হাত-পা বাঁধা, দৌড়াতে ভয় বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীদের
ইচ্ছা থাকলেও ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিষয়ে নানা ধরনের শঙ্কায় রয়েছেন বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীরা। তাদের কাছে এ প্রতিযোগিতা অনেকটা হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মতো। চলমান আন্দোলনে বিভিন্ন মামলা ও পুলিশি হয়রানির শিকার হয়ে ইতোমধ্যেই আত্মগোপনে ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় চলে গেছেন সিটি নির্বাচনে সম্ভাব্য বিএনপি দলীয় কমিশনার প্রার্থীরা।
বিপরীতে তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণায় রঙবেরঙের ব্যানার, বিলবোর্ডে ছেয়ে যায় রাজধানী ঢাকা। কিন্তু তফসিল ঘোষণার ৭দিন পরও বিএনপির কোনো প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চোখে পড়েনি। যাদের অধিকাংশই গত সিটি করপোরেশনের কমিশনার পদে জয়ী হয়েছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২০০৭ সাল থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে থাকা দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মীই বিভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রতিহিংসামূলক মামলার শিকার হয়েছেন। এর সঙ্গে গত ৬ জানুয়ারি থেকে দেশে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে চলতে থাকা লাগাতার অবরোধ কর্মসূচির সময়েও নতুন করে রাজধানী ঢাকার হাজারো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ সব মামলার কারণে মহানগর ঢাকার বিভিন্ন থানা, ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই বাড়ি ছেড়ে আত্মগোপন ও ফেরারি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে পরিচিত স্বজন ও দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও বিচ্ছিন্ন রেখেছেন সকল প্রকার যোগাযোগ। বিচ্ছিন্ন করেছেন নিজের যোগাযোগের মোবাইল নম্বরও। এ অবস্থায় সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নিজেকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করতে সাহসী হয়ে উঠছেন না বিএনপি দলীয় স্থানীয় নেতারা।
নাম না প্রকাশের শর্তে মিরপুর এলাকার এক বিএনপি নেতা বলেন, মিথ্যা মামলা-হামলার কারণে দীর্ঘদিন ধরেই আমরা এক প্রকার পলাতক জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছি। আত্মগোপনে থেকেও অনেকেই গ্রেফতারের শিকার হচ্ছেন। সঙ্গে রয়েছে আটকের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্বীকার। এ সবের পর কেমন করে নির্বাচনে প্রার্থী হই বলুন।
সিটি নির্বাচনে কমিশনার হিসেবে নিজের আগ্রহের কথা স্বীকার করে বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, ‘হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের পরিণতির কথা ভেবে বিএনপির অনেক নেতাকর্মী ইচ্ছা থাকার পরও ডিসিসি নির্বাচন বিষয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছে।’
বিএনপির আরেক মহানগর নেতার কাছে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে কাছে শিয়াল ও বকের গল্পের উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনিও নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তেই এ সব কথা বলেন।
তিনি বলেন, আপনাদের নিশ্চয়ই শিয়াল ও বকের একে অপরের নিমন্ত্রণের কথা মনে আছে? শিয়াল তার বন্ধু বককে তার বাড়িতে দাওয়াত দিল। বক শিয়ালের বাড়িতে গেলে প্রশস্ত একটি থালায় বকের জন্য তরল খাবার পরিবেশন করা হল। বক সরু লম্বা ঠোঁট দিয়ে তার কিছুই খেতে না পেরে দুঃখ বুকে চেপে বাড়ি ফিলে গেল।
মহানগর ওই নেতা আন্দোলনের এই মুহূর্তে সরকারের ডিসিসি নির্বাচনকে শিয়ালের ধূর্ততার সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি বলেন, ‘ধূর্ততার এই নির্বাচনে বিএনপির নেতাকর্মীরা কেমন করে অংশ নেবে?’
