১৮ এপ্রিল নির্বাচন ; সমঝোতার ভিত্তিতে হচ্ছে প্রেস ক্লাবের কমিটি
সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ঘোষণা করা হয়েছে জাতীয় প্রেস ক্লাবের নির্বাচনের তারিখ। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ১৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হবে ‘রাজনৈতিকভাবে প্রকাশ্যে দ্বিধাভক্ত’ সাংবাদিকদের এই প্রাণের প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন।
নির্বাচন পরিচালনা করতে এরই মধ্যে গঠন করা হয়েছে সাত সদস্যের একটি কমিটি। যার চেয়ারম্যান করা হয়েছে সরকারের সাবেক প্রধান তথ্য কর্মকর্তা আবু জাফর মো. ইকবালকে। কমিটির অন্য ছয়জন নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
তবে প্রেস ক্লাবের একাধিক সূত্রের দাবি, ‘সমঝোতা’র মাধ্যমেই হতে যাচ্ছে নতুন কমিটি। যাতে থাকবে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই ফোরামের নেতারা। এক ফোরামের নেতৃত্বে থাকছেন আওয়ামী ঘরানার সাংবাদিকরা। অন্য ফোরামে থাকছেন বিএনপি ও সমমনারা। সমঝোতার অংশ হিসেবে আওয়ামী ঘরানার সাংবাদিকরা যে পদে প্রাথী হবেন বিএনপিপন্থী সাংবাদিকরা সেই পদে প্রার্থী হবেন না। সে ক্ষেত্রে কোনো নির্বাচন ছাড়াই সমঝোতার ভিত্তিতে কমিটি ঘোষণা করা হতে পারে। প্রেস ক্লাব সূত্র জানায়, ১৭ সদস্যের জাতীয় প্রেস ক্লাবের পরবর্তী সমঝোতার কমিটিতে আওয়ামীপন্থী সাংবাদিক ফোরাম সভাপতি ও সিনিয়র সহ-সভাপতির পদ পাবে। সহ-সভাপতির পদ পাবে ন্যাশনালিস্ট ফোরাম। এ ছাড়া সাধারণ সম্পাদক ও সিনিয়র সহ-সাধারণ সম্পাদকের পদ পাবে ন্যাশনালিস্ট ফোরাম। পরবর্তী যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদকের পদ পাবে আওয়ামীপন্থী ফোরাম নেতা। কোষাধ্যক্ষ পদ পাবে বিএনপিপন্থী ন্যাশনালিস্ট ফোরাম। বাকি ১০ জন সদস্যের মধ্যে ন্যাশনালিস্ট ফোরামের ছয়জন ও আওয়ামীপন্থী ফোরামের চারজন থাকবেন। কিন্তু ন্যাশনালিস্ট ফোরাম থেকে আরও একটি বেশী সদস্য দাবি করা হচ্ছে। বর্তমানে দুই ফোরাম নেতাদের মধ্যে এ বিষয়ে সমঝোতার চেষ্টা চলছে।
ফোরাম সূত্রে জানা যায়, সমঝোতার ভিত্তিতে সভাপতি পদে প্রার্থী নির্ধারণে নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেছে আওয়ামীপন্থী নেতারা। বৈঠকে প্রাথমিকভাবে দৈনিক সমকাল সম্পাদক গোলাম সরোয়ারকে মনোনয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এই ফোরামের অন্যতম নেতা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল দেশের বাইরে থাকায় বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়নি বলে জানা গেছে।
আওয়ামীপন্থী সাংবাদিক ফোরামের একাধিক সূত্র দ্য রিপোর্টকে জানায়, সভাপতি পদে প্রাথমিকভাবে গোলাম সরোয়ারের নাম বিবেচনা করা হলেও এখনো তা চূড়ান্ত হয়নি। ওই পদে হাসান শাহরিয়ার, ইকবাল সোবহান চৌধুরী, হাবিবুর রহমান মিলন, শফিকুর রহমান, শাহজাহান মিয়া, স্বপন কুমার সাহা, সৈয়দ আকতার ইউসূফ, আজিজুল ইসলাম ভূইয়ার নামও আলোচনায় রয়েছে।
অন্যদিকে বিএনপিপন্থী ন্যাশনালিস্ট ফোরামের পক্ষে এখনো কোনো প্রার্থীর নাম নির্ধারণ করা হয়নি। সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ রয়েছেন দেশের বাইরে। তিনি দেশে ফেরার পর ১ এপ্রিল এ ফোরামের বৈঠক হবে। সেই বৈঠকেই এ পদের জন্য প্রার্থী নির্ধারণ করা হবে।
