কামারুজ্জামান নতুন দল গড়ার সিদ্ধান্তে এখনও অটল
আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে ৪ বছরের বেশি সময় আগে কারাগার থেকে লেখা জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের সেই চিঠি। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ৭ নম্বর সেল (বকুল) থেকে কামারুজ্জামান জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্বকে ‘পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন কর্মকৌশল গ্রহণ সময়ের দাবি’ শিরোনামে ওই চিঠিতে জামায়াত ভেঙ্গে নতুন একটি দল গড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এখনো তিনি এ পরামর্শ ও সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন বলে দ্য রিপোর্টকে জানিয়েছেন তার বড় ছেলে হাসান ইকবাল ওয়ামী।
মানবতাবিরোধী অপরাধে আপিল বিভাগের রিভিউয়েও মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রয়েছে কামারুজ্জামানের। সকল আইনি প্রক্রিয়া শেষে এখন শুধু রায় কার্যকরের অপেক্ষায় আছেন তিনি।
২০১০ সালের ১৩ জুলাই গ্রেফতার হন জামায়াতের প্রভাবশালী নেতা কামারুজ্জামান। ওই বছরের ২৬ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ৭ নম্বর সেল (বকুল) থেকে ‘পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন কর্মকৌশল গ্রহণ সময়ের দাবি’ শিরোনামে গোপনে চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন। যা ওই সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশের পর আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। ওই চিঠিতে কামারুজ্জামান জামায়াতে ইসলামীর ৬০ বছরের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের বিশ্লেষণ করে দলের জন্য বেশকিছু নতুন কৌশল ও কর্মপন্থা প্রস্তাব করেন। তিনি সেই চিঠিতে বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘খুব নাজুক’ এবং জামায়াতের জন্য ‘কঠিন চ্যালেঞ্জ’ বলে উল্লেখ করে তা মোকাবিলায় তিনটি বিকল্প পথ বাতলে দেন। এর মধ্যে দ্বিতীয় পথটি গ্রহণের প্রস্তাব করেন তিনি। তিন বিকল্প হলো—
এক. ‘যা হওয়ার হবে। আমরা যেমন আছি তেমনি থাকব।’
দুই. ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়ে পেছন থেকে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তুলবে। এই সংগঠন প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার সঙ্গে ধর্মহীন শক্তির মোকাবিলা করবে।’
তিন. ‘আমাদের যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে, তারা জামায়াতের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াব এবং সম্পূর্ণ নতুন লোকদের হাতে জামায়াতকে ছেড়ে দেব। ’
চিঠিতে কামারুজ্জামান লেখেন, ‘জামায়াতের পরিবেশ রুদ্ধদ্বার (রেজিমেন্টেড) ধরনের। এ জন্য ইসলামী মূল্যবোধসম্পন্ন উদারপন্থী ব্যক্তিরা এই দলে প্রবেশ করতে পারে না। দলটিতে সৎ মানুষের অভাব না হলেওদেশ পরিচালনায় নেতৃত্বদেওয়ার মতো উপযুক্ত ও দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। জামায়াতের বাইরে যে সব সৎ ও দক্ষ লোক রয়েছে, তারা যে কোনো পর্যায়ে জামায়াতে যোগ দিতে উৎসাহবোধ করে না।’
তিনি লেখেন, ‘জামায়াতের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা বর্তমানে আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। এতে ভোটারের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ভোটের রাজনীতিতে বর্তমানে যে কৌশল নেওয়া হয়, তা নিতে জামায়াতের বেশ সীমাবদ্ধতা রয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে আধুনিক ধ্যান-ধারণার অভাব রয়েছে’ বলে মতপ্রকাশ করেন তিনি।
‘জামায়াত নতুন প্রজন্মের চিন্তা-চেতনার আলোকে নিজেদের উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে’ উল্লেখ করে চিঠিতে কামারুজ্জামান লেখেন, নতুন প্রজন্মের ভোটারদের কাছে নিজেদের কর্মসূচি উপস্থাপনের জন্য যে ধরনের আধুনিক পরিভাষা ব্যবহার করা প্রয়োজন, তা ব্যবহারে জামায়াতের ব্যর্থতা রয়েছে। নীতি ও আদর্শের সঙ্গে আপস না করেও কৌশলগত কারণে উদারনীতি অনুসরণ করে সমর্থনের পরিধি বৃদ্ধির দৃষ্টিভঙ্গি জামায়াতের নেই। বর্তমানে বিএনপির ভঙ্গুর অবস্থার কারণে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তির ঐক্য ভবিষ্যতে কতটা কার্যকর হবে তা বলা কঠিন। এমনি এক পরিস্থিতিতে বিকল্প একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয় কামারুজ্জামানের চিঠিতে।
