মাঠে নেই বিএনপির আলোচিত কমিশনাররা
দুই ভাগে খণ্ডিত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন-তারিখ নির্ধারণ করে তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। ১৯ মার্চ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ তারিখ ঘোষণা করেন। ২৯ এপ্রিল এ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।
দীর্ঘ প্রায় ১৩ বছর পর ঢাকা মহানগরের বাসিন্দাদের বহুল প্রতীক্ষিত এ নির্বাচন নিয়ে সরকারি মহলে তোড়জোড় শুরু হলেও এখন পর্যন্ত বিএনপিসহ সমমনা দলের প্রার্থীদের তৎপরতা তেমন চোখে পড়ছে না। অথচ অবিভক্ত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে রাজধানীর প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডে বিএনপির স্থানীয় নেতারা কমিশনার হিসেবে প্রতাপের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিএনপি দলীয় ডাকসাইটে সাবেক কমিশনারদের মধ্যে অনেকেই মাঠে নেই। আবার অনেকে বেঁচেও নেই। স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে অনেকের, আবার অস্বাভাবিক মৃত্যুও হয়েছে। আবার বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন অনেকে। যারা সুস্থ আছেন এবং কিছু দিন আগেও যারা রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তারা এখন সরকারের রোষ থেকে বাঁচতে রাজনীতির মাঠে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। আবার অনেকে মামলার কারণে জেলে আছেন কিংবা আত্মগোপনে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
মেয়াদ শেষের প্রায় আট বছর পর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ভোট গ্রহণের তারিখ ২৮ এপ্রিল। একই দিন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনেরও নির্বাচন হবে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সংখ্যাগরিষ্ঠ কমিশনার পদগুলো বিএনপির স্থানীয় নেতাদের দখলে ছিল। বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা ছিলেন মেয়র। ওই সময় কমিশনারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিএনপির স্থানীয় নেতারা অনেকেই করপোরেশনের কোটি কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ নিয়ে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পরও নির্বাচন না হওয়ায় দীর্ঘ আট বছর তারা সিটি করপোরেশনের কমিশনার পদে বহাল থাকেন।
কমিশনার থাকা অবস্থায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন মগবাজারের কমিশনার ইমাম হোসেন, মিরপুর পল্লবীর প্রভাবশালী কমিশনার এক সময়ের ছাত্রদল নেতা সাইদুর রহমান নিউটনও (ঢাকার বিএনপি দলীয় প্রভাবশালী নেতা নাসিরুদ্দিন আহমেদ পিন্টুর ছোট বোনজামাই) দলীয় কোন্দল ও ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জীবন হারান। মহানগর বিএনপির বিশেষ করে পুরান ঢাকার নেতাকর্মীদের কাছে সাহসী নেতা হিসেবে পরিচিত মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সভাপতি ও তৎকালীন কমিশনার হাজী আহমদ হোসেনও দলীয় কোন্দলের কারণে নিহত হন।
মগবাজারের সাবেক কমিশনার আরিফুল ইসলাম ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি হয়ে কারাবন্দী আছেন। এ ছাড়াও কারাবন্দী আছেন ধানমণ্ডি কলাবাগান এলাকার সাহসী নেতা হিসেবে পরিচিত কমিশনার আব্দুল লতিফ।
মতিঝিল থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক কমিশনার বোরহান উদ্দিন ওমর সাহসী নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর সম্প্রতি তিনি মারা যান। বৃহত্তর মিরপুর অঞ্চলের আলোচিত কমিশনাররা হলেন- আবদুল বাসিত আঞ্জু, হাসান, আসাদ ও শামীম পারভেজ। বর্তমান রাজনীতিতে তাদের কোনো খোঁজ নেই। এ ছাড়া সাবেক কমিশনার ডিপজল (অভিনেতা) বিভিন্ন অভিযোগ ও মামলায় পড়ে বর্তমানে রাজনীতি থেকে একেবারেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পুনরায় অভিনয়ে মনোযোগ দিয়েছেন। বৃহত্তর মিরপুর অঞ্চলের ডাকসাইটের অপর কমিশনার মিস্টার আলী দলীয় কোন্দলে পড়ে হত্যার শিকার হয়েছেন।
স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ঢাকার রাজপথ উত্তপ্ত করা রমনার সাবেক কমিশনার চৌধুরী আলম গত তিন বছর ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। বিএনপি ও চৌধুরী আলমের পরিবারের অভিযোগ, সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে নিয়ে গেছে। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে বিষয়টি কোনদিনও স্বীকার করেনি।
পুরান ঢাকার সাবেক কমিশনার মোহন মিয়া, শাহজাহানপুরের ইউনূস মৃধা, কোতয়ালীর ফরিদ কমিশনার, মোসলেহ উদ্দিন কমিশনার, কমিশনার সাজ্জাদ জহির, ধানমণ্ডির আব্দুল লতিফ কমিশনার, তেজগাঁও ফার্মগেটের আনোয়ারুজ্জামানসহ আরও অনেকে বিগত সময়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনে বিএনপি দলীয় কমিশনার হিসেবে ব্যাপক আলোচিত ছিলেন। তারা ছাড়াও মগবাজারের প্রবীণ কমিশনার হাজী এম এ মজিদ, মতিঝিল অঞ্চলের প্রভাবশালী কমিশনার আবুল বাশারও ছিলেন ব্যাপক পরিচিত।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে শেখ হাসিনার সরকারবিরোধী আন্দোলনে এসব কমিশনার নিজেদের অনুসারী ও নেতাকর্মীদের নিয়ে ঢাকার রাজপথ দখলে রাখতেন। বর্তমানে তাদের মতো সাহসী ও ত্যাগী নেতাদের চরম অভাববোধ রয়েছে দলটিতে। ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বর্তমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে। অন্যদিকে, শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা ও নজরদারির অভাবে দলে তৈরি হয়নি নতুন কোনো সাহসী নেতা। যে কারণে বিএনপির মতো একটি ব্যাপক জনপ্রিয় দল পরপর দুটি কমিটি দিয়েও ঢাকার রাজপথ দখলে নিতে পারেনি।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল বলেন, ‘আন্দোলনে রাজপথ দখলে সাহসী নেতা বিএনপিতে অতীতেও যেমন ছিল, বর্তমানেও কোনো অভাব নেই। সময় থেমে থাকে না। অতীতে যারা ছিলেন টগবগে তরুণ ও সাহসী যুবক, সময়ের ফেরে তারা অনেকেই আজ প্রবীণে পরিণত হয়েছেন। তাদের অনেকেই আগের মতো ভূমিকা রাখতে পারেন না। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু অতীতের সেসব সাহসী নেতাদের শূন্যস্থান পূরণে অনেক সাহসী নেতাই সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে একদলীয় ফ্যাসিবাদী শক্তির অপশাসনে দেশ চলছে, এ বিষয়টিও সবাইকে মনে রাখতে হবে।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘বর্তমান অবৈধ সরকার নিজেদের ক্ষমতা ও দখলদারিত্ব ধরে রাখতে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় লেঠেল বাহিনীতে পরিণত করেছে। তারা বিরোধী দলের সকল গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে। দেখামাত্রই গুলি করছে। মানুষ হত্যা করছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে সাহস দেখাতে গিয়ে আমাদের নেতাকর্মীরাতো যুদ্ধ করতে পারে না। সেটা আমরা করতেও চাই না। আমরা দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশের গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলনে আছি। আশা করি, দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে অবশ্যই সেই গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলনে সফল হব। হতাশার কিছু নেই।’