সূত্র জানায়, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক পদে সাংবাদিক কামরুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুস শহীদ, বদিউল আলম ও কাদের গণি চৌধুরীর নাম বিবেচনা করা হচ্ছে। যেকোনো একজন সমঝোতার ভিত্তিতে এ পদের জন্য নির্বাচিত হবেন।
এদিকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে নির্বাচন সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে। প্রেস ক্লাবের সদস্যদের কাছে দেওয়া এই প্রতিবেদনে নির্বাচনের তারিখ, মনোনয়নপত্র সংগ্রহ, তালিকা প্রকাশ, প্রার্থিতা প্রত্যাহার ও চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের তারিখ উল্লেখ করা হয়।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, যারা নির্বাচন করতে ইচ্ছুক, তারা আগামী ৩ এপ্রিল রাত ১০টা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে পারবেন। প্রার্থী বাছাই ও প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে ৬ এপ্রিল। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ১০ এপ্রিল শুক্রবার রাত ১০টা। চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ হবে ১১ এপ্রিল।
গত ১৫ মার্চ জাতীয় প্রেস ক্লাব ব্যবস্থাপনা কমিটি এ সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ ছাড়া আগামী ১৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হবে প্রেস ক্লাবের বার্ষিক সাধারণ সভা বা এজিএম।
প্রেস ক্লাব সূত্র জানায়, নতুন সদস্যপদ দেওয়া না দেওয়া নিয়ে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত দুই সাংবাদিক ফোরামের মতবিরোধের কারণে নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি জাতীয় প্রেস ক্লাব। দুই বছর মেয়াদী কমিটিরই মেয়াদ শেষের বছরে ডিসেম্বরে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
কিন্তু রাজনৈতিক বিরোধ ও নতুন সদস্যপদ দেওয়ার কারণে বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষেও নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু করতে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাব একটি বিশেষ সাধারণ সভা বা ইজিএম করে। সেই ইজিএমে চলতি কমিটির মেয়াদ পরবর্তী তিন মাস বাড়ান হয়।
এ ছাড়া ওই ইজিএমে সাংবাদিকদের দুই ফোরামের বেশ কিছু নেতাকে নিয়ে ১০টি সুপার কমিটি গঠন করা হয়। ইজিএমে ডিসেম্বরের ২৮ তারিখে জাতীয় প্রেস ক্লাবের পরবর্তী নির্বাচনের তারিখও ঘোষণা করা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তির কারণে সুপার কমিটি কোনো সিদ্ধান্তে একমত হতে পারেনি। ফলে প্রেস ক্লাবের নির্বাচনও হয়নি।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, গত ১৯৯১ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত জাতীয় প্রেস ক্লাব নির্বাচনে বিএনপিপন্থী সাংবাদিকরা একচেটিয়া বিজয়ী হয়ে আসছেন। এর মধ্যে ১৯৯৩-৯৪ মেয়াদে আওয়ামীপন্থী সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার মাত্র এক মেয়াদে সভাপতি পদে বিজয়ী হয়েছিলেন। আর সাধারণ সম্পাদক পদে আওয়ামীপন্থী ফোরাম নেতা স্বপন কুমার সাহা ১৯৯৯-২০০২ পর্যন্ত দুই মেয়াদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর থেকে আর কোনো আওয়ামী ফোরাম নেতা জাতীয় প্রেস ক্লাবে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হতে