বঙ্গবন্ধুর এক অনন্য ভাষণ
ড. অনুপম সেন
বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি তার হাজার বছরের ইতিহাসে ১৯৭১ সালেই প্রথম একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এর আগে বাঙালি নিজের জাতিসত্তাকে কয়েক হাজার বছর ধরে রূপ দেয়। আজ যেখানে বাংলা-অঞ্চল সেখানে পুণ্ড্রবর্ধন, সুম্ম, রাঢ়, হরিকেল, বরেন্দ্র প্রভৃতি উপজাতি তাদের নাম অনুসারে বসতি স্থাপন করেছিল এবং এসব নামে বিভিন্ন অঞ্চল বা রাজ্যসত্তার অস্তিত্বের খবরও অস্পষ্টভাবে ইতিহাসে পাওয়া যায়। খুব স্পষ্টভাবে আমরা কর্ণসুবর্ণের স্বাধীন রাজা শশাঙ্কের কথা জানি; জানি, প্রায় ৪০০ বছর ধরে বাংলা এমনকি বাংলাকে ছাড়িয়ে পাল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল। সেন রাজারাও ছিলেন প্রায় অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়জুড়ে বাংলার এক অংশে। আরও জানি, সুলতানি আমলে স্বাধীন পাঠান-সুলতানরা বাংলা অঞ্চলকে প্রায় বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে পরিণত করেছিলেন। মোগল সা�্রাজ্যের শেষভাগে মুর্শিদকুলী খাঁ, আলিবর্দি, সিরাজদৌল্লা প্রমুখ সুবেদার দিল্লির প্রতি নামমাত্র আনুগত্য স্বীকার করে প্রায় স্বাধীনভাবে বাংলায় রাজত্ব করেছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ে বাঙালির বাংলা কোনোদিন রাষ্ট্র ভাষা বা সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়নি। রাজসভার ভাষা ছিল সংস্কৃত, পালি বা ফার্সি। সংস্কৃত বা ফার্সি ছিল প্রকৃত পক্ষে রাজন্যবর্গের বা বিদগ্ধজনের সর্বভারতীয় ভাষা। উপমহাদেশের এক প্রান্তের শিক্ষিত মানুষ অন্য প্রান্তের শিক্ষিত মানুষের সঙ্গে অনায়াসে এই ভাষায় ভাবের আদান-প্রদান করতে পারতেন। তাই প্রকৃত অর্থে স্বাধীন বাংলা রাজ্য মাঝেমধ্যে সৃষ্টি হলেও স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র কোনোদিন সৃষ্টি হয়নি ১৯৭১ সালের আগে, যেখানে প্রতিটি বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি নিজের জাতিসত্তার স্ফুরণ ঘটিয়ে নাগরিক হিসেবে প্রতিটি মানব অধিকারের স্বীকৃতি পেয়েছে নিজের রাষ্ট্রের সংবিধানে। স্বাধীন রাজ্যে রাজা বা রাজন্যবর্গ স্বাধীন হলেও প্রজারা ছিল পরাধীন, ব্যক্তি ছিল পরাধীন; এমনকি ব্যক্তির প্রাণও চলে যেত রাজন্যবর্গের মুহূর্তের হুকুমে, বিনা বিচারে। ব্যক্তির পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য, প্রতিটি নাগরিকের স্বাধীনতার জন্য বাঙালি এক মরণপণ মৃত্যুঞ্জয়ী সংগ্রাম করেছিল ১৯৭১ সালে। ৩০ লক্ষ লোক আত্মাহুতি দিয়েই পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনকে পরাভূত করে ছিনিয়ে এনেছিল বাঙালির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠা করেছিল বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র, প্রজাদের রাষ্ট্র, জনগণের রাষ্ট্র।
