ঝিনাইদহের ঐতিহ্য এশিয়া মহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও বৃহত্তম বটবৃক্ষ !!
জাহিদুর রহমান তারিক, ঝিনাইদহঃ-
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মালিয়াট ইউনিয়নের বেথুলী গ্রামের উত্তর- পশ্চিম কোণে এশিয়া মহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও বৃহত্তম বটবৃক্ষটি অবস্থিত। কালীগঞ্জ সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পূর্বদিকে কালীগঞ্জ-আড়পাড়া- খাজুরা সড়কের ত্রিমোহনী সংলগ্ন স্থানে এ প্রাচীন গাছটি এখনও দাঁড়িয়ে আছে। বটগাছটিকে কেন্দ্র করে পাশেই বাংলা ১৩৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বেথুলী বা মলিল্গকপুরের বাজার। পর্যায়ক্রমে বাজারের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। বর্তমানে অনেকগুলো দোকান আছে এ বাজারে। প্রতি শনি ও বুধবার সাপ্তাহিক হাট বসে। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসে এখানে। অনেকের মতে, দিনের বেলায়ও গভীর ছায়ায় প্রায় ঢাকা থাকত বটতলা। বৃক্ষটির বয়স প্রায় ৩০০ বছর। মূল বৃক্ষটি সময়ের পরিবর্তনে অনেকগুলো ছোট বৃক্ষ বিভক্ত হয়েছে। মোট ৪৫টি উপবৃক্ষ ও ১২ দাগে প্রায় ১১ একর (২.৩৩ হেক্টর) জমি দখল করে দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণ- পূর্ব পাশের বৃক্ষগুলো জমাটবদ্ধ এবং উত্তর-পশ্চিম পাশে কিছুটা ফাঁকা ছাউনি দিয়ে বেষ্টিত। বৃক্ষটির ৩৪৫টি ঝুরি মাটির সঙ্গে সংযুক্ত এবং ৩৮টি ঝুরি ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। মূলবৃক্ষ এখন আর নেই। মাঝখানে কিছু অংশ ফাঁকা এবং চারপাশে শাখা- প্রশাখায় ঘেরা। একসময় একটি কুয়ার পাশে ছিল এ বিশাল গাছের মূল অংশ। তখন আশপাশে জনবসতি ছিল না বললেই চলে। রাস্তার ধারের এ গাছটির ডালপালা পূর্ণ থাকত সবুজ পাতায়। গাছের নিচে রোদ-বৃষ্টি কিছুই পড়ত না। মাঘের শীতের রাতেও গাছতলায় আবহাওয়া অন্যরকম থাকত। গ্রীষ্মকালে গাছতলা থাকত ঠাণ্ডা। গাছতলায় শুয়ে-বসে বিশ্রাম নিত পথিকের দল। এলাকার প্রবীণরা জানান, বর্তমানে সুইতলা নামের কোনো স্থানের অস্তিত্ব না থাকলেও ধারণা করা হয় পথশ্রান্ত পথিকরা এ মনোরম স্থানে শুয়ে- বসে বিশ্রাম নিত। তখন থেকেই অনেকের কাছে বিশাল বৃটি সুইতলা বটগাছ হিসেবে পরিচিতি পায়। আর সেখান থেকেই এর নামকরণ হয় সুইতলা বটগাছ। বিশাল এ বটগাছটির জন্ম যে কুয়ার পাড়ে, সেটি কোথায় এবং কে খনন করেন তার সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও কারও কারও মতে, যে স্থানে কুয়া ছিল ওই জায়গাটি ১৯২৬ সালে রেকর্ডের আগে বেথুলী গ্রামের স্থানীয় ভূষণ সাহা পরিবারের কারও নামে রেকর্ড ছিল। বর্তমানে পুরোটাই সরকারের খাসজমির অন্তর্ভুক্ত। কুয়ার পাড়ের বটগাছটি কালক্রমে ‘ঝুরি’