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে সরকারদলীয় প্রার্থীদের রঙবেরঙের পোস্টার, ব্যানার ও বিলবোর্ডের বাহুল্য। যদিও নির্বাচন কমিশনের আহ্বানে বিভিন্ন এলাকার কিছু ব্যানার, বিলবোর্ড সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এর মাঝে বিএনপি দলীয় কোনো নেতাকর্মীর কোনো প্রচার-প্রচারণা চোখে পড়েনি।
বিএনপির ঢাকা মহানগর কাফরুল থানার নেতা হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, ‘ভাই বর্তমান অবস্থায় কেমন করে নির্বাচনে প্রার্থী হব। আমাদের প্রতিটি নেতাকর্মী সারাক্ষণ নিজের জীবন নিয়েই টেনশনে থাকেন। সবকিছু থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রেখেও হামলা-মামলা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারছেন না। প্রতিদিনই নতুন নতুন মামলা হচ্ছে। নির্বাচন করতে হলে তো একটি ভয় মুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন। বিএনপির প্রার্থীদের কি নির্বাচন কমিশন এমন কোনো নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, নির্বাচনে প্রার্থী হলে বা নির্বাচন চলাকালীন সময়ে তাদের হয়রানি করা হবে না?
হাবিব আরও বলেন, এরপরও দলীয়ভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা আসলে তখন এ বিষয়ে ভাবা যাবে। এর আগে নয়।
ঢাকা মহানগর বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে এখনও পর্যন্ত দলীয়ভাবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দলের হাইকমান্ড থেকেও মহানগর বিএনপির প্রতি কোনো নির্দেশ আসেনি। তবে শিগগিরিই এ বিষয়ে দলীয় অবস্থান নেতাকর্মীদের জানিয়ে দেওয়া হবে।
ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল বলেন, ‘সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বিষয়ে দলের হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নেবেন। সেই সিদ্ধান্ত আমাদের কাছে আসলে তা মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীদের বিশেষ করে যেসব নেতা প্রার্থী হতে চান, সকলকে জানিয়ে দেওয়া হবে।
মহানগর বিএনপির দফতরের দায়িত্ব পালনকারী যুগ্ম আহ্বায়ক ও কাফরুল থানা বিএনপির আহ্বায়ক আলী আজগর মাতবর বলেন, দু’একদিনের মধ্যে প্রতিটি থানা কমিটি নিজেরা সভা করে সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এ ছাড়া আমাদের হাইকমান্ড নির্বাচন সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত দেবেন তাই মেনে নেতাকর্মীরা চলবে।
বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিরাপত্তা ও হয়রানিমুক্ত থাকার নিশ্চয়তা এবং দলীয় সিদ্ধান্ত পেলে পুরনো অনেক কমিশনার ডিসিসি নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী।
মগবাজার এলাকার সাবেক কমিশনার হাজী এমএ মজিদের পারিবারিক সূত্র জানান, তিনি গুরুতর অসুস্থ। এরপর রাজনৈতিক কারণে তাকে আত্মগোপনে থাকতে হচ্ছে। এখন নিজে থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে তিনি কোনো সিদ্ধান্তও নেননি। যদি দল নির্বাচনের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তিনি অংশ নেবেন।
দলীয় সিদ্ধান্ত পেলে কাফরুল থানার ১৪ নং ওয়ার্ডে একাধিক বিএনপি দলীয় নেতা কমিশনার প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন হাবিবুর রহমান হাবিব, আকতার হোসেন জিল্লু, আহসান উল্লাহ হাসান, আনোয়ার হোসেন কাজল, শফিউল আজম প্রমুখ।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পল্লবীর সাবেক কমিশনার সাইদুর রহমান নিউটনের স্ত্রী মিষ্টি, ধানমন্ডি কলাবাগানের সাবেক কমিশনার আবদুল লতিফ, ৪৭ নং ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার জসিম উদ্দিন মাহমুদ, ওয়ারীতে সাবেক ৭৬ নং ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার মগবুল হোসেন টিপু, ৭৭ নং ওয়ার্ড কমিশনার হাজী লিয়াকত হোসেন, নারিন্দা, ৭৪ নং ওয়ার্ডে হাজী আবুল বাশার, মিরপুরে আবদুল বাসিত আঞ্জু ও শামীম পারভেজ, ৭৭ নং ওয়ার্ড দক্ষিণ মৈশন্ডি লিয়াকত হোসেন, মালিবাগে আরিফ হোসেন, তেজগাঁওয়ে আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার, বনানীর আবদুল আলিম নকি প্রমুখ দলীয় নির্দেশনা পেলে সিটি নির্বাচনে নিজেদের ওয়ার্ডে কমিশনার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
মিরপুরের সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার শামীম পারভেজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মামুন চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক মামলার কারণে শামীম আত্মগোপনে রয়েছে। তবে যতটুকু জেনেছি বিএনপি নির্বাচনে গেলে ও সরকার পক্ষ থেকে হয়রানি না করা হলে সে নির্বাচনে অংশ নেবে।