১৯৭১-এর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অসাধারণ ভাষণে বাঙালি জনগণের স্বাধীনতার এই পরম ও চরম আকাক্সক্ষাকে মূর্ত করেছিলেন; স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সবাইকে যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। বাঙালির ওপর অত্যাচারের, নির্যাতনের ও শোষণের চিত্র তুলে ধরেছিলেন অনন্য আবেগে ও তীব্র জ্বালাময়ী ভাষায়, বলেছিলেন রক্ত যখন বাঙালি দিয়েছে আরও দেবে, তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য, তার মুক্তির জন্য। এই ভাষণ এক মহাকাব্যিক দ্যোতনা পেয়েছিল তার শেষ উচ্চারণে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
পেরিক্লিসের পেলোপোনেসিয়ান, আব্রাহাম লিংকনের গেটিস্বার্গ এবং উইনস্টন চার্চিলের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভাষণ প্রভৃতি ভাষণের সঙ্গে এই ভাষণটি বিশ্ব ইতিহাসে স্থান পাবে তার অসাধারণতা ও অনন্যতার জন্য।
কিন্তু অনেকেরই জানা নেই বঙ্গবন্ধু এ রকম আরও একটি অসাধারণ ভাষণ দিয়েছিলেন ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর, বাঙালির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রথম সংবিধান গ্রহণ উপলক্ষে। সেই ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলার ইতিহাসে বোধ হয় এই প্রথম নজির যে, বাঙ্গালীরা তাদের নিজেদের শাসনতন্ত্র প্রদান করছে। বোধ হয় নয়, সত্যিই প্রথম� বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিরা জনগণের ভোটের মারফতে গণপরিষদে এসে তাদের দেশের শাসনতন্ত্র প্রদান করছেন’ (গণপরিষদে প্রদত্ত ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বরের ভাষণ)। একটি জাতির জন্য তার শাসনতন্ত্র নিজে রচনা করা কী বিরাট প্রাপ্তি, কী অসাধারণ অর্জন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা জানি, আমেরিকার শাসনতন্ত্র বা সংবিধান কি গভীর যতেœ ও পরিশ্রমে গ্রহণ করা হয়েছিল ওয়াশিংটন, এডামস, হ্যামিলটন, ফ্রাঙ্কলিন প্রমুখ বিরাট সব প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদদের অমেয় জ্ঞানের প্রয়োগে।
বাংলাদেশে ১৯৭২-এর শাসনতন্ত্র বা সংবিধানও রচনা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গভীর প্রজ্ঞার আলোকে। বিশ্বের মহৎ সব সংবিধান বিশ্লেষণ করে তাদের শ্রেষ্ঠ অর্জনগুলো চয়ন করা হয়েছিল বাংলাদেশের সংবিধানে তা দেশোপযোগী, যুগোপযোগী করে। এই সংবিধান গ্রহণ করার সময় বঙ্গবন্ধুর মনে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, তার ওপর নির্মম শোষণের ইতিহাস যেমন তীব্রভাবে কাজ করেছিল, তেমনি জাগ্রত ছিল তা থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষা। বাঙালির ওপর বহু শতাব্দীব্যাপী যে অর্থনৈতিক-শোষণ অব্যাহত ছিল মোগল আমল থেকে, তা তার অন্তরে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। তাই তিনি এই শোষণের কথা বলেছেন গভীর বেদনায়, যদিও তা মাত্র সংক্ষিপ্ত কয়েকটি বাক্যে, “দুনিয়ার সেই সব লোভীরা এবং তদানীন্তন ভারতবর্ষের যারা শাসক ছিল, তারা বাংলার অর্থ, বাংলার সম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে অন্যত্র। গৃহহারা, সর্বহারা, কৃষক, মজুর, দুঃখী বাঙালি যারা সারাজীবন পরিশ্রম করেছে, দু’বেলা পেট ভরে খেতে পায়নি, তাদেরই সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছে কলকাতার বন্দর, বোম্বাই, মাদ্রাজ; তাদেরই সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছে করাচী, ইসলামাবাদ, লাহোর, গড়ে উঠেছে ডান্ডি, গ্রেট ব্রিটেন। এই বাংলার সম্পদ ছিল বাঙ্গালীর দুঃখের কারণ।” (ওই ভাষণ)
