১৯৭১-এর অগ্নিঝরা মার্চ; হায়েনাদের তাড়ানোর পূর্বপ্রচেষ্টা

last-Sadinota_1মহসীন দেওয়ান লিটন
স্বাধীনতা যুদ্ধ কোনো সামরিক অভিযান নয়— স্বাধীনতার যুদ্ধ জনগণের যুদ্ধ। জনগণের অংশগ্রহণ ব্যতীত কোনো স্বাধীনতা সংগ্রাম হতে পারে না। মুক্তির সশস্ত্র চূড়ান্ত যুদ্ধে বিজয় অর্জন সম্ভব হয় না। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ধর্মের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশকে বিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তান নামের দু’টি পৃথক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। এর ছিল দু’টো অংশ— পূর্বাঞ্চল, যা পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিমাঞ্চল, যা পশ্চিম পাকিস্তান নামে পরিচিত হয়। পাকিস্তানের ৮০ ভাগেরও বেশী অধিবাসীর ধর্ম এক ও অভিন্ন, শুধু এইটুকু মিল ছাড়া পাকিস্তান নামক এই নতুন রাষ্ট্রটির দু’টি অংশের অন্য সবক্ষেত্রেই ছিল বহু ধরনের বৈসাদৃশ্য।
এই দুই অংশ ছিল হাজার মাইলেরও বেশী ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বিচ্ছিন্ন। শুধু তাই নয়, দুই অংশের অধিবাসীদের সামাজিক রীতিনীতি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং ভাষা ছিল সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন।
পূর্ব পাকিস্তানের ৯০ ভাগেরও বেশী মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হওয়ায় সুদীর্ঘকাল ধরে সমস্ত পৃথিবীতে তারা ‘বাঙ্গালী’ হিসেবে পরিচিত ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান ছিল মূলত পাঞ্জাবী, পাঠান, বেলুচ এবং সিন্ধীদের আবাসভূমি। সেখানে পাঞ্জাবীরাই বেশী। ওদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৯০ ভাগ সদস্য ছিল অবাঙ্গালী এবং মাত্র ১০ ভাগ বাঙ্গালী, যদিও পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ ভাগই ছিল বাঙ্গালী। সামরিক বাহিনীর বাঙ্গালীদেরকে আবার বিভিন্ন ইউনিটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখত, যাতে তাদের অস্তিত্ব অনুভবই করা যেত না। ফলে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী সুস্পষ্টভাবেই ‘অবাঙ্গালী বাহিনী’ হিসেবেই গড়ে উঠতে থাকে। আগেই প্রায় দু’শ’ বছর বাঙ্গালী নিষ্পেষিত হয়েছে ব্রিটিশ শাসনের যাঁতাকলে। তারপর ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশকে বিভক্ত করে চলে যায়। কিন্তু হাজার মাইল দূরত্ব হলেও দুই পাকিস্তান একই দেশ তাই এবার পশ্চিমারা পূর্ব পাকিস্তানের উপর ব্রিটিশদের মতোই শোষণ চালাতে শুরু করে।
এমনি অব্যাহত শোষণ, অত্যাচার, ও নিপীড়নের ফলে এ দেশের মানুষের মনে তীব্র বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে দিনের পর দিন। দু’দশকেরও অধিক সময় ধরে জ্বলে বিক্ষোভের আগুন। একদিন বিক্ষোভের সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের প্রচণ্ডতা আর দ্রুততায়। মুহূর্তেই নিশ্চিহ্ন করে দেয় অন্যায়ের শাসন-শোষণের সমস্ত বাধা বন্ধন। ১৯৬৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এ্যাসোসিয়েশন (ইউএনএ) শিক্ষা প্রকল্পের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানকে ৮৫ লক্ষ মার্কিন ডলার ঋণ দেয়। অথচ পূর্ব পাকিস্তানে জনসংখ্যা অনেক বেশী হওয়া সত্ত্বেও মাত্র ৪৫ লক্ষ মার্কিন ডলার তা থেকে দেওয়া হয়। আবার ৩৬০ কোটি ডলারের মার্কিন সাহায্যের ২৭০ কোটি ডলারই ব্যয় করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে অথচ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের জন্য মাত্র ৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল।