নেমে নেমে পাশের এলাকা দখল করে নিয়েছে। এখানকার অধিকাংশ সম্পত্তিই ছিল রায়গ্রামের জোতদার নগেন সেনের স্ত্রী শৌলবালা সেনের নামে। পরবর্তী সময়ে খাস হয়ে যায়। হিন্দু- মুসলিম নির্বিশেষে অনেক লোক রোগব্যাধি মুক্তির আশায় এ গাছের নামে মান্নত করে। পাখিদের অন্যতম একটি আবাসস্থল এ বটবৃক্ষটি। কিচিরমিচির শব্দ লেগেই থাকে। অথচ গাছে কোনো পাখি বাসা বাঁধে না। কোনোদিন কেউ শকুন বসতে দেখেনি। গাছের নিচে পশুপাখি বা প্রাণীর মল-মূত্র দেখা যায় না। বটতলায় কালীপূজার একটি স্থায়ী পাকা বেদি নির্মিত হয়েছে। চাপরাইল গ্রামের গৌরপদ অধিকারী ও হাজারী লাল অধিকারীর আর্থিক সহায়তায় এ বেদি নির্মিত হয়। এ বেদিতে সাড়ম্বরে কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। আগে এ গাছতলায় ১৫ দিনব্যাপী রাসপূজা অনুষ্ঠিত হতো এবং এ উপলে মেলা বসত। ১৯৮২ সালের আগ পর্যন্ত এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বটবৃ হিসেবে পরিচিত ছিল কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনে সংরতি একটি বটগাছ। এ গাছটির আচ্ছাদন ছিল ২.২২ একর জমিজুড়ে। পরে ১৯৮২ সালে বিবিসির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রচারিত হয়, কালীগঞ্জ উপজেলার বেথুলী মৌজায় অবস্থিত সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছটি কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনের (শিবপুর) সেই বটগাছটি অপো বড় এবং এটি এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বটগাছ। ‘বাংলাপিডিয়া’ গ্রন্থে সুইতলা মল্লিককপুরের বটগাছটিকে ‘বিশ্ববট’ বলা হয়েছে। ২.৩৩ হেক্টর এলাকা নিয়ে এ গাছের বিস্তৃতি। সুইতলা বটবৃটির অবস্থান ও নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা জনশ্রুতি। কারও কাছে সুইতলার বটগাছ, কারও কাছে সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছ, আবার কারও কাছে বেথুলী বটগাছ বলে পরিচিত এটি। প্রকৃত পে এর অবস্থান বেথুলী মৌজায়। প্রায় ৩০০ বছর আগে এই গাছের উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায়নি। তবে অযতœ, অবহেলা, রণাবেণের অভাব এবং নানামুখী অত্যাচারের কারণে এ ঐতিহ্যবাহী বটগাছের অস্তিত্ব আজ প্রায় বিলিন হতে চলেছে। মল্লিকপুর গ্রামের বেলায়েত হোসেন মিয়া জীবিত থাকাকালে এ গাছ দেখাশোনা করতেন স্বেচ্ছায়। তিনিই সর্ব প্রথম এখানে একটি দোকান দেন এবং বাজার প্রতিষ্ঠিত করেন। এশিয়া মহাদেশের অন্যতম বৃহৎ এ বটগাছটির ঐতিহাসিক দিক বিবেচনা করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন দর্শনার্থী আসেন এখানে। গুরুত্ব বিবেচনা করে ঝিনাইদহ জেলা পরিষদ বটবৃটির পাশে একটি রেস্ট হাউস নির্মাণ করেন ১৯৯০ সালে। বিস্তৃত বটগাছটির দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাখির কলরব, ছায়াঘেরা শীতল পরিবেশ মুগ্ধ করে দর্শনার্থীদের। এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারলে সুইতলা মল্লিকপুরের এ বটগাছকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠতে পারে পর্যটন কেন্দ্র।