দু’জনাই বাঙালি ছিলাম, দেখো দেখি কাণ্ডখান…
এইতো ক’দিন আগে প্রতুল মুখোপাধ্যায় এসে কাঁদতে কাঁদতে গাইলেন, ‘দুইজনাই বাঙালি ছিলাম, দেখো দেখি কাণ্ডখান, আজকে তুমি বাংলাদেশী আমারে কও ইণ্ডিয়ান ’। বললেন, ‘মনে হয় আমি আমার বাড়ির উঠোনে এসেছি। একটুও মনে হচ্ছে না ভিন্ন কোন দেশে এসেছি।’
সেই যে দেশ দু’ভাগ হয়ে গেলো, তারপর কতো গল্প, কতো বিরহ, কতো দীর্ঘশ্বাস আমাদের পূর্বপুরুষেরা বুকে নিয়ে মরে গেছেন। বাংলা ভাষাতো দু’ভাগ হয়নি। সংস্কৃতিও না। বিশেষ তফাৎ তো ছিলো না। ছিলো বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ধর্ম আর কতটুকু বাঙালিকে আলাদা করতে পেরেছে। কাঁটাতার যতোটা পেরেছে?
একটা ছোট ভূখণ্ড নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেলো। কলকাতা চলে গেলো ভারতের প্রদেশ হয়ে। কাঁটাতার পড়লো মনে। ভারতীয় বলে বড়াই আর প্রদেশ বলে ছোট করার খেলাও শুরু হয়ে গেলো কি নির্মমভাবে।
যে প্রসেনজিৎ ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রে লালনের রূপ ধারণ করলেন তিনিই আবার বাংলাদেশকে নিয়ে কটাক্ষ করলেন। এও কি সম্ভব? সামান্য খেলাকে কেন্দ্র করে বাঙালি-বাঙালিতে তফাৎ করলেন বাঘ আর বেড়াল বলে। বাংলাদেশের বাঙালিদের ইঙ্গিত করলেন বেড়াল বলে। তার কিছুদিন পরই গানওয়ালা কবীর সুমন যখন ভারতের ন্যাক্কারজনক বিজয়ের বিপক্ষে কথা বললেন, তখন কবির সুমনকে আক্রান্ত হতে হলো, কেন তিনি ভারতকে প্রাধান্য না দিয়ে বাঙালি স্বত্ত্বাকে প্রাধান্য দিলেন।
কষ্টের উচ্চারণে কবির সুমন বললেন, ‘একটি জায়গাতেও ভারত, ভারতবাসী বা ভারতের ক্রিকেট দল সম্পর্কে কোনও কুকথা বলিনি। বরং ভারতীয় ক্রিকেট দলকে সাবাশ জানিয়েছি। সেই সঙ্গে বলেছি বাংলাদেশের ক্রিকেট দলকে আমার বেশি পরিচিত মনে হয়, তাঁদের আমি সমর্থক। – ব্যাস্! অমনি ভারতের বেশ কিছু ফেসবুকবিদ যে গালাগালির ঝড় ছোটালেন তা বিস্ময়কর। ভারত বা ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে তো একটি কথাও লিখিনি রে বাবা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার ধারণা, সকলেই ভাবছেন (এর আগে কী-এক পাত্র ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা যা ভাবছিলেন) আমি খুব আহত বোধ করব। ধ্যুৎ। বুঝতে পারি আমার ওপর অনেক বাঙালির প্রচুর রাগ। ১৯৯২ সালে ‘তোমাকে চাই’ বেরনোর পর থেকে তো এই নিয়েই আছি। অভ্যেস হয়ে গেছে।’ তিনি তার আগের স্ট্যাটাসে বাংলাদেশ দলের পক্ষে কেন লিখেছিলেন তার কৈফিয়ত দিয়ে বলেন, ‘আমি চাইছিলাম বাংলাদেশ দল জিতুন। ভালো লাগে দলটাকে। কী করব।’
সবশেষে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আবার বলছি, আমি চাইছিলাম বাংলাদেশ দল জিতুন। ভারতের দলকে গতকালও সাবাশ জানিয়েছি, আজ আবার জানালাম। কিন্তু আমার আনন্দ হতো বাংলাদেশ দল জিতলে।’
অগ্রজের এই উদারতা কেন ধারণ করতে পারলেন না কলকাতার আরেক সঙ্গীত শিল্পী রুপম? কেন তাকে বলতে হলো বাংলাদেশ ‘নতুন পাকিস্তান’? কেন তার মনে হলো বাংলাদেশীরা ছোটলোক? তারুণ্যের মুখে এ উচ্চারণ কি অশনী সংকেত নয় বাঙালিদের জন্য?
আইসিসির প্রশাসনিক দূর্বলতা নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিলো বাংলাদেশের মানুষ। হৃদয়ভাঙ্গার কষ্ট পেয়েছিলো প্রাণের ক্রিকেটে বাংলাদেশ অন্যায়ভাবে হেরে যাওয়ায়। এই কষ্ট কেন বাজলো না আরেক বাঙালীর বুকে? উল্টো যাদের দেখে মানুষ অনুপ্রাণিত হবে, শিখবে তারাই কটাক্ষ করছেন একে অপরকে।
প্রতুলও দেশভাগের কষ্ট বুকে চেপে বলেছেন, ‘দু:খ কিছু ছিলো মনে, দু:খরে কই যাওরে ভাই, সাঁঝ বেলায় আদরের ডাকে কেমনে বলো মুখ ফেরাই..।’
সাঁঝ বেলায় গাইতে এসেছিলেন এ দেশে। গানে গানে বলেছেন-
‘চলো মন, মা বাবার ভূমে
দেখি নিজের ভাই বোনে
শুনছি নাকি তারা আজো
এই পাগলের গান শোনে..
দুইজনাই বাঙালি বন্ধু! বাংলা দুইজনারই জান…দুইয়ের মুখেই বাংলা কথা, দুইয়ের মুখেই বাংলা গান..’’