বাংলাদেশের সার্বিক� সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য বাংলাদেশের সংবিধানে বা শাসনতন্ত্রে চারটি মূল পন্থা বেছে নেওয়া হয়েছিল; সেগুলো হলো� জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। শাসনতন্ত্রের এই মূল বা স্তম্ভগুলোকে বঙ্গবন্ধু তার অনন্য ভাষায় ব্যাখা করেছিলেন ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বরের সেই ভাষণে। এই চারটি স্তম্ভের ব্যাখা দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, এগুলো বাঙালির অর্জন বহু প্রাণের বিনিময়ে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে, ‘এই যে চারটা স্তম্ভের উপর শাসনতন্ত্র রচনা করা হলো এর মধ্যে জনগণের মৌলিক অধিকারই হচ্ছে মূল বিধি। মূল চারটা স্তম্ভ জনগণ ভোটের মাধ্যমে এর অস্তিত্ব প্রমাণ করে দিয়েছে। শুধু ভোটের মাধ্যমে নয়, ত্রিশ লক্ষ লোক জীবন দিয়ে, রক্তের মাধ্যমে তা প্রমাণ করে দিয়েছে।’ (ওই ভাষণ)
বাঙালি জাতীয়তাবাদের ব্যাখা তিনি এভাবে করেছেন, ‘জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাঙ্গালী জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল চরম মরণ সংগ্রামে। জাতীয়তাবাদ না হলে কোন জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। এই মূলনীতির উপর ভিত্তি করে আমরা এগিয়ে গিয়েছি। … এই যে জাতীয়তাবাদ, সে সম্পর্কে আমি একটা কথা বলতে চাই। ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন, সকলের সাথে একটা জিনিষ রয়েছে, সেটা হলো অনুভূতি। … অনেক দেশ আছে একই ভাষা, একই ধর্ম, একই সবকিছু, কিন্তু সেখানে বিভিন্ন জাতি গড়ে উঠেছে, তারা একটি জাতিতে পরিণত হতে পারে নাই। জাতীয়তাবাদ নির্ভর করে অনুভূতির উপর। আজ বাঙ্গালী জাতি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে; এই সংগ্রাম হয়েছিল যার উপর ভিত্তি করে সেই অনুভূতি আছে বলেই আজকে আমি বাঙ্গালী, আমার বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ।’ (ওই ভাষণ)
অতি সাধারণ ভাষায় তিনি জাতীয়তাবাদের যে গভীর ব্যাখা দিয়েছেন তা সত্যিই অনন্য। তিনি প্রথমেই বলেছেন, জাতীয়তাবাদ না হলে একটি জাতি এগোতে পারে না। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ আমরা জানি, পলাশির যুদ্ধে জয়ী হয়ে ক্লাইভ সামান্য সংখ্যক সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করেছিলেন, তাকে কেউ বাধা দেয়নি। ক্লাইভ ব্রিটিশ সংসদীয় কমিটির কাছে ব্যাখা করে বলেছিলেন, মুর্শিদাবাদের অধিবাসীরা যদি সাধারণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাকে বাধা দিত, তা হলে তার পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হতো না। বস্তুত পলাশীর যুদ্ধ যখন চলছিল তখন আশপাশের কৃষকরা নিরুদ্বিগ্নভাবে চাষ করে যাচ্ছিল। জনগণের মধ্যে কোনো চাঞ্চল্যই পরিলক্ষিত হয়নি। তারা ভেবেছে এক রাজা যাবে, আরেক রাজা আসবে তাতে তাদের কী। তারা বুঝতেই পারেনি দেশের জন্য কী বিরাট ক্ষতি হচ্ছে। জাতীয়তাবাদ হলো তাই, যখন সাধারণ লোকের মধ্যেও এই