হুমায়ূন আজাদ থেকে ওয়াশিকুর, ৯ খুনের ধরন একই
একজন দুজন নয়, দেখতে দেখতে ১০ জন হামলার শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে শুধু একজন প্রাণে বেঁচে যান। শুধু অনলাইন এক্টিভিস্ট নয়, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, ছাত্র-শিক্ষকও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন। কেন এ হত্যাকাণ্ড? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও।
গোয়েন্দা পুলিশের এক পদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, ধর্মীয় মতাদর্শের পার্থক্যের জন্য এ ঘটনাগুলো ঘটছে। কেউ ইসলামের অপব্যাখ্যা দিচ্ছে এমন মনে হলেই তাদের টার্গেট করছে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী।
অনলাইন এক্টিভিস্ট ও গোয়েন্দারা দাবি করছেন বিজ্ঞানমনস্ক ও মুক্তমনের লেখার কারণেই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর হাতে খুন হচ্ছেন অনলাইন এক্টিভিস্ট, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, ছাত্র ও শিক্ষক। তবে এ সব হত্যাকাণ্ডের ধরন একই। একটি ঘটনারও কুলকিনারা করতে পারে নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির মোড়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি দুর্বৃত্তরা পিছন থেকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে বিজ্ঞান লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ড. অভিজিৎ রায়কে। এ সময় তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও গুরুতর আহত হন। ডিবির উপর দেওয়া এ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে সহায়তার জন্য এফবিআইয়ের (ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) একটি দলও বাংলাদেশে আসে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তদন্তের কোনো কুলকিনারা হয়নি।
এ ঘটনার এক মাস যেতে না যেতেই গত সোমবার ৩০ মার্চ তেজগাঁওয়ের দক্ষিণ বেগুনবাড়িতে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বাসা থেকে বের হওয়ার পর ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে (২৬) রাস্তায় চাপাতি দিয়ে মাথায় আঘাত করে খুন করে আবু তাহের, জিকরুল্লাহ (২০) ও আরিফুল ইসলাম (১৯) নামের তিন তরুণ। পুলিশ তাৎক্ষণিক খুনিদের ধাওয়া দিয়ে ঘটনাস্থলের কিছু দূরে জিকরুল্লাহ ও আরিফুলকে আটক করে। আবু তাহের পালিয়ে যায়। পুলিশ পলাতক আবু তাহের ও পরিকল্পনাকারী মাসুমকে গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
গোয়েন্দাদের তথ্য মতে, শুধু এ দুটি হত্যাকাণ্ড নয়, এর আগে অনলাইন এক্টিভিস্ট যারা খুন হয়েছেন তাদের হত্যাকাণ্ডও একই প্রক্রিয়ায় হয়েছে। শুধু তাই নয় এর বাইরে আরও কিছু হত্যাকাণ্ডের ধরনও একই রকম। যেমন— ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। তারও মাথায় চাপাতি দিয়ে কোপ দেওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় জার্মানির মিউনিখে একই বছরের ১২ আগস্ট হুমায়ূন আজাদের মৃত্যু হয়। এ হত্যা মামলাটি গত ১১ বছরেও শেষ হয়নি।
২০১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। দুই বছরেও এ মামলাটির কোনো অগ্রগতি হয় নি। একই বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে মিরপুরে বাড়ির সামনে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ মামলায় জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের মাওলানা জসিম উদ্দিন রহমানীসহ কয়েকজনকে আইনের আওতায় আনা হয়। গত ১৫ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরুর নির্দেশ দিয়েছে আদালত। ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সাভারে ব্লগার আশরাফুল আলমকেও কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ছাড়াও বুয়েটের ছাত্র দীপ ও অধ্যাপক এ কে এম শফিউল ইসলামকেও একই কায়দায় হত্যা করা হয়।
তবে টেলিভিশনে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পীর-মাশায়েখ ও মাজারের পক্ষে কথা বলে মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী মানুষকে শিরকের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন এই অভিযোগে তাকে খুন করা হয়। নিজের মতো করে ইসলাম প্রচার ও নিজেকে ইমাম মাহদী দাবি করায় গোপীবাগের কথিত পীর লুৎফর রহমান প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর হাতে একইভাবে খুন হন।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, এই প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের ধরন একই। হত্যাকারীরা ভিকটিমের গলা অথবা ঘাড় থেকে মাথা পর্যন্ত জায়গা আঘাতের জন্য টার্গেট করে। মূলত ভিকটিমদের মাথায় আঘাত করে হত্যাকারীরা। হত্যাকাণ্ডের জন্য খুনিরা দেশীয় ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে এবং ভিকটিমদের পিছন থেকে অতর্কিত হামলা চালায়। ভিকটিমকে হাতের নাগালে পাওয়ার দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করে হত্যাকারীরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গ সূত্রে জানা যায়, ওয়াশিকুরের মাথার পেছনে নিচের দিকে দুই ইঞ্চি লম্বা একটি কাটা দাগ। নাকের ওপরে পাশাপাশি ১০ ইঞ্চি লম্বা ও দেড় ইঞ্চি গভীর কাটা দাগ রয়েছে। এটি নাক থেকে উভয় চোখের মাঝামাঝি দুই কানের কাছাকাছি পর্যন্ত বিদ্যমান। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে দু’টি চোখই গলে যায়। থুতনির মাঝ বরাবর চার ইঞ্চি লম্বা ও দেড় ইঞ্চি গভীর একটি কাটা দাগ রয়েছে। গলায় তিন ইঞ্চি লম্বা ও দুই ইঞ্চি গভীর পরিমাণ দু’টি কাটা দাগ রয়েছে। যাতে শ্বাসনালী ছিন্ন হয়ে যায়। ডান গালেও এক ইঞ্চি গভীর ও চার ইঞ্চি লম্বা একটি কাটা দাগ রয়েছে।
অভিজিৎ রায়ের মাথায় (ঘাড়ের উপরে) তিনটি গুরুতর জখম, অন্যপাশে আরও দুটি এবং পিঠে একটি জখমের চিহ্ন পাওয়া যায়। জখমগুলো সমান্তরাল, যেন প্রশিক্ষিত হাতে কোপ দেওয়া হয়েছে। অভিজিতের মাথায় যে তিনটি আঘাত করা হয়, তাতে চামড়া ও হাড় ভেদ করে মগজ পর্যন্ত কেটে গেছে। এ ছাড়া মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী ও গোপীবাগের কথিত পীর লুৎফর রহমানকেও দুর্বৃত্তরা দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে খুন করেছে।
গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র (একাংশ) ডা. ইমরান এইচ সরকার দ্য রিপোর্টকে বলেন, কাউকে হত্যা করা বা আঘাত করা ধর্মরক্ষা নয়, তা তাদের বোঝাতে হবে। সমাজের অন্ধকার দিকগুলো দূর করা না গেলে উগ্রবাদও দূর করা যাবে না। একটি মহল ব্লগারদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে, উস্কানি দিচ্ছে৷ এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। আর হত্যা একটি জঘন্যতম অপরাধ। অতীতে ব্লগারদের ওপর আক্রমণ ও হত্যার বিচার না হওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি অপরাধী ও জঙ্গিদের অপরাধ সংঘটনে উৎসাহিত করে। অতীতের ঘটনাগুলোর যদি সুষ্ঠু বিচার হলে এতগুলো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটত না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এ সকল ঘটনার যোগসূত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র ও যুগ্ম-কমিশনার (ডিবি) মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, প্রতিক্রিয়াশীলরা এখন কৌশল পাল্টে ‘সাইলেন্ট কিলিং’কে বেছে নিয়েছে। আগে তারা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও স্থাপনার উপর হামলার টার্গেট নিয়েছিল। কিন্তু এখন তা থেকে সরে এসে তারা ব্লগারসহ প্রগতিশীলদের ‘সাইলেন্টলি কিল’ (হত্যা) করার কৌশল নিয়েছে। যে সকল ব্লগাদের এরই মধ্যে হত্যা করা হয়েছে, তা একই কায়দায় এবং একই কৌশলে। একই মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে একই কায়দায় হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। তবে হত্যাকারীরা একই সংগঠনের কি-না তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক বেশকয়েক খুনের ধরন একই রকম। ওয়াশিকুর বাবু হত্যাকারীদের মধ্যে দুজনকে ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করতে পারায় রিমান্ডে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে অভিজিৎ হত্যার আসামীদের ক্লু খোঁজা হচ্ছে। পাশাপাশি অন্যান্য হত্যাকাণ্ডে তারা জড়িত ছিল কি-না তাও জানার চেষ্টা করা হবে।
মনিরুল ইসলাম বলেন, তবে যে কয়টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার প্রত্যেকটিতে ইসলাম ধর্মকে নিয়ে কটুক্তি অথবা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আনার অভিযোগ দেখিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে যে কয়টি ঘটনায় কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে তাদের বেশিরভাগেরই সঙ্গে কোনো না কোনো জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। সম্প্রতি ওয়াশিকুর হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার আরিফুল এর আগে নরসিংদীতে জেএমবির সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে গ্রেফতার হয়েছিল।
যে সকল ব্লগারকে আগে হুমকি দেওয়া হয়েছে, সেখানে ওয়াশিকুরের নাম ছিল না। তবে শুধু ব্লগার নয় রাজধানীর নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বদ্ধপরিকর বলেও জানান ডিএমপির মুখপাত্র।