পরিবারতন্ত্রে বন্দী হচ্ছে ইসলামী রাজনীতি
অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দেশের ইসলামী দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা নেই। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর মতো পরিবারতন্ত্রের দিকে ঝুঁকছে ধর্মভিত্তিক দলগুলো। ইসলাম পরিবারতন্ত্রকে নিরুৎসাহিত করলেও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ ও ইসলামী ঐক্যজোটে ক্রমেই পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
গণতন্ত্রের পরিবর্তে পরিবারতন্ত্রই ইসলামী দলগুলোর মূল মন্ত্র হয়ে উঠছে। যদিও সবারই উদ্দেশ্য কুরআন-সুন্নাহ তথা ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা।
সৌদি আরব বা মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে বাদশাহ্র ছেলে বাদশাহ বা বংশীয় লোকজনই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হচ্ছেন বংশ পরম্পরায়। বাংলাদেশের ইসলামী দলের নীতিনির্ধারণী বা গুরুত্বপূর্ণ পদে ঘুরেফিরে বংশ পরম্পরায় একই পরিবারের লোকজনই কৌশলে অধিষ্ঠিত হচ্ছেন বা করা হচ্ছে। বাবা মারা গেলে বা বাবার অবর্তমানে ছেলে কিংবা তার স্বজনরাই হয়ে উঠছেন দলগুলোর প্রধান নিয়ামক শক্তি।
সংশ্লিষ্ট পরিবারের লোকজনের বাইরে দলে যোগ্য ব্যক্তি থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ পদে ঠাঁই হয় না। কেউ কেউ দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে গেলেও থাকেন কোণঠাসা। গণতন্ত্রের চর্চা না থাকায় দলের অভ্যন্তরে সবসময় থাকে অস্থিরতা। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সবাই শুধু ‘জ্বি হুজুর, জ্বি হুজুর’ করেন। শুধু তাই নয়, অতীতে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে কয়েকবার ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরম হলেও পরিবারতন্ত্রের প্রভাবের কারণে তা বেশী দিন দাঁড়াতে পারেনি। তাই শুরু থেকেই এসব ইসলামী দলের মধ্যে ভাঙন প্রবণতা বিদ্যমান।
স্বাধীনতার পর ১৯৮১ সালের ২৯ নভেম্বর তৎকালীন আলেম সমাজের মধ্যমণি মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুরের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন। তিনি দু’বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও করেছিলেন। পরে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি, ইসলামী ঐক্য আন্দোলনসহ বেশকিছু ধর্মভিত্তিক ইসলামী দল ও হক্কানি আলেমদের সমন্বয়ে তৎকালীন সবচেয়ে বড় ইসলামী প্লাটফরম খেলাফত সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ প্লাটফরমে হাফেজ্জী হুজুর ছাড়াও শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক, চরমোনাই পীর মরহুম সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম, জামায়াতে ইসলামী থেকে অব্যাহতি দেওয়া মাওলানা আব্দুর রহিম, মাওলানা মুহীউদ্দিন খান, বিশিষ্ট ওয়াজিয়ান মরহুম মাওলানা আব্দুল গাফফার, মরহুম মুফতী ফজলুল হক আমিনী অন্যতম।
ঐক্যবদ্ধ এ প্লাটফরমের আমির নিযুক্ত হন মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর। এ প্লাটফরমের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক, চরমোনাই পীর সৈয়দ ফজলুল করীম ও মাওলানা আব্দুর রহিম।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বয়সে ছোট হলেও হাফেজ্জী হুজুরের তৃতীয় ছেলে মরহুম মাওলানা হামিদুল্লাহ ও জামাতা মুফতী ফজলুল হক আমিনী কিছুদিনের মধ্যে হয়ে ওঠেন সর্বেসর্বা। হাফেজ্জী হুজুরের বয়স হওয়ায় ঐক্যবদ্ধ ইসলামী এ প্লাটফরমের সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করেন তারা। হাফেজ্জী হুজুরের পরিবারের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব-অসন্তোষ, দেখা দেয় ভাঙন। ১৯৮৫ সালের দিকে প্রথমেই জোট ছাড়েন মাওলানা আব্দুর রহিম। পুনর্গঠন করেন ইসলামী ঐক্য আন্দোলন। ১৯৮৬ সাল থেকে হাফেজ্জী হুজুরের পরিবারতন্ত্রের বেড়াজাল থেকে একের পর এক বেরিয়ে আসতে থাকেন সিনিয়র নেতা ও প্রথিতযশা আলেমরা।
১৯৮৬ সালে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক, বিশিষ্ট ওয়াজিয়ান মাওলানা আব্দুল গাফফারসহ তাদের অনুসারীরা ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরম থেকে বেরিয়ে আসেন। তারা গঠন করেন বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন (আ-গা)। একই বছরের শেষের দিকে জোট থেকে বেরিয়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম পুনর্গঠন করেন মাওলানা শামসুদ্দিন কাসেমী ও মাওলানা মুহীউদ্দিন খানের অনুসারীরা।
১৯৮৭ সালে চরমোনাই পীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম, আল্লামা আজিজুল হকসহ ওই সময়ের নেতৃস্থানীয় আলেমদের নিয়ে গঠিত হয় ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন। যদিও মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীই ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন প্রতিষ্ঠার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন বলে জানা যায়। তবে শেষ পর্যন্ত মাওলানা সাঈদী এ দলে আর থাকেননি।
ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনও বেশীদিন টেকেনি। শাসনতন্ত্র আন্দোলন থেকে বের হয়ে গিয়ে ১৯৮৯ সালের ১২ অক্টোবর আল্লামা আজিজুল হকের নেতৃত্বে গঠিত হয় খেলাফত মজলিশ। এর আগে ১৯৮৭ সালের ১ অক্টোবর মাওলানা আব্দুর রহীম ইন্তেকাল করেন। তার দল ইসলামী ঐক্য আন্দোলনও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন চরমোনাইর পীরের একটি একক দলে পরিণত হয়।
এদিকে, হযরত হাফেজ্জী হুজুর ১৯৮৭ সালের ৬ মে মারা যান। তার প্রতিষ্ঠিত দল বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমিরে শরীয়ত নিযুক্ত হন বড় ছেলে মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ। তবে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে খেলাফত আন্দোলন থেকে বের হয়ে গিয়ে হাফেজ্জী হুজুরের জামাতা মুফতী ফজলুল হক আমিনী গঠন করেন ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি।
মুফতী ফজলুল হক আমিনী পরবর্তী সময়ে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান হিসেবে বিগত চারদলীয় সরকারের সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর মুফতী আমিনী মারা যাওয়ার পর দলের আমির নিযুক্ত হন তৎকালীন মহাসচিব মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী। তবে বলা হয়ে থাকে, আব্দুল লতিফ নেজামী ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান হলেও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রাধান্য পায় মুফতী আমিনীর ছেলে আবুল হাসনাত আমিনীর মতামত। মুফতী আমিনীর জামাতা মাওলানা সাখাওয়াত হোসেনসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও দলটির কর্তাব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ ব্যাপারে তার বক্তব্য নিতে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামীর ফোনে বার বার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি।
এদিকে, শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হকের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিশেও দফায় দফায় ভাঙন বা দল থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা চলে যান। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়, আল্লামা আজিজুল হকের বয়স বৃদ্ধির সুযোগে তার ছেলে বা পরিবারের লোকজন দলটিতে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। এটি ভাল চোখে দেখেননি সিনিয়র নেতারা। তাই কেউ দল থেকে বেরিয়ে নতুন দল করেছেন বা কেউ অন্য দলে যোগ দিয়েছেন।
২০০৫ সালের ২২ মে শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হকের খেলাফত মজলিশ থেকে বের হয়ে আলাদা খেলাফত মজলিশ গঠন করেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ ইসাহাক ও সাবেক যুব শিবিরের নেতা অধ্যাপক ড. আহমদ আব্দুল কাদের।
অন্যদিকে, শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক ২০১২ সালের ৮ আগস্ট মারা যাওয়ার পর বর্তমানে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ নামে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন সিলেটের অধ্যক্ষ হাবীবুর রহমান (আমির) ও তার ছেলে মুফতী মাহফুজুল হক (মহাসচিব)। তবে, এরই মধ্যে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ থেকে বের হয়ে গিয়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামে যোগ দিয়েছেন দলের সাবেক মহাসচিব মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী ও নায়েবে আমির মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব। খেলাফত মজলিশে পরিবারতন্ত্র (আল্লামা আজিজুল হক) প্রতিষ্ঠার অভিযোগে সিনিয়র নেতারা দল ছেড়েছেন বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের মহাসচিব আল্লামা আজিজুল হকের ছেলে মুফতী মাহফুজুল হকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়।
ইসলামী শাসনতন্ত্রের আমির মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম পীরসাহেব ২০০৬ সালের ২৫ নভেম্বর মারা যান। এরপর দলের আমির নিযুক্ত হন তার তৃতীয় ছেলে মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম। এ ছাড়া রেজাউল করীমের দুই ভাই মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করীম দলের সিনিয়র নায়েবে আমির ও মাওলানা মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া রেজাউল করীমের অপর দুই ভাইও দলের বিভিন্ন পদে আসীন। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন বর্তমানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নামে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল।
অভিযোগ রয়েছে, ইসলামী আন্দোলনে অনেক সিনিয়র ও যোগ্য লোক থাকা সত্ত্বেও পরিবারতন্ত্রের কারণে দলের আমির বা অন্য গুরুত্বপূর্ণ পদে মরহুম চরমোনাই পীরের ছেলেরাই অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এ নিয়ে দলের মধ্যে অসন্তোষ থাকলেও প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলতে পারেন না।
এ ব্যাপারে চরমোনাই পীরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন্দ বলেন, পরিবারতন্ত্র বলতে কিছু নেই। পরিবারের মধ্যে যদি কেউ যোগ্য থাকেন তাহলে তিনি পরবর্তী প্রতিনিধি বা নেতা হতে পারেন। শুধু ইসলামী রাজনৈতিক দলের নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দলেও তো এটা আছে।
তিনি বলেন, আমাদের পীরসাহেব হুজুর মারা যাওয়ার পর মাশোয়ারার (পরামর্শ) ভিত্তিতে নতুন আমির হিসেবে সৈয়দ রেজাউল করীমকে নির্বাচিত করা হয়েছে। তার তো আরও বড় দুই ভাই আছে। তাদের তো করা হয়নি। সুতরাং তিনি যোগ্য বলেই দলের আমির হয়েছেন।
এদিকে, হাফেজ্জী হুজুরের বড় ছেলে মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ বার্ধক্যজনিত কারণে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ালে দলের আমির হন তার ছোট ভাই শাহ আতাউল্লাহ। আর নায়েবে আমির হন আহমাদুল্লাহ আশরাফের দ্বিতীয় ছেলে মাওলানা হাবিবুর রহমান মিয়াজী। দীর্ঘদিন ধরে খেলাফত আন্দোলনে একক আধিপত্য বিস্তার করে আছেন মাওলানা মিয়াজী। বাবার অবর্তমানে তিনি দলের মহাসচিবও হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পদে ভোট হলে তিনি আর ওই পদে নির্বাচিত হতে পারেননি। তবুও দলের কর্তৃত্ব মিয়াজী এবং তার অপর ভাই ও বোনজামাইদের হাতে রয়েছে।
দলে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হচ্ছে কীনা- জানতে চাইলে মাওলানা মিয়াজি বলেন, ‘না, স্বাভাবিকভাবেই চলছে খেলাফত আন্দোলন।’
এ ব্যাপারে দলের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী দ্য রিপোর্টকে বলেন, পরিবারের মধ্যে যদি যোগ্য ব্যক্তি থাকেন তাহলে তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।