অনুভূতি জাগে যে, দেশের স্বার্থই সবার স্বার্থ, দেশের মঙ্গল-অমঙ্গলই প্রতিটি ব্যক্তির মঙ্গল-অমঙ্গলের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এই একাত্ম অনুভূতিই জাতীয়তাবাদ। বিভিন্ন আরব দেশে যেমন� সিরিয়া, ইরাক, মিসর, সৌদি আরবে জনগণের ভাষা ও ধর্ম এক; কিন্তু তারা ভিন্ন ভিন্ন জাতি। কারণ তাদের জাতীয়তাবাদের অনুভূতি ভিন্ন। একইভাবে ইংল্যান্ড, আমেরিকা-যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াও ভিন্ন; কারণ তাদের জাতীয়তাবাদের অনুভূতি ভিন্ন। বঙ্গবন্ধু জাতীয়তাবাদের মূল যে অনুভূতিতেই নিহিত, সহজ-সরল ভাষায় তারই অসাধারণ ব্যাখা দিয়েছেন।
তার গণতন্ত্রের ব্যাখাও সাধারণ ব্যাখা নয়। তিনি গণতন্ত্রের ব্যাখা করেছেন এই বলে, ‘আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র— সেই গণতন্ত্র যা সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করে থাকে।’ (ওই ভাষণ) আজ ধনতান্ত্রিক বিশ্বে যে গণতন্ত্র প্রচলিত রয়েছে তা হলো বুর্জোয়া গণতন্ত্র। ইংল্যান্ডের ১৬৪৪ এবং ১৬৮৮ সালের বিপ্লব, ফ্রান্সের ১৭৮৯ সালের বিপ্লব এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে ১৮৪৮ সালের বিপ্লবগুলো ছিল মুখ্যত, সামন্ততন্ত্র ও স্বৈরাচারী রাজন্যবর্গের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। এসব বিপ্লবের মাধ্যমে সব মানুষ আইনের দৃষ্টিতে সমানাধিকার পেয়েছিল, অর্থাৎ রাষ্ট্রের কাছে আইনত সবাই সমান। কিন্তু আজ কে না জানে, আইনের দৃষ্টিতে সমান হলেও একজন দরিদ্র ও একজন ধনী কোনোদিনই রাষ্ট্র থেকে সমান মর্যাদা পায় না। আমাদের মতো দেশে প্রতিদিন বিচারের বাণী কীভাবে নীরবে-নিভৃতে কাঁদে তা কী বলার অপেক্ষা রাখে? সাধারণ মানুষ বিত্ত ও ক্ষমতার কাছে প্রতিদিন যে অসংখ্য পরাজয় মেনে নিচ্ছে, তাদের ম্লান মুখে শত শতাব্দীর যে বেদনা তা কি আমরা প্রতিনিয়ত দেখি না? সাধারণ বাঙালির এই বেদনা বঙ্গবন্ধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন বলেই বলেছেন, ‘মানুষের একটা ধারণা আছে এবং আগেও আমরা দেখেছি যে, গণতন্ত্র যেসব দেশে চলেছে, দেখা যায় সেসব দেশে গণতন্ত্র পুঁজিপতিদের প্রটেকশন দেওয়ার জন্য কাজ করে এবং সেখানে প্রয়োজন হয় শোষকদের রক্ষা করার জন্যই গণতন্ত্রের ব্যবহার। সে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা চাই, শোষিতের গণতন্ত্র এবং সেই শোষিতের গণতন্ত্রের অর্থ হলো� আমার দেশের যে গণতন্ত্রের বিধিলিপি আছে তাতে সেসব বন্দোবস্ত করা হয়েছে যাতে এ দেশের দুঃখী মানুষ রক্ষা পায়, শোষকরা যাতে রক্ষা পায় তার ব্যবস্থা নাই। … কিন্তু যে চক্র দিয়ে মানুষকে শোষণ করা হয়, সেই চক্রকে আমরা জনগণের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করতে চাই। তার জন্য আমরা প্রথমেই ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী, কাপড়ের কল, পাট কল, চিনির কারখানা সবকিছু জাতীয়করণ করে ফেলেছি, তার মানে হলো, শোষক গোষ্ঠী যাতে এই গণতন্ত্র ব্যবহার করতে না পারে।’ (ওই ভাষণ)
বাংলাদেশের সমাজতন্ত্রের রূপ কী হবে, কোন সমাজতন্ত্রের কথা তিনি বলছেন তাও ব্যাখা করেছেন অনন্য দক্ষতায়, ‘আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি, এবং বিশ্বাস করি বলেই আমরা (ওপরে উল্লেখিত) জাতীয়করণ করেছি। যারা বলে থাকেন, সমাজতন্ত্র হলো না, সমাজতন্ত্র হলো না, তাদের আগে বুঝা উচিত, সমাজতন্ত্র কি? সমাজতন্ত্রের জন্মভূমি সোভিয়েত রাশিয়ায় পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেল, অথচ এখনও তারা সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে চলেছে। … সমাজতন্ত্র বুঝতে অনেক দিনের প্রয়োজন, অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। সেই পথ বন্ধুর। সেই বন্ধুর পথ অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রে পৌঁছা যায়। … আমাদের সমাজতন্ত্রের মানে শোষণহীন সমাজ। সমাজতন্ত্র আমরা দুনিয়া থেকে হাওলাত করে আনতে চাই না। এক এক দেশ এক এক পন্থায় সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। … সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে সেই দেশের কি আবহাওয়া, কি ধরনের অবস্থা, কি ধরনের মনোভাব, কি ধরনের আর্থিক অবস্থা, সবকিছু বিবেচনা করে ক্রমশ এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে, এবং তা আজকে স্বীকৃত হয়েছে। রাশিয়া যে পন্থা অবলম্বন করেছে, চীন তা করেনি। … নিজ দেশের পরিবেশ নিয়ে, নিজ জাতির পটভূমি নিয়ে সমাজতন্ত্রের অন্য পথে চলেছে। … সেজন্য দেশের পরিবেশ, দেশের মানুষের অবস্থা, তাদের মনোবৃত্তি, তাদের রীতিনীতি, তাদের আর্থিক অবস্থা, তাদের মনোভাব, সবকিছু দেখে ক্রমশ এগিয়ে যেতে হয়। একদিনে সমাজতন্ত্র হয়না।’ (ওই ভাষণ)
বঙ্গবন্ধু গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বুঝেছিলেন অন্যান্য সমাজ-বিন্যাসের মতো সমাজতন্ত্রও নানা পতন-অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে; এর পথ মসৃণ নয়, বন্ধুর। মনে রাখা উচিত, কোনো সমাজ-বিন্যাসই একদিনে পরিপূর্ণতা পায়নি। ধনতন্ত্রের পরিপূর্ণতা পেতে ৭০০ বছর লেগেছে, দ্বাদশ শতক থেকে ঊনবিংশ শতক। দেশে দেশে ধনতন্ত্রের ভিন্ন ভিন্নভাবে বিকাশ হয়েছে। ইংল্যান্ডে যেভাবে বিকশিত হয়েছে; জার্মানি বা ফ্রান্সে সেভাবে হয়নি। দীর্ঘ সংগ্রামে, ৭০০ বছরের সংগ্রামে ধনতন্ত্র কিছুটা এগিয়ে আবার পিছু হঠেছে, সামন্তরা কিছুদিনের জন্য হলেও কোনো কোনো দেশে জয়ী হয়েছে। সমাজতন্ত্রও সেভাবে এগোবে। দেশে দেশে দৈশিক অবস্থাভেদে এর রূপ হবে ভিন্ন। কিন্তু এক জায়গায় এর এক মৌলিক লক্ষ্য থাকবে, তা হলো শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, যা বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতনের পর জাপানি-আমেরিকান ঐতিহাসিক ফুকায়মা বিশ্বব্যাপী ধনতন্ত্রের সার্বিক জয়ে ইতিহাসের পরিসমাপ্তি হয়েছে, ঘোষণা করেছিলেন। এর ঠিক অব্যবহিত পরেই জাপানে ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অভূতপূর্ব বিরাট অর্থনৈতিক মন্দা বা ধস নামে। এই ধসের এক দশক অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই ২০০৮ ও ২০০৯-এ মুখ্যত উন্নত বিশ্বে ধনতন্ত্রের মূল কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপজুড়ে যে প্রচ- অর্থনৈতিক মন্দা দেখ দিল তা কি ১৯৩০-এর মহামন্দার পরে আবার ধনতন্ত্রের ভিতেই কি বিরাট ফাটল বা কাঁপুনি সৃষ্টি করেনি? অর্থনৈতিক ধস থেকে যে দুটি বড় দেশ অক্ষত থেকে তাদের অগ্রগতি অব্যাহত রেখেছে তারা হলো চীন ও ভারত। এ দুটি দেশই সমাজতন্ত্রকে কাম্য সমাজ ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য করে তাদের ব্যাংক ও শিল্পপুঁজির বৃহৎ খাতগুলোকে রাষ্ট্র খাতে রেখেছে। ফলে লগ্নীপুঁজির লাগামহারা লোভের করালগ্রাস তাদের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করতে পারেনি। গত দুদশক ধরে ধনতন্ত্রের যে অব্যাহত অবক্ষয় চলছে তার ফলে সমাজতন্ত্রই কি আবার সাধারণ শোষিত মানুষের সামনে বাঁচার পথ হিসেবে নতুন আলোকে উদ্ভাসিত হচ্ছে না? লাতিন আমেরিকায় ব্রাজিল, ভেনজুয়েলা, চিলি, বলিভিয়া ইত্যাদি দেশ সমাজতন্ত্রের পথেই হাঁটছে তাকে যতটুকু সম্ভব দেশভিত্তিক ও যুগোপযোগী করে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জন্যও তাই চেয়েছিলেন চার দশক আগে। তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল বাংলার মানুষের জন্য শোষণহীন সমাজের আকাক্সক্ষা, প্রতিটি মানুষকে তার মানবসত্তার মর্যাদায় অভিষিক্ত করার আকাক্সক্ষা। এ কারণেই সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে ঘোষিত হয়েছিল এই অঙ্গীকার, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে’ (সংবিধান)। অঙ্গীকারে আরও বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন’ (সংবিধান)। আরও যুক্ত করা হয়েছে, ‘মেহনতী মানুষকে- কৃষক ও শ্রমিককে— এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা’ (সংবিধান)।
বাংলাদেশকে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক আধুনিক জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে করা হয় রাষ্ট্রের সংবিধানের অন্যতম মূল ভিত্তি। বঙ্গবন্ধু সংবিধানের এই স্তম্ভটি অতি সরল সর্বজনবোধ্য ভাষায় কিন্তু তীব্র ক্ষোভ ও আবেগে ব্যাখা করেছিলেন এভাবে—’‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারো নাই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খৃষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না। পঁচিশ বছর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরী, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানী, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার— এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলবো ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।’ (ওই ভাষণ)
বঙ্গবন্ধুর ৪ নভেম্বরের এ ভাষণটি একটি অসাধারণ ভাষণ- ওজোগুণ, দার্ঢ্য ও অর্থগৌরবের জন্য। ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের স্বাধীনতার কথাই কেবল বলেননি, মুক্তির কথাও বলেছিলেন; সেই মুক্তির অঙ্গীকারই ৭২-এর সংবিধানের চারটি মূল স্তম্ভে রূপ পেয়েছে। তিনি সংবিধান উপস্থাপনের এই অনন্য ঐতিহাসিক ভাষণটি শেষ করেছিলেন এই বলে, ‘জনতার শাসনতন্ত্রে কোন কিছু লেখা হয় না। … ভবিষ্যৎ বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ গঠন করতে পারে, তাহলে আমার জীবন সার্থক, শহীদের রক্তদান সার্থক।’ (ওই ভাষণ)
লেখক : উপাচার্য, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়