এ রকম আরও হাজারও কারণের জন্য ১৯৭০-এর ১৯ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করলেন ৬ দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হবে এবং এ বিষয়ে কোনো আপোষ করা হবে না। পক্ষান্তরে পাকিস্তান পিপলস পার্টির জুলফিকার আলী ভূট্টো ২০ ডিসেম্বর ঘোষণা করলেন, তার দলের সমর্থন ছাড়া কোনো সংবিধান প্রণয়ন বা সরকার গঠন কর যাবে না। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের ইয়াহিয়া, ভূট্টো ও সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তারা বাঙ্গালীদের গণহত্যার পরিকল্পনা ও তা সংঘটনের চেষ্টা করছেন। মূলত ১৯৭১-এর জানুয়ারী থেকেই গণহত্যার প্রস্তুতি শুরু করেন। জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে সেনাবাহিনীর ৯ এবং ১৬ ডিভিশনকে সর্বোচ্চ প্রস্তুত করে রাখেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই দু’টো ডিভিশনই ছিল সংরক্ষিত আক্রমণকারী বাহিনী। জানুয়ারীর মাঝামাঝি ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার উদ্দেশ্যে তাঁর কয়েকজন সিনিয়র স্টাফ অফিসার নিয়ে ঢাকায় আসলেন।
এসে তারা এমন প্রচারণা চালালেন, “রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের উদ্দেশ্যে সদিচ্ছাপূর্ণ আলোচনা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।” চূড়ান্ত আঘাত হানার লক্ষ্যে পূর্বাঞ্চলে সৈন্য সমাবেশের জন্য এই ধরনের আলাপ-আলোচনার ছলে তাদের সময়ক্ষেপণ প্রয়োজন ছিল। ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করার সময় বললেন, আলোচনায় তিনি সন্তুষ্ট এবং এ বক্তব্যকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী’ হিসাবে অভিহিত করার মতো ভণিতা করতেও দ্বিধা করলেন না। কিন্তু ঢাকা থেকে তিনি ‘হাঁস শিকারে’র নাম করে গিয়ে উঠলেন সরাসরি ভূট্টোর লারকানাস্থ বাসভবনে। অন্যান্য জেনারেল ছাড়াও সেখানে সেনাবাহিনীর চীপ অব স্টাফ জেনারেল হামিদ খান তাঁর চিফ স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদা তাঁর সাথে মিলিত হলেন।
দ্রুত ঘটে যাওয়া পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ একটি বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না যে, লারকানা যাওয়া ছিল আসলে চক্রান্তের জন্যেই। লারকানায় ভূট্টো, ইয়াহিয়া ও তাদের দোসররা একত্রিত হওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ১৯৭১-এর নয় মাসব্যাপী গণহত্যার সূচনা, যা এই লারকানা চক্রান্তরই ফল। আর তাই লারকানায় এই প্রতারণামূলক যাত্রাবিরতির পর থেকেই উপমহাদেশের ঘটনাপ্রবাহ ধীরে ধীরে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে গড়িয়ে চলে।
এরপর ভূট্টো ১১ ফেব্রুয়ারী রাওয়ালপিন্ডিতে ইয়াহিয়া খানের সাথে দীর্ঘ আলোচনায় বসলেন। ১৩ ফেব্রুয়ারী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঘোষণা করলেন ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। দু’দিন পর ১৫ ফেব্রুয়ারী পেশোয়ারে ভূট্টো ঘোষণা করলেন, শাসনতন্ত্র প্রণয়নে আওয়ামী লীগ তাঁর পার্টির মতামত প্রকাশে আগ্রহ করলে তাঁর দল পরিষদের অধিবেশন বর্জন করবে। এদিকে ১৫ ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিবুর রহমান আশংকাপ্রকাশ করলেন যে, “ক্ষমতা হস্তান্তর বিলম্বিত করার ষড়যন্ত্র চলছে।” ১৭ ফেব্রুয়ারী ইয়াহিয়া খান তার বেসামরিক মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিলেন।
লক্ষ্য করা গেল, তার ঠিক পরদিনই ১৮ ফেব্রুয়ারী ভূট্টো ইয়াহিয়া খানের সাথে এক দীর্ঘ বৈঠকে মিলিত হন। ২২ ফেব্রুয়ারী সেনাবাহিনীর রাওয়ালপিন্ডিস্থ সদর দফতরে সিনিয়র জেনারেলদের নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক গোপন বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ক্ষমতা কিছুতেই বাঙ্গালীদের হাতে দেওয়া যাবে না। বরং পশ্চিম পাকিস্তানীদের সকল নির্দেশ মানতে তাদের বাধ্য করা হবে। তাদের ধারণা পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন মুষ্টিমেয় রাজনীতিবিদের সৃষ্টি। কাজেই কয়েক হাজার বাঙ্গালীকে নির্বিচারে হত্যা করে সমস্ত বাঙ্গালী জাতিকে ভীতসস্ত্রস্ত করে ফেলতে পারলেই এই আন্দোলন স্তব্ধ করে দেওয়া যাবে।
