সিটি নির্বাচনকে আন্দোলনের ইস্যু করবে ২০ দল
আসন্ন ঢাকা সিটি করপোরেশন (উত্তর-দক্ষিণ) ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের ‘ভুলগুলো’ কাজে লাগিয়ে নির্বাচনকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ করতে চায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। এর মাধ্যমে নতুন ইস্যু তৈরি করে রাজপথের আন্দোলনে তারা সরকারের ভিত ‘নড়বড়ে’ করতে চায়।
অপরদিকে বিএনপিকে আন্দোলন বিমুখ ও জনগণের মাঝে নির্বাচনী আমেজ আনতে সিটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলেও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হওয়ায় ভেতরে ভেতরে চাপ বোধ করছে আওয়ামী লীগ। তবে সমর্থিত প্রার্থীদের জয়লাভের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা এ চাপ কাটিয়ে উঠতে চায়।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে পরস্পরের এমন চিন্তার প্রতিফলনই পাওয়া গেছে।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মতে, ক্ষমতাসীনরা এ নির্বাচনে জিততে মরিয়া। তাদের মরিয়া আচরণই ভুল পথে ধাবিত করবে ক্ষমতাসীনদের। আর সেই ‘ভুল’ সিদ্ধান্ত ও জেতার জন্যে ‘মরিয়া আচরণই’ তাদের ক্যাশ করতে হবে। যা চলমান আন্দোলন গতিশীল করবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘সিটি নির্বাচন স্থানীয় নির্বাচন। এখানে বিএনপির অংশগ্রহণের বিষয় নয়, সমর্থনের বিষয় রয়েছে। আমরা সমর্থন জানিয়েছি। এটিও যদি প্রহসনের নির্বাচন হয় সে ক্ষেত্রে ইস্যু তৈরি হবে। সে ইস্যুতে সরকারের পতন প্রক্রিয়া আরও বেগবান হবে।’
তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের মানসিকতা নিয়েই সিটি নির্বাচনে আমরা প্রার্থীদের সমর্থন জানিয়েছি।’
বিএনপির গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক এ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, ‘সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণের মূল লক্ষ্য আন্দোলন বেগবান করা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জানি সরকার এ নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করবে। আর সেটাই হবে আন্দোলনের হাতিয়ার।’
এদিকে আন্দোলনমুখী বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করাতে সমর্থ হওয়ায় আওয়ামী লীগ এটিকে রাজনৈতিক বিষয় মনে করলেও ডিসিসি উত্তর-দক্ষিণ ও চসিক নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণে চাপে পড়েছে ক্ষমতাসীনরা।
একদিকে যেমন দল সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয়ী করার চাপ অন্যদিকে বিএনপির হাতে নতুন কোনো ইস্যু তুলে দিতে চান না ক্ষমতাসীনরা। তবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির আটঘাট বেঁধে মাঠে নামাকে ভেতরে ভেতরে বাড়তি চাপ মনে করছে সরকারি দল।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে সিটি নির্বাচন নিয়ে প্রাসঙ্গিক নানা আলোচনায় চাপ বোধের তথ্যই পাওয়া গেছে। এ পর্যায়ে সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ভুল বলেও মনে করছে সরকারের অনেক নীতি-নির্ধারণী নেতা। তবে প্রকাশ্যে নির্বাচন প্রসঙ্গে নেতিবাচক কথা বলতে নারাজ এ সব নেতা।
তারা বলছেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জেতার কোনো বিকল্প নেই। সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয়ই কেবল সরকারের ভিত ও জনসমর্থন প্রমাণ করতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী চার জন নেতার মতে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এক বছরের মাথায় সরকারবিরোধী শক্তিগুলোর ঝক্কি-ঝামেলা চরম আকার ধারণ করেছে। বিএনপি ও তাদের মিত্র শক্তিগুলোর অব্যাহত হরতাল-অবরোধ জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। পাশাপাশি অর্থনীতিতেও অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।
তারা জানান, বিএনপিকে আন্দোলন থেকে সরাতে এবং জনসাধারণের মধ্যে নির্বাচনী আমেজ ছড়িয়ে দিতে মূলত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আয়োজন— এটা ঠিক। কিন্তু এর বাইরেও বিকল্প কিছু ভাবা যেত। এখন হিতে বিপরীত কিছু ঘটে যেতে পারে এমন আশঙ্কাও ক্ষমতাসীনদের অনেকের ভেতরে।
আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী দুর্বল। তা ছাড়া দলীয় নেতাকর্মীদের ভেতরের অনৈক্য সামাল দেওয়া সম্ভব না হলে নির্বাচনে বিজয় দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে। আর এ সব জটিলতা কাটিয়ে উঠতে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই নিয়েছেন। বরিশাল, গাজীপুর, রাজশাহী, খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো ফলাফল এড়াতেই এবার এ দায়িত্ব শেখ হাসিনা নিজেই নিয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে তাকে সহযোগিতা করবেন দলের অভিজ্ঞ রাজনীতিকরা।
সূত্রগুলো বলছে, এ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেওয়ার মূল উদ্দেশ্য ইস্যু সৃষ্টি করা। আর ইস্যুকে সামনে রেখে আন্দোলন চাঙ্গা করতে চাইবে তারা।
জানা গেছে, গোয়েন্দারাও এমন তথ্য সরকারকে জানিয়েছেন। নির্বাচনের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের সংঘবদ্ধ করতে পারবে বিএনপি। এ জন্য সরকারকে সজাগ-সতর্ক থাকতে হবে।
সূত্র জানায়, একদিকে বিজয় নিশ্চিত করতে হবে অপরদিকে বিএনপি যাতে কোনো ইস্যু সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্যে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা একাধিক বৈঠকে মিলিত হন। বিজয় নিশ্চিত করতে প্রার্থীদের পক্ষে ব্যাপক গণসংযোগ করা, ভোটারদের কাছে যাওয়া এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক কোনোপ্রকার সহিংসতা যাতে না হয় সেদিকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের দলের সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে বৈঠকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘দীর্ঘদিন নগরবাসী নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এ বিষয়টি মাথায় সরকার সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করেছে। সে অনুযায়ী এ নির্বাচন। সরকার এ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতসহ চক্রান্তকারী একটি মহল রয়েছে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র নিয়ে। সে জন্যে চাপের বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়।’
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘নানা চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র হবে এটি বিবেচনায় নিয়েই নির্বাচন অনুষ্ঠানের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগ। সবকিছু মোকাবিলা করে সিটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘এটি স্থানীয় নির্বাচন, এখানে জয়-পরাজয় জাতীয় রাজনীতিতে কোনো ফেলবে না। তবে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরাই জিতবেন বলে আশা করি।’