আমরা তোমাদের ভুলব না
আরিফ সোহেল
২৬শে মার্চ; আমাদের জাতীয় জীবনে এক অনন্য-অসাধারণ দিন। এই দিনে বার বার মনে পড়ে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় চিরায়ত সেই কবিতার কয়েকটি ছত্র— ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে/কে বাঁচিতে চায়/দাসত্বশৃঙ্খল কে পরিবে পায় হে/ কে পরিবে পায়।’
স্বাধীনতাহীনতায় কেউই বাঁচতে চায় না। তবে পদে পদে পরাধীনতার শৃঙ্খলের নির্মম আঘাতে যাদের রক্তক্ষরণ হয়নি; তাদের পক্ষে হয়তে স্বাধীনতার জন্য এই আকুলতার তাৎপর্য সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কারো দয়ার নয়; স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি রক্তের বিনিময়ে। স্বাধীনতা আমাদের সামনে সম্ভাবনার এক বিশাল দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছে। সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার দায়িত্ব বর্তমান প্রজন্মকেই গ্রহণ করতে হবে। যারা তাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ জীবন বিলিয়ে দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন; আত্মত্যাগ করেছেন তাদের প্রতি যথোচিত শ্রদ্ধা নিবেদন করে আসুন আমরা আবারও শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করি— ‘আমরা কোনোদিন ভুল না’।
২৬শে মার্চ ১৯৭১ সালে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে উড়িয়েছে লাল-সবুজের পতাকা। ইতিহাসের পাতায় রক্তের আল্পনা এঁকে, আত্মত্যাগের বিরল দৃষ্টান্তস্থাপন করে একাত্তরের এই দিন দেশ স্বাধীনের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল শ্রমিক-কামার-কুমার-জেলে-কৃষক-ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীসহ এ দেশের আপামর জনসাধারণ। দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের সূচনার সেই গৌরবগাঁথাই আমাদের অমরত্বের ও অহঙ্কারের। ২৬ মার্চ যুগপৎভাবে আনন্দের ও বেদনার একটি দিন। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমাদের অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। দীর্ঘ রক্তাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে দেশ হয়েছে স্বাধীন। অন্যদিকে পৃথিবী খুঁজে পেয়েছে নতুন এক স্বাধীন রাষ্ট্র; মানচিত্রে যার নাম শষ্য-শ্যামলা ‘বাংলাদেশ’।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। অন্যদিকে হীন চক্রান্তে মেতে ওঠে। তারা আলাপ-আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। এমন কী ভিতরে ভিতরে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে পাকিস্তানী শাসকরা। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহার কারণে বাংলার মুক্তকামী মানুষও ক্রমেই ফুটে ওঠে। তবে তখনো বাঙালীরা যুদ্ধাংদেহী মনোভাব প্রকাশ করেনি।
অথচ পাকিস্তানী চক্রান্তকারীরা তাদের নীলনকশা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঢাকাসহ সারাদেশে ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারেই শান্ত-নিরীহ ঘুমিয়ে থাকা বাঙালীদের ওপর বর্বরোচিত হামলা পরিচালনা করে। ঘটনা বুঝতে বাকী থাকে না জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে। গ্রেফতার হচ্ছেন শতভাগ নিশ্চিত জেনেও তিনি ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের বাড়ি (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু ভবন) থেকে ইপিআরের ওয়্যারলেসযোগ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দেন। বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান ওই বার্তাটি ছিল বেশ আবেগঘন। তারপরও ভয়হীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছি। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ, দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোনো আপস নেই, জয় আমাদের হবেই। আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রু বিতাড়িত করুন। সব আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাপ্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আমাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।’ জাতির পিতার এই ঘোষণার অপেক্ষাই ছিল যেন গোটা জাতি। তার ঘোষণা শোনার পর পর জেগে ওঠে ‘বাংলাদেশ’। ‘হয মৃত্যু; না হয় স্বাধীনতা’— বাংলার জনগণ এই বাণী বুকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন মহান স্বাধীনতার যুদ্ধে।
চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা সেই রাতেই সাইক্লোস্টাইল করে শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে পরে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত বিবৃতিটি সর্বপ্রথম পাঠ করেন আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান। এরপর ২৭ মার্চ তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে যে ঘোষণা পাঠ করা হয় সেখানে উল্লেখ ছিল ‘…ডিক্লেয়ার দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্স অব বাংলাদেশ। অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’ বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণার কপি ইংরেজি ও বাংলায় ছাপিয়ে হ্যান্ডবিল আকারে চট্টগ্রামে বিলি করা হয়। এই ঘোষণা টেলিগ্রাম, টেলিপ্রিন্টার ও তৎকালীন ইপিআরর ওয়ারলেসের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। জাতির পিতার মায়াবী-জাদুকরী ঘোষণায় দেশ-মাতৃকাকে স্বাধীন করার অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়ে বাঙালী জীবনবাজী রেখে যোগ দেয় মুক্তিযুদ্ধে।
স্বাধীনতা মন্ত্র ৭ মার্চে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) উত্তাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু দিয়েছেন। তিনি— ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই ঘোষণা দিয়ে গোটা জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। ২৫শে মার্চ সন্ধ্যা রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘ইয়াহিয়া খান সমস্যা সমাধানের জন্য সামরিক ব্যবস্থা বেছে নিলেন আর এখানেই পাকিস্তানের সমাপ্তি হল।’ রাত সোয়া একটার দিকে ট্যাঙ্ক সাঁজোয়া গাড়ি ও এক লরি সৈন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। তখন বাঙালীর নেতা বঙ্গবন্ধু বীর বাঙালীর মতোই দোতলার ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ান। রাত ১টা ২৫ মিনিটের দিকে এ বাড়ির টেলিফোনের লাইন কেটে দেওয়া হয়। আর জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের মধ্য দিয়েই বাঙালী জাতিকে তাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়।
২৬ মার্চ ২০১৫, বৃহস্পতিবার-স্বাধীনতা ৪৫ বছরে এসে ভিন্ন আমেজে স্বাধীনতা দিবস পালিত হচ্ছে। এমন ঐতিহাসিক দিনে জাতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করবে স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান, প্রয়াত চার জাতীয় নেতা, মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎর্গ করা দেশমাতৃকার অগণিত বীর সন্তান এবং যারা সহায়-সম্পদ-সম্ভ্রম হারিয়েছেন; তাদের। স্বাধীনতার বীর সেনানীদের অর্জিত লাল-সবুজের পতাকা আমরা ব্যবহার করে চলেছি এবং জন্ম থেকে জন্মান্তর চলতেই থাকবে, এই ধান শালিকের দেশ-বাংলাদেশে। এবারের স্বাধীনতার দিবসের আমাদের স্লোগান হোক—‘রাজাকার-আলবদর চিরতরে নিপাত যাক।’
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতিক