লবিংয়ে মাহী এগিয়ে
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হিসেবে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত আবদুল আউয়াল মিন্টু ছাড়া অন্য কারো কথা ভাবেনি বিএনপি। নির্বাচন কমিশনে আজকের শুনানিতে প্রার্থিতা না টিকলে উচ্চ আদালতে রিট করার প্রস্তুতি নিয়েছেন মিন্টু।
এদিকে শেষ পর্যন্ত মিন্টুর প্রার্থিতা না টিকলে বিএনপি কাকে সমর্থন করবে- এ প্রশ্নে দলটির মধ্যে আলোচনা ও গুঞ্জনের পাশাপাশি শুরু হয়েছে জোর লবিং-গ্রুপিং। দলের বড় একটি অংশ সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ছেলে মাহী বি চৌধুরীকে সমর্থন করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অপর একটি অংশ আবদুল আওয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়ালকে সমর্থন করতে চায়। তবে এ লবিংয়ে গতকাল পর্যন্ত মাহী এগিয়ে আছেন বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
এদিকে বিএনপি সমর্থিত সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের আপত্তির কারণে শেষ পর্যন্ত ‘শত নাগরিক’ ব্যানারে নির্বাচনে যাচ্ছে না বিএনপি। ওই নামকরণ পাল্টে যাচ্ছে। শত নাগরিক ও সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ উভয়ই এ ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি যে নামকরণ চূড়ান্ত করবেন সেই ব্যানার বা ফরম্যাটেই ঢাকার নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি। আর সমর্থিত প্রার্থীদের স্লোগান হবে ‘বাসযোগ্য ঢাকা চাই’।
প্রার্থিতা প্রশ্নে মিন্টুর আপিলের ব্যাপারে আজ বিকেলে নির্বাচন কমিশনে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। ওই শুনানিতে মিন্টুর প্রার্থিতা টিকলে বিএনপি তাঁকেই সমর্থন করবে। আর না টিকলে আইনের আশ্রয় নেবেন মিন্টু। তাঁর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, এ প্রশ্নে উচ্চ আদালতে রিট করবেন মিন্টু। তবে শেষ পর্যন্ত এতেও ফলাফল কিছু না পাওয়া গেলে বিএনপির পাশাপাশি ২০ দলীয় জোটের মধ্যে আলোচনা করে প্রার্থী সমর্থনের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। এরপর দু-এক দিনের মধ্যে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিএনপি সমর্থিত এই প্রার্থীকে সুধী সমাজের প্রার্থী বলে ঘোষণা করা হবে। তাঁর আগে ঠিক করা হবে সুধী সমাজের ওই ব্যানার বা ফরম্যাটের নাম।
‘শত নাগরিক’ ব্যানারে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয় গত শুক্রবার খালেদা জিয়ার সঙ্গে শত নাগরিক জাতীয় কমিটির নেতাদের বৈঠকে। কিন্তু এ খবর জেনে আপত্তি তোলেন বিএনপি সমর্থিত সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের নেতারা। গত সোমবার খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠককালে পরিষদের নেতারা এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের আপত্তির কথা জানান। তাঁরা যুক্তি দেন- ১৭টি পেশাজীবী সংগঠন নিয়ে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের কাঠামো তৈরি হয়েছে। সে তুলনায় শত নাগরিকের কোনো কাঠামো নেই। তা ছাড়া নির্বাচনে তাঁরাও অবদান রাখতে চান বলে খালেদা জিয়াকে জানান পেশাজীবী নেতারা। এরপর খালেদা জিয়া সব সংগঠনকে অন্তর্ভুক্ত করে নতুন একটি নাম ঠিক করার জন্য দলের কয়েক নেতাকে দায়িত্ব দেন। তবে গতকাল পর্যন্ত ওই নামকরণ চূড়ান্ত হয়নি বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পেশাজীবী বা বুদ্ধিজীবীরা কিভাবে একসঙ্গে কাজ করবেন, এটা তাদের বিষয়। এ ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসেসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘শত নাগরিকের সভাপতি এমাজউদ্দিন সাহেব মুরব্বি হিসেবে আমাদের সঙ্গে থাকবেন। কিন্তু ওই নামকরণ থাকবে না।’ শত নাগরিকের বদলে আরো বৃহত্তর পরিসরে পেশাজীবী ও সুধী সমাজের সমন্বয়ে নতুন একটি ব্যানার ঠিক করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাংবাদিক রুহুল আমিন গাজী বলেন, ‘শুধু শত নাগরিক নামকরণের ব্যাপারে আপত্তির কথা বিএনপি চেয়ারপারসনকে আমরা জানিয়েছি। এখন নামকরণ তিনিই চূড়ান্ত করবেন। তবে কী করবেন, তা জানি না।’
মাহী না তাবিথ? : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্র্থী হিসেবে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টুর মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ার পর থেকে বিএনপিতে গুঞ্জন চলছে কে পাবেন বিএনপির সমর্থন- সাবেক রাষ্ট্রপতি বি চৌধুরীর ছেলে মাহী বি চৌধুরী নাকি আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়াল। যদিও এ দুজনের কেউই বিএনপির নেতা নন। তাবিথ বিএনপি নেতার ছেলে আর মাহী সাবেক বিএনপি নেতা তো বটেই; দলটির প্রথম মহাসচিব বি চৌধুরীর ছেলে। বিএনপির তিনি সাবেক এমপি। সে হিসেবে অভিজ্ঞতার পাশাপাশি তুলনামূলকভাবে পরিচিতিও তাঁর বেশি। নিয়মিত টক শো করেন মাহী। এদিকে সাবেক রাষ্ট্রপতি বি চৌধুরী তাঁর ছেলে মাহীকে সমর্থন দেওয়ার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসনকে কয়েকবার অনুরোধ করেছেন বলে জানা যায়। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে বিএনপি ও খালেদা জিয়ার সঙ্গে ‘অনাস্থা’র সূত্র ধরে বৈরী সম্পর্ক হলেও এখন তা অনেকটাই কমে গেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে বি চৌধুরী এখনো তাঁর নিজ দল বিকল্প ধারা নিয়ে আছেন। কিন্তু অনানুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছেন তিনি। প্রকাশ্যেই সরকারবিরোধী অবস্থান নিয়ে বিএনপির পাশে দাঁড়িয়েছেন বি চৌধুরী। সব মিলিয়ে বিএনপিতে তাঁর বিরোধী লোকের সংখ্যা এখন কিছুটা কম। তা ছাড়া দলের এই দুর্দিনে বি চৌধুরীকে পাশেও চান খালেদা জিয়া। তাঁর সঙ্গে আবারও দূরত্ব বা ভুল বোঝাবুঝি হোক, এটা বিএনপিরও কেউ আর চাইছেন না।
এদিকে মির্জা আব্বাস ও সাদেক হোসেন খোকার মধ্যকার মেরুকরণ প্রশ্নেও কিছুটা এগিয়ে মাহী। কারণ তাঁর সঙ্গে খোকা এবং তাঁর অনুসারীদের সুসম্পর্ক রয়েছে। প্রার্থী হলে এ অংশের পুরোপুরি সমর্থন পাবেন মাহী। কারণ খোকা চাইছেন না ঢাকা মহানগরীর পুরো নেতৃত্ব আব্বাস কিংবা তাঁর সমর্থকদের হাতে চলে যাক। দলের মধ্যে আব্বাসের সমর্থক বলে পরিচিত মিন্টু।
জানতে চাইলে মাহী বি চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, আমি নির্বাচন করব- এ জন্য সবার সমর্থনও চাইছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপির সমর্থন পাওয়ার ব্যাপারে আমি অত্যন্ত আশাবাদী। কারণ আমি জাতীয়তাবাদী শক্তির সন্তান।
এদিকে সরকারের ইঙ্গিতে বা রাজনৈতিক কারণে মিন্টুর মনোনয়নপত্র বাতিল হতে পারে- এমন আশঙ্কা থেকে একেবারে শেষদিনে মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন তাবিথ আউয়াল। হিসাব ছিল, যদি সরকার মিন্টুকে নির্বাচন করতে না দিতে চায়- এমন পরিস্থিতিতে প্রার্থী থেকে তাবিথ বিএনপির সমর্থন চাইবেন। আর এমন ক্ষেত্রে বিএনপির সমর্থন পাওয়ার জোর দাবিদারও থাকতে পারতেন তিনি। নৈতিকভাবে বিএনপিও ওই অবস্থায় মিন্টুর ছেলেকে সমর্থন করবে- এমন ধারণা ছিল মিন্টু পরিবারের। কিন্তু আইনগত যে ছোট ভুল, তা একান্তই অনিচ্ছাকৃত ও নিজেদের কারণে। এ অবস্থায় একান্তই মিন্টুর মনোনয়ন না টিকলে তাবিথ প্রার্থী থাকবেন। বিএনপির সমর্থন পাওয়ারও চেষ্টা করবেন। তবে বিএনপি সমর্থন না করলে এ ক্ষেত্রে তাবিথ বা পরিবার শক্তভাবে দরকষাকষি করবেন না বলে সূত্রে জানা গেছে।
মিন্টুর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাবিথ জোর করে নির্বাচন করার পক্ষে নন। বিষয়টি তিনি খালেদা জিয়া বা বিএনপির হাতে ছেড়ে দেবেন। তবে বিএনপির অভ্যন্তরীণ মেরুকরণের কারণে তাবিথ আউয়ালের পক্ষেও জোর লবিং রয়েছে। ঢাকা মহানগরীর এখনকার নেতৃত্বের সঙ্গে মিন্টুর সুসম্পর্ক বিদ্যমান। বিশেষ করে আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস মিন্টুর ঘোরতর সমর্থক বলে পরিচিত। মিন্টু নিজেও মহানগরী বিএনপির ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক। অখণ্ড ঢাকার মেয়র নির্বাচন করার প্রস্তুতিও তাঁর অনেক দিন থেকেই।
সে হিসেবে একান্তই মিন্টুর প্রার্থিতা না টিকলে তাঁর ছেলে তাবিথ আউয়ালকে সমর্থন করতে চাইবেন মির্জা আব্বাস এবং তাঁর অনুসারীরা। তা ছাড়া ঢাকা সিটির নির্বাচনে নোয়াখালী অঞ্চলের ভোটারদের প্রভাব সব সময়ই বহুল আলোচিত একটি বিষয়। সে হিসাব-নিকাশেও এগিয়ে মিন্টু ও তাঁর ছেলে। পাশাপাশি আর্থিক সামর্থ্যও সফল ব্যবসায়ী মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়ালের অনেক বেশি।
গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করে এবং মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়েও তাবিথ আউয়ালের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।