সে সভায় টিক্কা খান ইয়াহিয়া খানকে বলেছিনে, এক সপ্তাহের সময় দিন, পূর্ব পাকিস্তানে আমি স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারব। ২৬ ফেব্রুয়ারি ভূট্টো করাচীতে আরেক দফা বৈঠকে মিলিত হন ইয়াহিয়ার সাথে। এর দু’দিন পরই ভূট্টো জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার দাবী জানান। সে দিন রাতেই কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে পিপআই-এর একটি বোয়িং বিমানে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রথম সৈন্যদল ঢাকা এসে পৌঁছল। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন সেনা নিবাস থেকে ট্যাংক ঢাকায় নিয়ে আসা হল এবং আনার পর পরই ট্যাংকগুলোতে সফট্র্যাক লাগিয়ে সেগুলোকে শহরের রাস্তায় চলাচলের উপযোগী করে তোলা হল। ১লা মার্চ ১৯৭১ আকস্মিকভাবেই পাকিস্তান রেডিও ইয়াহিয়া খানের একটি ঘোষণা প্রচার করল “পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের নেতাদের মধ্যে দুঃখজনক মতবিরোধের কারণে পরবর্তী তারিখ ঘোষণা না করা পর্যন্ত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখা হল।” জনতার বিক্ষোভ প্রচণ্ডরূপ ধারণ করল মুহূর্তেই, গোটা পূর্বাঞ্চলে সে বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ল। আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিল সারাদিনব্যাপী হরতালের— ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ দেশব্যাপী। সেই সঙ্গে ঘোষণা দেওয়া হল, ৭ মার্চ ঢাকায় এক ভাষণ দেবেন শেখ মুজিবুর রহমান। যেকোনো চরম পরিণতির জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকল বাঙ্গালীরা।
এক অভূতপূর্ব ঐক্যের ভিত রচিত হল। গড়ে উঠল অটুট ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। প্রচারপত্রে ছেয়ে গেল ঢাকা শহর— “৬ দফা নয়, ১ দফা (অর্থাৎ স্বাধীনতা) চাই”।

এদিকে ইয়াহিয়া ৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে তিনি ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের নতুন তারিখ ঘোষণা করলেন। কিন্তু ইয়াহিয়ার এই ঘোষণায় কোনো কাজই হল না। গণঅভ্যুথান দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে লাগল চারিদিকে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট ভেঙ্গে ৩৫০ জন বন্দী পালিয়ে গেল। নিরাপত্তা রক্ষীরা এখানে গুলিবর্ষণ করলে ৭ জন নিহত এবং ৩০ জন আহত হল। একই দিনে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের পদ থেকে ভাইস এ্যাডমিরাল আহসানকে সরিয়ে লেঃ জেনারেল টিক্কা খানকে নিযুক্ত করা হল। টিক্কার ঢাকায় আগমন ঘটল ৭ই মার্চ। পশ্চিম পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশে নির্মমভাবে এক অভ্যুত্থান দমন করতে টিক্কা খান শত শত নিরস্ত্র বালুচবাসীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলেন— চরম নির্মমতায়, অনুতাপহীন পাশবিকতায়। এ জন্য ‘বালুচিস্তানের কসাই’ উপাধি অর্জন করেছিল টিক্কা খান। এই নিয়োগে স্বাভাবিকভাবেই সৃষ্টি হল ব্যাপক প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া। পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জনাব বি, এ, সিদ্দিকী গভর্নর হিসেবে টিক্কা খানকে শপথগ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন।
