তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে উদযাপিত স্বাধীনতা দিবস
বিপ্লব আর তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে যেন মেতেছে বাঙালি। ঘরের চারদেয়াল থেকে রাজপথ। অবয়ব থেকে হৃদয়ে, মননে সর্বত্রই লালসবুজের চেতনা। আবহে স্বদেশের প্রতি মমত্ববোধ। আর সুরে সুরে স্বাধীনতার প্রতি এক হৃদয় নিংড়ানো বহিঃপ্রকাশ। একদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের অনুপ্রেরণাদায়ক গান আর অন্যদিকে জাতির জনকের অনবদ্য ভাষণের প্রকম্পন আর রাজধানী ঢাকার পথে প্রান্তরের সমাবেশ সাম্প্রতিককালের সঙ্কটকে ভুলে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে এদেশের মানুষ গৌরবোজ্জল ইতিহাসের কাছে দাঁড়ায়।
স্মৃতিসৌধে পুস্পস্তবক অর্পণ, প্রদীপ প্রজ্বালন, নাচ, গান, আবৃত্তি, প্রদর্শনী, নাটক, কনসার্ট আলোচনাসভাসহ নানা আয়োজনে রাজধানীসহ সারাদেশে উদযাপিত হয়েছে মহান স্বাধীনতার ৪৪তম বার্ষিকী।
বৃহস্পতিবার সকালেই জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে একাত্তরের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিসৌধ ত্যাগ করার পর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বিদেশি কূটনীতিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শুরু হয়। সূর্য ওঠার আগেই সাধারণ মানুষ ভিড় জমতে শুরু করে জাতীয় স্মৃতিসৌধে।
সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে সমরাস্ত্র প্রদর্শনী-২০১৫ পরিদর্শন করেন রাষ্ট্রপতি।
এদিকে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দেন প্রধানমন্ত্রী। গণভবনে ফিরে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বিশেষ ডাকটিকিট ও খাম অবমুক্ত করেন তিনি।
এ ছাড়াও সকালে মোহাম্মদপুরের গজনবী সড়কে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্রামাগারে ফুল, ফল ও মিষ্টি পাঠিয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সকালে ৪৬টি প্রতিষ্ঠানের কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী।
দিবসটি উপলক্ষে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বরেণ্য শিল্পী ও শিশুশিল্পীরা দেশাত্মবোধক ও লোকগান পরিবেশন করে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, বিদেশী অতিথি, সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি, সংসদ সদস্য, গণমাধ্যমের সম্পাদক, তিন বাহিনীর প্রধানসহ সমারিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় প্রেস ক্লাব : সঙ্গীত, নৃত্য, আলোচনা ও নবীন সদস্যদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা দিবস ২০১৫ উদযাপন করেছে জাতীয় প্রেস ক্লাব। এতে একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন প্রখ্যাত নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ফেরদৌস আরা। সমবেত সঙ্গীত পরিবেশন করে বুলবুল একাডেমী অব ফাইন আর্টস এর শিল্পীরা। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে জিনিয়া ও তার দল। এ ছাড়া এ আয়োজনে সমবেত নৃত্য ও সঙ্গীত পরিবেশন করে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্যদের সন্তানেরা।
অনুষ্ঠানে জাতীয় প্রেস ক্লাবের নবীন সদস্যদের ফুল দিয়ে বরণ করে প্রেস ক্লাব কর্তৃপক্ষ।
এর আগে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন প্রেস ক্লাবের যুগ্ম-সম্পাদক ও সাংস্কতিক উপ কমিটির আহ্বায়ক ফরিদা ইয়াসমিন।
ক্লাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি কাজী রওনাক হোসেনের সভাপতিত্বে এ সময় উপস্থিত ছিলেন ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য নূরুল হুদা, শামসুদ্দিন আহমেদ চারু, শান্তা মারিয়া প্রমুখ।
শিল্পকলা একাডেমী : স্বাধীনতা দিবসের দুইদিনব্যাপী আয়োজন স্বাধীনতা দিবসে শেষ হয়েছে শিল্পকলা একাডেমীর নন্দনমঞ্চে। এতে সমবেত সঙ্গীত পরিবেশন করে সাইদুর রহমান বয়াতি ও তার দল, একাডেমীর প্রশিক্ষণ বিভাগের প্রশিক্ষণার্থী ও আওয়ামী শিল্পী গোষ্ঠীর শিল্পীরা। সমবেত নৃত্য পরিবেশন করে নন্দন কলা কেন্দ্র, স্পন্দন ও বাফার শিল্পীরা। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন কৃষ্টি হেফাজ। একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন অনুপমা মুক্তি, সালমা চৌধুরী, সুবর্ণা ও অনিমা মুক্তি গোমেজ।
হাতিরঝিল : নগরীর নয়নাভিরাম স্থান হাতিরঝিল জুড়ে ছিল স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের উপচেপড়া ভিড়। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে হাতিরঝিলের লেকে অনুষ্ঠিত নৌকাবাইচ দেখতে অনুষ্ঠানস্থলে ছুটে আসেন রাজধানীর বাসিন্দারা। মানুষের মাত্রাতিরিক্ত ভিড়ে নয়নাভিরাম হাতিরঝিলের সর্বত্রই ছিল মুক্তির ছোঁয়া।
বাংলা একাডেমি : আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করেছে বাংলা একাডেমি। একাডেমির নজরুল মঞ্চে অনুষ্ঠিত এ আয়োজনের আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, ড. শামসুল বারী, ম. হমিদ প্রমুখ।
একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। আলোচনা পরবর্তী সাংস্কৃতিক আয়োজনে সঙ্গীত পরিবেশন করেন সাজেদ আকবর, আব্দুল হালিম খান,আজগর আলীম, নাসিমা শাহীন ফেন্সি, ফারহানা শিরিন প্রমুখ।
শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ : স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পতাকা মিছিল ও কনসার্টের আয়োজন করে গণজাগরণ মঞ্চ। শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে অনুষ্ঠিত এ আয়োজনে ব্যান্ডসঙ্গীত পরিবেশন করে অবসকিউর, আর্টসেল, মাকসুদ ও ঢাকা, শিরোনামহীন, অর্থহীনসহ দেশের প্রথিতযশা ১৫টি ব্যান্ড।
এর আগে এক পতাকা মিছিল শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর থেকে টিএসসি প্রদক্ষিণ করে পুনরায় প্রজন্ম চত্বরে এসে শেষ হয়।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর : নেচে-গেয়ে স্বাধীনতা দিবসকে স্মরণ করে শিশু-কিশোররা। গতকাল সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে শুরু হয় শিশু-কিশোরদের নাচ, গান, কবিতার আয়োজন। সেখানে দেশাত্মবোধক গান, কবিতা ও নৃত্য পরিবেশন করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিশু-কিশোররা। এসব গান কবিতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যুদ্ধের দিনগুলোর কথা।
‘হায় রে আমার মন মাতানো দেশ, হায়রে আমার সোনা ফলা মাটি’; ‘গেরিলা, আমরা গেরিলা’; ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান’; ‘আমার পরিচয়’ ইত্যাদি গান, কবিতায় উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করে তারা।
খেলাঘর, কল্পরেখা, ইউসেপ টুইটা বোট ফিল্ড স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি গার্লস স্কুল ও নৃত্যজনের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয় বিভিন্ন পরিবেশনায়। সন্ধ্যায় টাঙ্গাইলের মহাদেব সং যাত্রাদল মঞ্চস্থ করে ‘সং যাত্রা’।
এছাড়াও ছিল চিত্র প্রদর্শনী। আগামী ২৮ মার্চ শেষ হবে এ উৎসব।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট : গান, নাচ, আবৃত্তি ও পথনাটক পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৩ দিন্যবাপী ‘স্বাধীনতা উৎসব’।
কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার ও ধানমন্ডিস্থ রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চে বিকেলে একই সময়ে চলে এ উৎসব। উৎসবের দুটি মঞ্চে সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেয় কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, বহ্নিশিখা, সুরতাল, উজান, দৃষ্টি, ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী, স্বভূমি লেখক শিল্পী, জিনিয়া ড্যান্স একাডেমি, মুক্তধারা আবৃত্তি চর্চা, ত্রিলোক, ঢাকা স্বরকল্পন, মৈত্রী শিশুদল।
চ্যানেল আই : বরেণ্য ৫০ জন চিত্রশিল্পীর অংশগ্রহণে চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় ‘রং-তুলিতে মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক বিশেষ অনুষ্ঠান। এবারের অনুষ্ঠানটি উৎসর্গ করা হয় প্রয়াত চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে। মুক্তিযুদ্ধ জযাদুঘরকে দেওয়া হয় বিশেষ সম্মাননা। চিত্রাঙ্কনের পাশাপাশি মূল মঞ্চে দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও সুরের ধারার শিল্পীরা।
এদিকে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে এ দিনে ইন্টারনেটে বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডারকে আরও সমৃদ্ধ করতে নতুন চার লাখ শব্দ গুগল ট্রান্সলেটে যোগ করার কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সারাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্তত ৮০টি স্থানে চার হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবী গুগল অনুবাদে বাংলা শব্দ সংযোজন করেছেন।
বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টায় আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে শুরু হয় এর মূল আয়োজন। বিকাল ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বিরতি নিয়ে শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত এ কর্মযজ্ঞ চলবে।
বিকেলে কম্পিউটার কাউন্সিলে এসে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, যে গতিতে আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি, আশা করা যায়, ভোর পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণ অর্জিত হবে।
এছাড়া বৃহস্পতিবার শব্দ সংযোজনের কাজ চলার মধ্যেই দিনের সেরা ১১ জন শব্দ সংযোজনকারীকে স্মারক পুরস্কার দিয়েছেন তিনি।
এদিকে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সাবেক ক্রিকেটারদের টি-টোয়েন্টি প্রীতি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। মিরপুর শের-ই-বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে ম্যাচে লাল দলকে দুই উইকেটে হারায় সবুজ দল।
এ ছাড়া ২৬ মার্চের প্রথম প্রহর থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে গুগলের পক্ষ থেকে গুগল ডুডল প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ নিয়ে নকশা করা লোগোর ওপর ক্লিক করেই গুগলে দিনব্যাপী পাওয়া গেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের তথ্য ও দিবসটি ঘিরে নানা আয়োজনের খবর।
পাবলিক লাইব্রেরী মিলনায়তনেও অনুষ্ঠিত হয়েছে দেশাত্নবোধক গানের অনুষ্ঠান।