৪০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার জন্য ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে; একই রকম নকশায় কবর সংরক্ষণের উদ্যোগ
৪৫তম স্বাধীনতা দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অন্তত দুটি মন ভালো করা খবর সৃষ্টি করেছে সরকার। একটি হলো মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসনের জন্য দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কোয়ার্টার নির্মাণ করা হবে। পাঁচতলাবিশিষ্ট এসব কোয়ার্টারে ৪০ হাজার ফ্ল্যাট থাকবে। একেকটি ফ্ল্যাটের আয়তন হবে ৯৫০ থেকে এক হাজার বর্গফুট। এসব ফ্ল্যাটে ৪০ হাজার অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকার আগামী অর্থবছরেই এ প্রকল্পের কাজ শুরুর পরিকল্পনা নিয়েছে। দ্বিতীয় খবরটি হলো- পৃথক আরেকটি প্রকল্পের মাধ্যমে দুই হাজার ৯৩৮ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। একই রকম নকশায় সব কবর সংরক্ষণ করা হবে। যেকোনো শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর দেখলে মনে হবে সবুজ গালিচার বিছানা। আরামকেদারার আকৃতিতে ফুটে উঠবে জাতীয় পতাকার পরোক্ষ চিত্র। মার্বেল পাথরের মাঝে সবুজ ঘাসের সমন্বয়ে সংরক্ষণ করা হবে প্রতিটি কবর, যাতে চিরনিদ্রায় শায়িত থাকবেন দেশের বীর সন্তানরা আর মনে হবে- তাঁদের আগলে রেখেছে জাতীয় পতাকা, যে পতাকার জন্য অকাতরে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন তাঁরা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, দেশের অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর নির্দেশনার ভিত্তিতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরেই এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। পরিকল্পনা অনুসারে জেলা ও উপজেলা সদরে সরকারি কোয়ার্টারের মতো করে কোয়ার্টার নির্মাণ করা হবে। প্রতিটি কোয়ার্টার হবে পাঁচতলাবিশিষ্ট। কোয়ার্টারের একেকটি ফ্ল্যাটের আয়তন হবে ৯৫০ থেকে এক হাজার বর্গফুট। মন্ত্রী বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁদের সর্বোচ্চ কল্যাণ এবং প্রাপ্য মর্যাদা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যাঁরা অসচ্ছল ও যাঁদের আবাসন সংকট রয়েছে, তাঁদের পুনর্বাসন করার জন্যই এই আবাসন প্রকল্প। এটি আমাদের একটি অগ্রাধিকার প্রকল্প। আগামী বাজেটেই এ প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।’ তিনি জানান, প্রথম বছর ১০ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণের লক্ষ্যে কাজ শুরু হচ্ছে। এই প্রকল্পের আওতায় আগামী চার বছরে সারা দেশে ৪০ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হবে। দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় এই কোয়ার্টার নির্মিত হবে। ফ্ল্যাটগুলো সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ মান্নান জানান, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের জন্য মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প রয়েছে। কিন্তু এই প্রকল্প প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। তাই সব অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০১২ সালে ‘ভূমিহীন ও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাসস্থান নির্মাণ প্রকল্প’ গ্রহণ করে। এই প্রকল্প গুচ্ছগ্রাম আকারের। খাসজমির ওপর বাসাবাড়ি নির্মাণ করে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। এই প্রকল্পের আওতায় ২০১৬ সালের মধ্যে সারা দেশে ২৯৭১টি বাসস্থান নির্মাণের কথা। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪০৩টি বাসস্থান নির্মিত হয়েছে। জুনের মধ্যে আরো ৮৬১টি বাসস্থানের নির্মাণকাজ শেষ হবে। ৪২১টির দরপত্র কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানা গেছে। ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার বক্তারমুন্সী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা পরিমল চন্দ্র দাশ কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর বসবাসের জন্য কোনো ভিটামাটি নেই। তিনি মাথা গোঁজার ঠাঁই জোগাড় করার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়েও আবেদন-নিবেদন করেছেন। তাঁর মতো আরো অনেকেই এমন আবেদন-নিবেদন করেছেন। কিন্তু এখনো কিছুই হয়নি। তাঁদের আশাবাদী করেছে সরকারের নতুন উদ্যোগ। তিনি বলেন, ‘নিজের একটি আশ্রয়ে যদি শান্তিতে মরতে পারি, সেটি হবে অনেক পাওয়া।’ শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি হবে এক রকমের : মুক্তিযুদ্ধকালে রণাঙ্গনে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর চিহ্নিতকরণ ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রাথমিকভাবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত দুই হাজার ৯৩৮ জন শহীদের কবর সংরক্ষণ করা হবে। এ জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের জন্য সারা দেশে গেজেটভুক্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই ও কবর চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে। জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে এই কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। গত নভেম্বর মাসে গেজেটের কপিসহ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাঠানো হয় জেলা প্রশাসকদের কাছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপপ্রধান মোশারফ হোসেন জানিয়েছেন, গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ৫৫টি জেলা থেকে তথ্য পাওয়া গেছে। সব জেলার তথ্য পাওয়ার পর ডিপিপি তৈরি করে একনেকের অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে বলে জানা গেছে। জানা গেছে, একই নকশায় সব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর পাকাকরণ করে সংরক্ষণ করা হবে, যাতে এই নকশা দেখেই যে কেউ সহজেই চিনে নিতে পারে- এটি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর। মুক্তিযোদ্ধাদের কবরের নকশা করেছেন স্থপতি আসিফুর রহমান ভূঁইয়া। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের কবরটি দেখলে প্রথমে মনে হবে এটি একটি বিছানা। যেখানে পরম প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন আমাদের কোনো বীর যোদ্ধা। আর ওপর থেকে কবরটি দেখলে মনে হবে একটি আরামকেদারা। শিয়রে গোলাকার ফাঁকা একটি বৃত্ত থাকবে, যা আমাদের জাতীয় পতাকাসদৃশ হবে, যে পতাকার জন্য লড়াই করেছিলেন তাঁরা, সেই পতাকাই তাঁদের আগলে রাখবে- এমন একটি ভাবনা থেকেই নকশাটি করা হয়েছে। জানা গেছে, যেখানে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর রয়েছে, সেখানে প্রতিটি কবরই উপরোক্ত নকশা অনুযায়ী তৈরি করে দেবে সরকার। প্রতিটি কবরের এপিটাফে মুক্তিযোদ্ধার নাম, জন্ম ও মৃত্যু তারিখের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া থাকবে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, বীর যোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁদের মহান আত্মত্যাগের বিনিময়েই আজ দেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই বীর যোদ্ধাদের কথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মর মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। – See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2015/03/26/202994#sthash.4NUmC0Z7.dpuf