সেদিন সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম হালিশহরে সেখানকার ইপিআর বাহিনীর প্রধান মেজর রফিকুল ইসলাম তার অফিসে অল্প কয়েকজন বিশ্বস্ত বাঙ্গালী জেসিও এবং এনসিও কে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তাদের কী ধরনের প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ নিতে হবে এ বিষয়ে ‘ব্রিফিং দেওয়ার জন্য এক গোপন বৈঠকে বসলেন। তবে এ ধরনের একটা মারাত্মক বিষয়ে আলোচনা ছিল বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ। সে সময়ে ইপিআর-এ শতকরা ৮০ ভাগ বাঙ্গালী এবং ২০ ভাগ অবাঙ্গালী ছিল। বাঙ্গালীরা মেজর রফিকুল ইসলামের নির্দেশ মত কাজ শুরু করেছিল। কয়েকজন তো তাদের অবাঙ্গালী সহকর্মীদের কাছে বলতে লাগল (কিছুটা অভিযোগের মতো)— “এই এ্যাডজুটেন্ট সাহেব আমাদের অতিরিক্ত খাটাচ্ছেন। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ডিউটির ব্যাপারে তাঁর এত বেশী ঘন ঘন আদেশে আমরা অস্থির আর পারছিনে।” তাদের এ ধরনের বক্তব্য বৈঠকের ব্যাপারে অবাঙ্গালীদের সন্দেহমুক্ত রাখে। যে সময় পরিকল্পনাগুলো তৈরী করে সবাইকে সেই অনুসারে নীচের দায়িত্বগুলো পালনের নির্দেশ দিলেনঃ
১. যেকোনো ঘটনার জন্য সতর্ক এবং প্রস্তুতি নিয়ে থাকতে হবে। পাকিস্তানীদের আকস্মিক আক্রমণ প্রতিহত করে নিজেদের জীবনরক্ষার প্রস্তুতি নিলেই চলবে না, সে আক্রমণ থেকে আমাদের জনগণকে রক্ষার প্রস্তুতিও থাকতে হবে।
২. ইপিআর-এর অস্ত্রাগার এবং বেতার কেন্দ্রগুলোর ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে।
৩. সকল যানবাহন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
৪. ফিল্ড সিকিউরিটি ডিটাচমেন্ট (গোয়েন্দা ইউনিট)-কে পোর্ট বিমান বন্দর এবং নেভাল বেইজ এলাকায় সকল কার্যকলাপের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখার দায়িত্ব দেওয়া হবে।
৫. সম্ভব হলে অন্যান্য ইপিআর সেক্টরের সঙ্গে তথ্য বিনিময়ের জন্য নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা হবে।
৬. অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে অবাঙ্গালী সৈন্যদের অস্ত্রশস্ত্র থেকে ফায়ারিং পিন খুলে রাখতে অথবা নষ্ট করে ফেলতে। কিছু সাংকেতিক বার্তার গোপন অর্থ ও জানিয়ে দিলেনঃ
(ক) আমার জন্য কিছু কাঠের ব্যবস্থা কর— এর অর্থ ছিল আধঘণ্টার মধ্যে পরবর্তী আদেশ এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকো।
(খ) আমার জন্য কিছু কাঠ নিয়ে আস— এর অর্থ ছিল বিপক্ষের সবাইকে গ্রেফতার, প্রয়োজনবোধে ধ্বংস করে শহরে পূর্বনির্ধারিত বিভিন্ন যুদ্ধাবস্থানের দিকে অগ্রসর হওয়া।
পরের দিন ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করলে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনী এবং বিমানবাহিনী যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে অবস্থান করছিল, গোলাবর্ষণের জন্যে গোলন্দাজ বাহিনীর কামান বসানো হয়েছিল।
গোলাবর্ষণের নির্দেশ দেওয়ার জন্য ঢাকার আকাশে একটি পর্যবেক্ষণ হেলিকপ্টার উড়তে থাকে। শেখ মুজিবুর রহমান এই সভায় ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার নির্দেশ দিবেন। সভা শুরুর আগেই অকুতোভয় জনতা মিছিল করে রমনা রেসকোর্স মাঠের দিকে যেতে থাকে। শত শত অগণিত মিছিল। এতে এসেছে সমাজের সকল স্তরের লোক নারী, পুরুষ, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, সরকারী চাকুরের এমনকি সাদা পোশাকে ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যবৃন্দ। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সর্বাধিক অর্থবহ ও গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো ছিলঃ
১. আমি যদি হুকুম দেবার নাও থাকি, আপনারা সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।
২. খাজনা ট্যাক্স সব কিছু বন্ধ করে দেবেন।
৩. এবারের সংগ্রাম মুক্তির ও স্বাধীনতার সংগ্রাম।
৪. শুধু স্থানীয় এবং আন্তঃজেলা টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা চালু থাকবে।
৫. সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
৬. ব্যাংকসমূহ স্টেট ব্যাংকের মাধ্যমে অথবা অন্য কোনো উপায়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে টাকা-পয়সা পাঠাতে পারবে না।
৭. প্রতিটি গ্রাম, মহল্লা, থানা, মহকুমা এবং জেলায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে।
৮. সামরিক আইন তুলে সকল সৈন্য ব্যারাকে ফিরত নিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
এর ফলে ৮ মার্চ থেকে সংগ্রাম এক সুনির্দিষ্ট রূপ লাভ করল। ৯ মার্চ লেঃ জেনারেল টিক্কা খান সামরিক আইন প্রশাসকের পদে নিযুক্ত হল। ১০ই মার্চ বিদেশী নাগরিকরা পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে যেতে শুরু করল। এই দিন নারায়ণগঞ্জ জেলখানা থেকে ৪০ জন কয়েদী পালিয়ে গেল। নিরাপত্তা রক্ষীরা গুলি চালালে একজন কয়েদী নিহত এবং ২৫ জন আহত হল।
১১ মার্চ গুজব রটে যে, ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে আসছেন। আরেকটি জেলের গেট ভাঙ্গার ঘটনা ঘটল বরিশালে। ওখানেও রক্ষীদের গুলিতে ২ জন নিহত, ২০ জন আহত এবং ৪০ জন কয়েদী পালিয়ে যেতে সক্ষম হল। ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া খান ঢাকা এলেন। তার সাথে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হল। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বললেন, “সমঝোতার জন্যে আলোচনা চলছে এবং আরও আলোচনা চলবে। আমাকে আর প্রশ্ন করবেন না।”
১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়ার আর এক দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হল। ভূট্টোর যোগসাজশে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তা গণহত্যার যে পরিকল্পনা নিয়েছে তা বাস্তবায়নের পূর্বে সমস্ত প্রস্তুতি চূড়ান্ত করনে সময়ের প্রয়োজন— আর আলোচনার নাম করেই পশ্চিমারা সে সময়টুকু নিয়ে নিচ্ছে। ১৯শে মার্চ বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া পুনরায় বৈঠক বসলেন। বৈঠকের অগ্রগতি সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেন “আমি বেশ ভাল কিছু আশা করছি। তবে অত্যন্ত খারাপ কিছুর জন্যেও প্রস্তুত রয়েছি।”
পরের দিন (২০ মার্চ) কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য ঢাকায় আসলেন। এর একদিন পর (২১ মার্চ) ভূট্টো ঢাকা পৌঁছে দু’ঘণ্টাব্যাপী একান্ত গোপন আলোচনা করলেন ইয়াহিয়ার সঙ্গে। পরদিন ২২শে মার্চ বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া এবং ভূট্টোর মধ্যে এক যৌথ বৈঠক অনুষ্ঠিত হল। ২৩শে মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসের নির্ধারিত সব অনুষ্ঠান বাতিল করে ইয়াহিয়া এমন ভান করলেন যে সে খুব ব্যস্ত রাজনৈতিক নেতাদের সাথে বৈঠকে। ২৪শে মার্চ চট্টগ্রামে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র গোলাবারুদ নামানো শুরু করলে শ্রমিকরা কাজ করতে অসম্মতি জানায়। এর পরদিন ২৫শে মার্চ বৃহস্পতিবার রাতে ইয়াহিয়া পালিয়ে চলে গেলেন। আর সে রাতেই বর্বর পশ্চিমারা ঢাকা শহরে চরম আঘাত হানল।
এরপর আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু। নয় মাস যুদ্ধ করে ৩০ লাখ শহীদ ও লাখ লাখ বোনের আব্রুর বিনিময়ে আমরা বিজয় লাভ করলাম; অনেক বেশী ত্যাগে রক্তের পিচ্ছিল পথ বেয়ে অর্জিত হল প্রিয় স্বাধীনতা। আমাদের এই অর্জনকে সমুন্নত রাখতে আমাদেরকে দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করার মধ্যেই হোক বিজয় দিবসের প্রত্যয় ও প্রত্যাশা।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের উদ্যোক্তা সদস্য

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend