৭ কৃতী সন্তানকে স্বাধীনতা পদক প্রদান; পদ-পদকের আশায় রাজনীতি করিনি- পদক ফিরিয়ে দিয়ে অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ
স্বাধীনতার পক্ষে এবং জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল অবদানের জন্য এ বছর দেশের সাতজন কৃতী সন্তানকে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পদক’ দেওয়া হয়েছে। গতকাল বুধবার সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মনোনীতদের হাতে পদক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এর আগে এ বছর স্বাধীনতা পদকের জন্য আটজনের নাম ঘোষণা করা হয়। কিন্তু মনোনীত হয়েও বিশিষ্ট
রাজনীতিক ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ পদক নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক বলেছেন, কোনো পদক-পুরস্কারের আশায় তিনি রাজনীতি করেননি। উল্লেখ্য, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মন্ত্রিত্ব নিতে অস্বীকার করেছিলেন মোজাফফর আহমেদ; আর এবার স্বাধীনতা পদকও নিলেন না ৯৩ বছর বয়সী এই রাজনীতিক। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের একমাত্র জীবিত সদস্য।
মোজাফফর আহমেদের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদসচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা বলেছেন, ‘উনি পদক নিতে আগ্রহী নন। এ জন্য ওনার নাম ড্রপ করা হয়েছে।’
গতকাল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আয়োজনে যাঁদের পদক প্রদান করা হয় তাঁরা হলেন স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত শাহ এ এম এস কিবরিয়া, প্রয়াত কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী ও শহীদ মামুন মাহমুদ, সাহিত্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সংস্কৃতিতে চলচ্চিত্র অভিনেতা আব্দুর রাজ্জাক, গবেষণা ও প্রশিক্ষণে ড. মোহাম্মদ হোসেন মণ্ডল এবং সাংবাদিকতায় প্রয়াত সন্তোষ গুপ্ত। এ পর্যন্ত ২১২ ব্যক্তি ও ২৫টি প্রতিষ্ঠানকে দেশের সর্বোচ্চ এই পদক দেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ১৮ ক্যারেটের ৫০ গ্রামের একটি স্বর্ণপদক, দুই লাখ টাকা ও সম্মাননাপত্র দেওয়া হয়।
অধ্যাপক মোজাফফর স্বাধীনতা পদক না নিলেও তাঁর স্ত্রী আমিনা আহমেদ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংরক্ষিত আসন থেকে সংসদ সদস্য হয়েছেন। গত নবম সংসদেরও সংরক্ষিত আসনের এমপি ছিলেন ন্যাপের এই প্রেসিডিয়াম সদস্য।
জানতে চাইলে মোজাফফর আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পদক নিলেই সম্মানিত হয়, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি বিশ্বাসী নই। দেশপ্রেম ও মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি রাজনীতিতে এসেছিলাম, কোনো পদক বা পদ-পদবি আমাকে উদ্বুদ্ধ করেনি। সত্যিকার অর্থে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তাঁরা কেউই কোনো প্রাপ্তির আশা করেন না।’ তিনি বলেন, ‘পদ বা পদকের জন্য কখনো রাজনীতি করি নাই। রাজনীতির অর্থ দেশসেবা, মানুষের সেবা। শেখ মুজিব আমাকে অনেক কিছু বানানোর চেষ্টা করেছিলেন, আমি হই নাই। আমি মহাত্মা গান্ধী, মওলানা ভাসানীর অনুসারী।’
১৯৭১ সালে ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া এ বছর মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক পান। ২০০৫ সালের ১৭ জানুয়ারি নিজের নির্বাচনী এলাকায় এক জনসভায় গ্রেনেড হামলায় নিহত কিবরিয়ার পক্ষে তাঁর চাচাতো ভাই শাহ আব্দুল মোসাব্বের গতকাল প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে স্বাধীনতা পদক নেন।
বৃহত্তর সিলেটে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় বিশেষ ভূমিকা রাখায় প্রয়াত কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী এবার স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন। একাত্তরে সম্মুখসমরে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মানিক চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় মানিক চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে চার বছর কারারুদ্ধ রাখা হয়। ১৯৯১ সালের ১০ জানুয়ারি মারা যান তিনি। গতকাল তাঁর পক্ষে তাঁর স্ত্রী বেগম রোকেয়া চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেন।
১৯৭১ সালে রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজির দায়িত্বে থেকেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন মামুন মাহমুদ। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করায় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহীদ হন তিনি। ২৬ মার্চ রাতে রাজশাহী পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগারের চাবি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর ও পুলিশ সদস্যদের আত্মসমর্পণ না করার নির্দেশ দেওয়ায় সে রাতেই রংপুর ব্রিগেড সদর দপ্তরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয় মামুন মাহমুদকে। তাঁর মেয়ে জেবা মাহমুদ বাবার পক্ষে পদক গ্রহণ করেন।
বিশিষ্ট সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন। চলচ্চিত্র অভিনেতা আব্দুর রাজ্জাক দেশের মানুষের কাছে ‘নায়ক রাজ রাজ্জাক’ হিসেবেই বেশি পরিচিত। মোহাম্মদ হোসেন মণ্ডল বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, আব্দুর রাজ্জাক ও মোহাম্মদ হোসেন মণ্ডল গতকাল প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে স্বাধীনতা পদক গ্রহণ করেন। আর প্রয়াত সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ছাড়াও দেশের সব আন্দোলনেই তিনি অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ে কর্মরত এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ কথকও ছিলেন তিনি। ২০০৪ সালের ৬ আগস্ট মারা যান সন্তোষ গুপ্ত। তাঁর পক্ষে তাঁর ছেলে প্রিয়তোষ গুপ্ত পদক গ্রহণ করেন।
স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্তদের পক্ষ থেকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, ‘যদিও স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে- অতীতে এমন ব্যক্তিদের এই পুরস্কার দিয়ে একে কলুষিত করা হয়েছে, তবু এটি সর্বোচ্চ রাষ্ট্রের পুরস্কার। এটি প্রত্যেকের জীবনে শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।’
গতকালের এ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মন্ত্রিপরিষদসচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা। অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য, বিচারপতি, তিন বাহিনীর প্রধান ও ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।