তার মতে, সেই প্লাটফর্মকে রাজনৈতিকভাবে কেউ সরাসরি আক্রমণ করতে পারবে না। আপাতদৃষ্টিতে জামায়াতে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে এমনটি মনে হলেও ক্ষতির কিছু নেই।
কামারুজ্জামান প্রস্তাব করেছিলেন, বাংলাদেশের সংবিধান সামনে রেখে যে ধরনের সংগঠন হলে কোনো প্রশ্ন থাকবে না, সে ধরনের সংগঠন করতে হবে। ছায়া মন্ত্রিসভার ধারণা গ্রহণ করতে হবে। তিনবারের বেশি কেউ কেন্দ্রীয় সভাপতি বা জেলা সভাপতি থাকতে পারবেন না। কেন্দ্রীয় কমিটিতে সব পেশার লোকদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। নির্বাচনে প্রথমে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।
কারাগারে আটক দলের শীর্ষ নেতাদের প্রতি ইঙ্গিত করে চিঠিতে কামারুজ্জামান লেখেন, ‘নির্মোহ এবং নিরপেক্ষভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে। নিজেকে সম্পৃক্ত করে চিন্তা করলে সমস্যার সমাধান হবে না।’ তিনি আরও লেখেন, ‘দ্বিতীয় যে বিকল্পটির কথা উল্লেখ করেছি, সবাই মিলে তা সামনে রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই হবে কাঙ্ক্ষিত এবং যুক্তিযুক্ত। এ ধরনের একটি অবস্থান গ্রহণ করলে সাময়িকভাবে আমাদের জন্য ব্যক্তিগতভাবে অবমাননাকর মনে হলেও শেষ পর্যন্ত মহত্ত্বের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’
কামারুজ্জামানের এই চিঠি গণমাধ্যমে প্রকাশের কিছুদিন পর দৈনিক নয়াদিগন্তে ‘আরব বসন্ত দেশে দেশে’ শিরোনামে একটি কলাম লেখেন দলের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। তার কলামে কামারুজ্জামানের অনেক পরামর্শেরই প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।
তবে জামায়াতের সংস্কার নিয়ে কামারুজ্জামানের সুপারিশগুলো কানে তোলেনি বর্তমান নেতৃত্ব। কামারুজ্জামান ও ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের লেখার প্রতিক্রিয়ায় দলের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর (মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত) স্ত্রী বেগম শামসুন্নাহার ‘বিবেচনায় আনতে হবে সবকিছু’ শিরোনামে পাল্টা একটি কলাম লিখে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, যারা কারাগারে আছেন, তাদের মুক্ত করতে আন্দোলন-সংগ্রাম করবে কারা?
সূত্র জানায়, কামারুজ্জামানের ওই চিঠি নিয়ে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি হয়। এ বিষয়ে জামায়াতের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজাহারুল ইসলাম (পরে গ্রেফতার এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত) তখন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কারাগারে যারা আছেন, তারা দল পরিচালনার জন্য বাইরের নেতাদের দায়িত্ব দিয়েছেন। এর বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই। কেউ যদি এমন কিছু করার চেষ্টা করেন, তা হবে দল ভাঙার ষড়যন্ত্র।’ তখন তিনি এ প্রশ্নও তুলেছিলেন, ‘এত বড় চিঠি কারাগার থেকে এল কী করে?’
‘শেষ মুহূর্তে (সোমবার কারাগারে সাক্ষাতের সময়) জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্বকে আপনার বাবা কোনো পরামর্শ দিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে’— কামারুজ্জামানের বড় ছেলে হাসান ইকবাল ওয়ামী মঙ্গলবার বলেন, ‘দলের জন্য পরামর্শ অনেক আগেই তিনি দিয়েছেন। গ্রেফতার হওয়ার পর পরই। দলের যে পরিবর্তন দরকার এবং যারা অভিযুক্ত (যুদ্ধাপরাধ) তাদের বাদ দিয়ে দল চালানোর জন্য তিনি যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, সে অবস্থানেই আছেন। তার চিন্তা-ভাবনা ও অবস্থান থেকে সরে আসেননি।’
এ ব্যাপারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি।