অফিস খোলায় খুশি বিএনপির নেতাকর্মী, শঙ্কা কাটেনি
তিন মাস পর নয়াপল্টনে তালাবদ্ধ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় খুলেছে শনিবার রাতে। সেদিন দলটির সহ-দফতর সম্পাদক আসাদুল করিম শাহীনের সঙ্গে কয়েকজন নেতাকর্মী নিচতলার কলাপসিবল গেটের তালা ইলেকট্রিক করাত দিয়ে কেটে কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। এরপর রবিবার সকাল থেকেই কিছু নেতাকর্মী শঙ্কা নিয়ে কার্যালয়ে প্রবেশ করেন।
শনিবার কার্যালয় তালামুক্ত হওয়ার পর সোমবার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এসেছিলেন দলটির দুই সহ-দফতর সম্পাদক আব্দুল লতিফ জনি ও আসাদুল করিম শাহীন। এ সময় কয়েকজন মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীও ছিলেন। দুপুরের দিকে জনি ও শাহীন কার্যালয়ে এসে কিছু সময় অবস্থান করে আবার চলে যান।
সোমবার বিকেলে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দেখা যায়, কার্যালয়ের তৃতীয় তলায় যেখানে দলের দাফতরিক কাজকর্ম হয় সেখানে অবস্থান করছেন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কর্মকর্তা রেজাউল করিম, অফিস স্টাফ রুস্তম মিয়া, কার্যালয়ের রান্নাবান্নার দায়িত্বপালনকারী খালা, কর্মচারী মুন্না মিয়াসহ অন্যরা।
কার্যালয়ের কর্মকর্তা রেজাউল করিম তৃতীয় তলার পশ্চিম পাশের একটি কক্ষে নিজের জিনিসপত্র পরিষ্কার করছেন। তাকে সহযোগিতা করছেন খালা। এ সময় রেজাউল করিম বলেন, ‘দীর্ঘ ৯৩ দিন পর আজই নিজের কর্মস্থলে ফিরতে পেরে খুব ভাল লাগছে। তবে আশঙ্কাও হয় আবার না জানি অফিস বন্ধ করে দেয়।’
রেজাউল আরও বলেন, অফিস খোলা থাকলে প্রতিদিন শত শত নেতাকর্মীর পদভারে মুখরিত থাকে। নিজেদেরও ব্যস্ত সময় কাটে। কিন্তু দীর্ঘ তিন মাস যেমন পার্টি অফিসও তালা, তেমনি রিজভী স্যারও জেলখানায় বন্দী। তাকে সব সময়ই মিস করছি। তিনি আজকে থাকলে খুব ভাল লাগত।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মোট অফিস স্টাফ ১৪ জন। এদের মধ্যে একজন অফিস পিয়ন গাফফার মিয়া গ্রেফতার হয়ে তিন মাস ধরে জেলে আছেন। বাকি সবাই খোলার পর অফিস করছেন বলে জানালেন রেজাউল।
কার্যালয়ের স্টাফদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ রুস্তম মিয়া নিজের অনুভূতি জানিয়ে বলেন, তিন মাস অপেক্ষায় ছিলাম কখন সরকার অফিস খুলে দেয়। এত দিন অপেক্ষার পর অফিসে আসতে পেরে খুব ভাল লাগছে।
নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে পরিচিত মুখ পাগলা রিজভী। দলের সিনিয়র নেতা থেকে শুরু করে একেবারে তৃণমূল নেতাকর্মীরাও রিজভীকে চেনে। মূলত বিএনপি কার্যালয় ও আশপাশে নেতাদের ব্যানার-পোস্টার লাগিয়ে তার জীবিকা চলে।