পারেননি। এমনকি যুগ্ম-সম্পাদকসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতেও বিএনপিপন্থী ন্যাশনালিস্ট ফোরাম নেতারাই বার বার নির্বাচিত হয়ে আসছেন। ফলে আওয়ামীপন্থী সাংবাদিক নেতারা জাতীয় প্রেস ক্লাবের নির্বাচনের বিরোধী হয়ে ‘সমঝোতা’র দিকে নজর দিয়েছেন। এমনকি প্রেস ক্লাবে নির্বাচনে বাধার হুমকিও বিভিন্ন সময় দেওয়া হয় আওয়ামী ফোরামের নেতাদের পক্ষ থেকে। প্রয়োজনে সাংবাদিকদের ট্রেড ইউনিয়নের মতো তারা জাতীয় প্রেস ক্লাবকেও দুই অংশে ভাগ করার হুমকি দেয় একাধিকবার।
সূত্র জানায়, মূলত আওয়ামীপন্থী সাংবাদিকদের বিরোধিতা ও জাতীয় প্রেস ক্লাবকে বিভক্তির হাত থেকে রক্ষা করতেই বর্তমান কমিটি নির্বাচনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, নিদিষ্ট সময়ে নির্বাচন না হওয়ায় বর্তমান কমিটির মেয়াদ আগামী এপ্রিল মাস পর্যন্ত বাড়ান হয়েছে। এরপর সমঝোতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার জন্য এরপর দুই ফোরাম নেতারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পরবর্তী কমিটিতে আওয়ামীপন্থী ফোরাম থেকে সভাপতি ও বিএনপিপন্থী ন্যাশনালিস্ট ফোরাম থেকে সাধারণ সম্পাদক পদসহ অন্যান্য পদ ভাগাভাগি করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বিএনপিপন্থী বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদের কাছে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু কেউই কথা বলতে রাজি হননি।
ন্যাশনালিস্ট ফোরাম নেতা ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান ‘সমঝোতার ভিত্তিতে’ জাতীয় প্রেস ক্লাবের কমিটি গঠন সম্পর্কে , ‘জাতীয় প্রেস ক্লাব আমাদের প্রাণের প্রতিষ্ঠান। আমরা যারা এর সদস্য খুব আনন্দের সঙ্গে এটাকে নিজেদের সেকেন্ড হোম মনে করি।’
তিনি বলেন, ‘সময়ের বাস্তবতায় এখানে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ফোরাম ও বাঙালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ফোরাম নেতারা সকলের মতের ভিত্তিতে একটি কমিটি করার প্রস্তাব করেছেন। এ নেতৃবৃন্দের প্রতি আমাদের আস্থা রয়েছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, গণতন্ত্র চর্চার এই প্রতিষ্ঠানের জন্য যা কল্যাণকর, নেতারা তেমন সিদ্ধান্তই নেবেন।’
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে-একাংশ) সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাবান মাহমুদ , ‘আামি জাতীয় প্রেস ক্লাবের নতুন সদস্য। এখনো ভোটার হইনি। নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করাটা আমার ঠিক হবে না।’
তিনি বলেন, ‘জাতীয় প্রেস ক্লাবের জন্য মঙ্গল ও কল্যাণকর হয় নিশ্চয় এমন কিছুই ফোরাম নেতারা চাইবেন। সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। তবে নির্বাচনের ভেতর দিয়ে কমিটি গঠন হলে জবাবদিহিতার জায়গা আরও স্বচ্ছ হতো বলে আমি মনে করি।’
সাংবাদিকদের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হয় ১৯৫৪ সালে। জন্মের সময় দেশের সাংবাদিকতার অন্যতম মহীরুহ মুজিবুর রহমান খাঁ এর সভাপতি ও প্রখ্যাত সাংবাদিক জহুর আহমেদ চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সেই থেকে এ পর্যন্ত মোট ৩৬টি নির্বাচিত কমিটি জাতীয় প্রেস ক্লাব পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছে।