায় বিজয়ী সৈন্যদের উল্লাস, আশ্চর্য নৈপুণ্যের সঙ্গে সৈন্যদের মার্চ এবং নিয়মানুবর্তিতা সম্ভব হয়েছিল। কারণ তিনি নিজে একজন সৈনিক ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের জাতীয়তাবোধ উদ্বুদ্ধকারী লেখকরা যে সব সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন বলতে গেলে তার সবটুকুই এই মহান পূর্বসূরীয় অনুসরণ। তবে মুক্তিযুদ্ধের মান মূল্যায়নে বাক-বিতণ্ডা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ বাংলা সাহিত্যের নতুন দিক উন্মোচন করেছে।
একাত্তরের পূর্বে আমাদের সাহিত্যের স্বাধীনতা ব্যাহত হয়েছে প্রধানত দুটি কারণে। একটি রাজনৈতিক, অন্যটি অর্থনৈতিক। রাজনৈতিক চাপে লেখকদের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়েছে পৃথিবীতে এমন ইতিহাসের নজির রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুঁজিবাদীর ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধাচারণ করায় সাহিত্যিক হাওয়ার্ড ফাস্ট, সঙ্গীতজ্ঞ বোরমান এবং সিনেমা পরিচালক চার্লি চ্যাপলিনের ওপর নেমে আসে রাজনৈতিক নির্যাতন, আবার সোভিয়েত রাশিয়ার ব্যক্তিত্ব বিকাশের স্বপক্ষে কথা বলায় দস্তয়স্কির উপন্যাস প্রচার অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়। আমাদের স্বাধীনতার স্বপক্ষে লেখার অপরাধে কারারুদ্ধ করা হয় কবি ফয়েজ চৌধুরীকে। স্বাধীনতাকে নস্যাতের পরিকল্পনায় হত্যা করা হয় মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশাসহ অনেক বুদ্ধিজীবীকে। কিন্তু এইসব কিছু উপলক্ষ করে এ দেশের মুক্তিকামী মানুষ এনেছে তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা, তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং সর্বোপরি তাদের সাহিত্যিক স্বাধীনতা। এখন এ দেশের কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের আর গুম হয়ে যেতে হয় না, ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হয় না, হতে হয় না কারারুদ্ধ। এ দেশের সাহিত্যের উজ্জ্বল গতি আর হয় না ব্যাহত। এই সাফল্যের সবটুকু দাবিদার আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
আমাদের কথা সাহিত্য, সাহিত্যের অনেকাংশের একাংশ। কথাসাহিত্যে উপন্যাস সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় এবং ছোটগল্প এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বস্তুত সাহিত্যের এ দুটি শাখার ঐতিহ্য আমাদের বেশি দিনের নয়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লাল সালু (১৯৪৮ খ্রি.) উপন্যাসই সর্বপ্রথম বাঙালী মুসলমানদের নিয়ে রচিত। ভারতীয় উপমহাদেশে তখন কেবলমাত্র ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। পূর্ব বাংলা সেই পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের একটি প্রদেশ মাত্র। সেই সময় ঐ প্রদেশের না ছিল আলাদা সাহিত্য, না ছিল আলাদা ঐতিহ্য আর না ছিল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কোনো সামঞ্জস্য এবং ছিল না কোনো রাজনৈতিক পরিমণ্ডল।
আমাদের উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে কিন্তু এর পরিমাণ এত কম যে, তার সংখ্যা স্বল্পতা এবং এসবের শিল্পমান বিচারে আমাদের হতাশ হতে হয়। সামুরাইদের বাকা তরবারি এবং চন্দ্রমল্লিকা ফুল জাপানীদের কৃষ্টি। রাশানদের গর্ব তাদের বিপ্লব এবং আমাদের গর্ব হচ্ছে একুশ-মুক্তিযুদ্ধ। বিশ্ববিখ্যাত রাশান ঔপন্যাসিক তলস্তয়ের ওয়্যার এ্যান্ড পিস এবং এরেন বুর্গের ফল অব প্যারী হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। দুটো উপন্যাসই মহৎ এবং কালজয়ী সৃষ্টি। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে নিয়ে বিশ্ব সাহিত্যের অসংখ্য গল্প উপন্যাস লেখা হয়েছে। কিন্তু আমাদের ঔপন্যাসিকরা এ ব্যাপারে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে গর্ব করার মতো উপন্যাস বাংলাদেশের সাহিত্যে অনুপস্থিত। কেন এমন হল বা হচ্ছে সে বিতর্ক ভিন্নতর বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রচণ্ড সম্ভাবনার দুয়ারে দু-একজন ঔপন্যাসিক পদচারণা রাখতে শুরু করেছিলেন। তাদের ছিল অসীম সাহস আর শক্তি। তাই তো সেদিন আমরা পেয়েছিলাম জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে, আবু ইসহাকের সূর্যদীঘল বাড়ী, শওকত ওসমানের জননী। এগুলো ছিল গ্রামীণ জীবনভিত্তিক রচনা। আমাদের সাহিত্য নাগরিক উপন্যাসে ঋদ্ধ হয় আবুল ফজলের জীবন পথের যাত্রী, আবু রুশদের সামনে নতুন দিন রশিদ করিমের ‘উত্তম পুরুষ’, ‘প্রষণ্ন পাষাণ’, ‘আমার যত গ্লানি-এর মাধ্যমে।
পঞ্চাশ দশকে এসে বাংলাদেশ উপন্যাসে সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে, যা নানা পরিবর্তন ও বিবর্তনের মধ্যে সৃষ্টিশীলতায় আজও প্রবাহমান। বাংলাদেশে উপন্যাসের পালাবদলের যে ধারা তা লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই যে, আমাদের উপন্যাসের অধিকাংশই সময়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এই সময়ের স্রোত বেয়ে আসে মুক্তিযুদ্ধ, সৃষ্টি হয় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসসমূহের মধ্যে শহীদ আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’, শওকত আলীর ‘যাত্রা’, শওকত ওসমানের ‘নেকড়ে অরণ্য’, জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’, রশীদ হায়দারের ‘খাঁচায়’, সেলিনা হোসেনের ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’, মাহবুবুল হকের ‘জীবন আমার বোন’, রিজিয়া রহমানের ‘বং থেকে বাংলা’, রাবেয়া খাতুনের ‘মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী’, শাহিদা খাতুনের ‘যুদ্ধে যুদ্ধে নয় মাস’, জোবাইদা গুলশান আরার ‘সুবাস ফেরেনি’, হাসনাত আব্দুল হাইয়ের ‘নিখোঁজ’, রফিকুন্নবীর ‘পিস্তল’, আন্দালিব রুশদীর ‘সুসময়’, মঈনুল আহসান সাবেরের ‘সতের বছর পর’, রশীদ হায়দারের ‘নদী ও বাতাসের খেলা’ হুমায়ুন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’, ‘নির্বাসন’, জোছনা ও জননীর গল্প এবং ইমদাদুল হক মিলন লিখেছেন ‘কালো ঘোড়া’, ‘পরাধীনতা’ উল্লেখযোগ্য। বাংলা উপন্যাসের এই বিশেষ ধারাটি মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফল। ১৯৪৭ থেকে ১৯৮৬ খ্রি. পর্যন্ত বাংলাদেশের উপন্যাসে যে ধারা প্রবাহমান তা নব দিগন্তে সৃষ্টিশীলতায় উৎসারিত।
ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও মুক্তিযুদ্ধের ফলশ্রুতি ভাসমান। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছোট গল্পের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’, রাবেয়া খাতুনের ‘বাবার হাত’, বিপ্রদাশ বড়ুয়ার মুক্তিযুদ্ধের গল্পসমগ্র, আবুল খায়ের মোসলেহ উদ্দিনের ‘রক্তের রং লাল’ মোস্তবা আহমেদ মোরশেদের ‘মুক্তিযুদ্ধের ঘাসফুল ও রাইফেল’, মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়ার ‘বিজয়ী হয়ে ফিরব নইলে ফিরবই না’, এহসান চৌধুরীর ‘একাত্তরের গল্প’, কাজী ফজলুর রহমানের ‘ষোলই ডিসেম্বর’, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, ভবেশ রায়ের গল্প ‘জয়তু বাংলাদেশ’, হারুন হাবিব সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধ- নির্বাচিত গল্প’, মোহাম্মদ আলী নকী ও মোহাম্মদ ইমামউদ্দীন সম্পাদিত ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই’। ছদরুদ্দীনের মুক্তিযুদ্ধের বিশ্লেষণাত্মক গল্প ‘মুক্তিযুদ্ধ : বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে’, ‘মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাতটি ছোটগল্পের সংকলন’ বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ‘সাদা কফিন’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও আব্দুল গাফফার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর প্রমুখ লেখকসহ বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেক লেখকের লেখায়ই মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক বিষয় উপজীব্য হয়ে আছে, যা কোনোক্রমেই অবহেলার নয়।
বাংলা সাহিত্যে প্রবন্ধের স্থান অতুচ্চে সমাসীন। জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধা, প্রজ্ঞা, যুক্তি-তর্কসহ বুদ্ধি চিন্তার বিচিত্র রকম প্রকাশ যা প্রবন্ধের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সাহিত্যের এই শাখার বিপুল বিস্তার ঘটে উনিশ শতকের প্রথমার্ধেই। প্রবন্ধকার হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, শিবনাথ, কেশব চন্দ্র, মীর মশাররফ হোসেনসহ অনেকেরই আবির্ভাব ঘটে এই সময়েই। তারা অনেক ঋদ্ধ প্রবন্ধ লিখে বাংলা সাহিত্যকে করেন সমৃদ্ধ। লুৎফর রহমানের মহৎ জীবন, উন্নত জীবন উল্লেখযোগ্য। তা ছাড়া রবীন্দ্রনাথ, জগদীশ চন্দ্র ঐতিহাসিক, সামাজিক, পারিবারিক ও আধ্যাত্মিক প্রবন্ধ রচনা করেন। যা আজকের লেখকদের স্রোতধারায় পূর্ণতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান স্বাধীনতা প্রবাহযুক্ত প্রাবন্ধিকদের প্রবন্ধে মননশীলতা ও পাণ্ডিত্যের পরিচয় রাখছেন এরা হচ্ছেন— ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এম. আর. আখতার মুকুল, আনিসুজ্জামান প্রমুখ। বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো প্রবন্ধে মুক্তিযুদ্ধের যে দান আছে তা উপেক্ষিত নয়।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক সফল মঞ্চ নাটক রচিত হয়েছে। নাটক জীবনের প্রতিফলিত রূপ। নাটক সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রাত্যহিক জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত দ্বন্দ্ব নিয়ে রচিত হয়। বাংলা ভাষার প্রথম নাটক রচনা করেন তারাচরণ, হরেণ ঘোষ প্রমুখ নাট্যকার। তবে তাদের নাটকগুলি ছিল ইংরেজি নাটকের প্রভাবে এবং অনুকরণে। যুগের সাথে সাহিত্যের রূপ বদলায়। তাই আমাদের নাটকেও আসে বদলের ধারা। আসে রবীন্দ্র যুগ, নজরুল যুগ। সৃষ্টি হয় অসংখ্য নাটক। তবে তা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নয়। একাত্তরের পর আসে যুদ্ধকেন্দ্রিক একান্ত নাটক। নাট্যকারগণ নবচেতনায় যাত্রা করেন নাট্যতরী নিয়ে। আনিস চৌধুরী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, মমতাজ হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, ফজলুল করিম, আসকার ইবনে শাইখ প্রমুখ নাট্যকার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রাণস্পর্শী সব নাটক রচনা করেছেন। তৌকির আহমদ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা ‘জয়যাত্রা’র মাধ্যমে ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছেন। স্বাধীনতাভিত্তিক নাটকগুলিতে কাহিনী নির্বাচন, রচনাশৈলীর নতুনত্বে, চরিত্র সৃষ্টিতে, সার্থক সমন্বয় সাধনে যথেষ্ট পরিপক্কতার ছাপ পাওয়া যায়। বিশেষ করে প্রতিশ্রুতিশীল গীতি নাট্যের নাট্যকারদের সাধনায় ক্রমশ সাহিত্য ফুলে ফলে সুশোভিত হতে পারবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
প্রবাহমান কালের আঘাত যখন সমাজের বুকে পরিবর্তন ঘটায়, তেমনি সাহিত্যেও ঘটে ভাবান্তর ও রূপান্তর। তাই মুক্তিযুদ্ধের ফলে আমাদের সাহিত্যেও ঘটেছে পরিবর্তন। পরিবর্তন ঘটেছে আমাদের গ্রামীণ পল্লী সমাজেও। পল্লী সাহিত্য কেবল একজন মানুষকে আনন্দ দিয়েই আসছে না, এখানে খুঁজে পাই আমরা আমাদের জীবনের শাশ্বত বোধ, জাতীয় কৃষ্টি, সংস্কৃতি, কালচার, রুচি এবং চেতনার স্বাক্ষরের। আগে বুড়ি দাদীর গল্পের রাক্ষস-খোক্ষসের জায়গায় এসেছে চাঁদ এবং মঙ্গল গ্রহে পাড়ি দেবার গল্প, এসেছে একাত্তরের পাকিস্তানী দানবদের অমানবিক অত্যাচারের লোমহর্ষক দিনগুলোর কথা, এসেছে ত্রিশ লক্ষ শহীদের তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার কথা, এসেছে কিভাবে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে স্বাধীন হতে হয় সেইসব কাঙ্ক্ষিত প্রাণময় টগবগে কথা সব। যা আমাদের চেতনাকে শাণিত করে, আলোড়িত করে, বিলোড়িত করে। আমাদের চেতনা আকাশ ছোঁয়, আমরা বিশ্বের মানচিত্রে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল হয়ে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকি অমলীন। কালের গণ্ডি পেরিয়ে আজ আমরা নব নব সৃষ্টির নেশায় উন্মত্ত। আমাদের সাহিত্য আজ অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে মহাসাগরের বুকে ধাবমান। এই জয়ের সবটুকু দাবিদার আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিকামী বাঙালী যোদ্ধারা সব। তাই তো সাহিত্যের সব শাখাই মুক্তিযুদ্ধের মতো মিশে আছে আমাদের শরীরের সাথে মিশে থাকা সব শিরা-উপশিরার মতো ওৎপ্রোত- নির্ভরতায়।
লেখক : কবি, গবেষক ও কথাসাহিত্যিক