পাগলা রিজভী বলেন, তিন মাস ধরে কোনোরকম না খেয়ে বেঁচে ছিলাম। নেতারাও আসতে পারেন নাই। তাই আমারও কোনো ইনকাম ছিল না। খুব কষ্টে কেটেছে দিনগুলো। পার্টি করার কারণে বিভিন্ন সময় পুলিশের হাতেও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। স্ত্রীও বিরক্ত হয়ে নির্যাতন করেছে। এমনকি নিজের স্ত্রী সুইটি বেগম এক মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে শেষমেশ চলেও গেছে। কিন্তু ম্যাডাম ও দলের প্রতি ভালবাসার টানে আমি এখানেই পড়ে রয়েছি।
রিজভী আরও বলেন, এতদিন পার্টি অফিস বন্ধ থাকায় কোনো ধান্ধা হয় নাই। কোনো কামও পাই নাই। আজকে এক নেতার একটি ব্যানার লাগিয়ে দেড়শ’ টাকা পেয়েছি। গত তিন মাস পল্টন থানা বিএনপির সেলিম নামের এক নেতা মাঝে মধ্যে দেড়-দুইশ’ টাকা দিতেন, তাই দিয়ে ভাত খেতাম। এছাড়া লিভিং ইন রেস্তোরাঁর সামনে প্রতিদিন সকালে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মালিক দেখে প্রতিদিনই নাস্তা খেতে দিতেন। আর দুপুরে মহানগর বিএনপির কার্যালয় ভাসানী ভবনের নিচের হোটেলে ত্রিশ টাকায় পেট ভরে মাছ ও অন্য তরকারি দিয়ে খেতে দিত। এছাড়া মাঝে মধ্যে কোর্টে গিয়ে উকিল সাবদের কাছ থেকে পঞ্চাশ, একশ’ টাকা পেতাম। তাই দিয়ে চলতাম। রিজভীও বারবার জানতে চায়, ভাই পার্টি অফিস আবার তালা দিব না তো?
নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের নিচে পূর্বপাশে চা-সিগারেটের দোকানদার রুবেল মিয়া। কিশোর রুবেল জানায়, তিন মাস আগে পুলিশ দোকান উঠাইয়া দিছিল। সেই থেকে আর দোকান করতে পারি নাই। বিএনপি অফিস খোলার পর আজই প্রথম দোকান খুললাম। অফিস খোলাতে আমি খুব খুশি। কারণ অফিস খোলা থাকলে প্রচুর নেতাকর্মী আসবে। আমার বেচা-বিক্রিও ভাল হবে। আমি চাই বিএনপি অফিস খোলা থাকুক।
সরেজমিন দেখা গেছে, সোমবার দুপুরের পর থেকেই বিভিন্ন এলাকার নেতাকর্মী নয়াপল্টনে এসেছেন। এর মধ্যে ঢাকার বাইরের তৃণমূলের নেতাকর্মীর সংখ্যাই বেশি। তবে গত দুই দিনেও দলের সিনিয়র কোনো নেতা বা মহানগর পর্যায়ের কোনো নেতাকে কার্যালয়ে আসতে দেখা যায়নি। একই চিত্র দলের ১১টি অনুমোদিত অঙ্গ সংগঠনের ক্ষেত্রেও। ছাত্রদল ও যুবদলের কিছু নেতাকর্মীকে দেখা গেলেও ওসব অঙ্গ সংগঠনের প্রভাবশালী নেতারাও এখনো কার্যালয়মুখী হননি।
উল্লেখ্য, গত ৩ জানুয়ারি রাতে কার্যালয় থেকে বিএনপি দফতরের দায়িত্ব পালনকারী যুগ্ম-মহাসচিব রিজভী আহমেদকে পুলিশ তুলে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে কার্যালয়টি তালাবদ্ধ করে দেয়। দীর্ঘ তিন মাস তালাবদ্ধ থাকার পর গত শনিবার সন্ধ্যায় তালা ভেঙে কার্যালয়ে প্রবেশ করেন সহ-দফতর সম্পাদক আসাদুল করিম শাহীন।